You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কসবা উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

কসবা উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কসবা উপজেলা থেকে জাতীয় পরিষদে এডভোকেট সিরাজুল হক এবং প্রাদেশিক পরিষদে সৈয়দ এ কে এম ইমদাদুল বারী নির্বাচিত হন। উভয়েই আওয়ামী লীগ- সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন। এ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগের ৬-দফা দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দেয়। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি – (<পিডিপি-) প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে জনগণ প্রত্যাখান করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ঐসব দলের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পরাজিত প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা জনগণের রায়কে বচানচাল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে থাকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী। এ চক্রান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করলেও সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। তাই সারা দেশের মতো কসবা এলাকার জনগণও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেI
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। সঙ্গে-সঙ্গে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং জনতা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের ঝড় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়ও ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এডভোকেট সিরাজুল হক এমএনএ ও সৈয়দ এ কে এম ইমদাদুল বারী এমপিএ-সহ এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসহ স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংগঠনও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় গুরু হয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলনে কসবার সকল স্তরের মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি মোতাবেক সারা দেশের মতো কসবায়ও ২রা মার্চ থেকে প্রতিদিন সভা-সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। সর্বত্র সর্বাত্মক হরতাল ও ধর্মঘট চলতে থাকে। সকল স্তরের জনগণ অসহযোগ আন্দোলনের এসব কর্মসূচিতে যোগদান করতে থাকে। অফিসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ শোনার জন্য কসবার ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় অনেকেই ঢাকায় যান। ঢাকা থেকে ফিরে এসে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সক্রিয় হন। প্রথমেই তাঁরা শুরু করেন সামরিক প্রশিক্ষণ।
৯ই মার্চ থেকে কসবার ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদির এবং ছাত্রনেতা মোজাম্মেল হক এলাকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কসবা ক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন চরনাল গ্রামের মুজাহিদ কমান্ডার আবদুন নূর এবং আনসার কমান্ডার মোহাম্মদ আলী। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে এর সংখ্যা শতাধিকে উন্নীত হয়। এ-সময় কসবায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁরা হলেন- এডভোকেট সিরাজুল হক এমএনএ, সৈয়দ এ কে এম ইমদাদুল বারী এমপিএ, থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল জব্বার, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু আবদুল্লাহ গেদু মিয়া, যুগ্ম-সম্পাদক শহীদুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুর রহমান ছোট্ট মিয়া, আবদুল ওয়াহাব, ন্যাপনেতা ডা. আবদুর রহমান, শ্রীনিবাস, তিমির বরণ, মোহাম্মদ হোসেন, জহিরুল হক, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মতিলাল বণিক প্রমুখ। ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্ব দেন সানাউল্লাহ, এইচ এম শাহ আলম, মোহাম্মদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম দুলু, মাহবুবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী (২ছাত্র ইউনিয়ন ) প্রমুখ। কসবার প্রফেসর খোরশেদ আলম, রেজাউর রহমান ও মমতাজ বেগম তখন ঢাকায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২৫শে মার্চের পর তাঁরা কসবায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
কসবার আবদুল কাইয়ুমকে আহ্বায়ক এবং এইচ এম শাহ আলমকে সম্পাদক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর থানা কমিটি গঠন করা হয়। কসবা থানা ছাত্রলীগ কার্যালয়ে ২৩শে মার্চ এক সভার মাধ্যমে গঠিত এ পরিষদে প্রাথমিক পর্যায়ে সদস্য ছিলেন- আমিনুল ইসলাম, মো. আবদুল কুদ্দুছ, সিদ্দিকুর রহমান, গোপাল চন্দ্র রায়, মো. আজিজুর রহমান, সিরাজুল হক, মুস্তাফিজুর রহমান, জহিরুল আলম মিলন, শহীদুল্লাহ বাচ্চু, মো. মাহফুজুর রহমান, মোহাম্মদ ছানাউল্লাহ, মো. আবদুল ওয়াহাব প্রমুখ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এলাকার সকল যুবককে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এলাকার শতশত ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে।
১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত কসবা এলাকা হানাদারমুক্ত ছিল। এ- সময় প্রায় প্রতিদিনই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মিটিং- মিছিল ও সমাবেশ হয়। এলাকার জনগণকে তারা সংগঠিত করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে কসবা এলাকায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট সিরাজুল হক এমএনএ, অধ্যাপক খোরেশদ আলম, সৈয়দ এ কে এম ইমদাদুল বারী এমপিএ, থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল জব্বার, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু আবদুল্লাহ গেদু মিয়া, যুগ্ম-সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুর রহমান ছোট্ট মিয়া, আবদুল ওয়াহাব, কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদির, সৈয়দ রেজাউর রহমান, মমতাজ বেগম, ছাত্রনেতা আবদুল কাইয়ুম, মোজাম্মেল হক প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবা এলাকা ছিল ২নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ (পরে মেজর জেনারেল, বীর উত্তম, ১৯৭৫-এ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত)। তিনি তাঁর সেক্টরকে ছয়টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। এর মধ্যে কসবা-আখাউড়া-গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিন (পরে মেজর জেনারেল, বীর প্রতীক, পিএসসি)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক ও লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির। এ এলাকায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি এবং ইপিআর-এর দুটি কোম্পানি ছিল। তাঁদের সঙ্গে মর্টারেরও একটি দল ছিল। এই সাব-সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লার মুরাদনগর পর্যন্ত অপারেশন চালাত। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মিত- অনিয়মিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা সৈনিকদের নিয়ে অক্টোবর মাসে নবম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়।
মন্দভাগ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এইচ এম এ গাফফার (পরে লে. কর্নেল, বীর উত্তম)। তাঁর অধীনে চতুর্থ বেঙ্গলের ‘সি’ বা চার্লি কোম্পানি এবং মর্টারের একটি দল ছিল। এই সাব-সেক্টর বাহিনী কসবা থানার মন্দভাগ। রেলস্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত অপারেশন চালাত। এছাড়া সালদা নদী কোনাবন সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার। তাঁর কমান্ডে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ১৪শ। এর মধ্যে ৮শর মতো ছিল ব্যাটালিয়ন সৈন্য, আর ৬শ ছিল সাব-সেক্টরের ট্রুপ্স। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, – পুলিশ এবং যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকরা ছিলেন ব্যাটালিয়নের অন্তর্ভুক্ত। আর সেক্টর ট্রুপসের মধ্যে ছিল ছাত্র- যুবক ও কৃষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের যুদ্ধোপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। তাঁরা এফএফ বা ফ্রিডম ফাইটার, বিএফ বা ভিত্তিফৌজ এবং এমএফ বা মুক্তিফৌজ বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা ছিলেন দেশের কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দেন।
ক্যাপ্টেন গাফফারের ব্যাটালিয়নে চারটি কোম্পানি ছিল। এর মধ্যে ‘এ’ বা আলফা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার গোলাম আম্বিয়া। ‘বি’ বা ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার ফরিদ। ‘সি’ বা চার্লি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার আবদুল ওহাব, বীর বিক্রম এবং ‘ডি’ বা ডেলটা न কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার তাহের। ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন লেফটেন্যান্ট কবির (পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাপ্টেন কবির), আর মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট আখতার (পরবর্তীতে মেজর)। উক্ত ব্যাটালিয়নে দুটি মর্টার প্লাটুন ছিল। এর একটির কমান্ডার – ছিলেন সুবেদার জব্বার এবং অন্যটির কমান্ডার ছিলেন 1 সুবেদার মঈন, বীর উত্তম (সালদা নদী-মন্দভাগ এলাকার যুদ্ধে শহীদ)। সুবেদার জহির ছিলেন সিগন্যাল প্লাটুন কমান্ডার। আর টুআইসি ছিলেন ক্যাপ্টেন কবির। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্সে তিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখাশুনা করতেন। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব পরিচালনা করতেন ক্যাপ্টেন গাফফার। তাঁর অধীনে বিভিন্ন ট্রুপ্স এবং প্লাটুনের দায়িত্ব পালন করেন ফ্লাইট লে. কামাল, সুবেদার পাটোয়ারী, সুবেদার শহীদ, সুবেদার সিরাজ, সুবেদার বেলায়েত, সুবেদার মুনির প্রমুখ। কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার মনসুর।
কসবা থেকে মন্দভাগ রেলস্টেশনের উত্তর পাশ পর্যন্ত আলফা কোম্পানির দায়িত্বে ছিল। ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্বে ছিল মন্দভাগ রেলস্টেশন এলাকা। মন্দভাগ রেলস্টেশনের পর থেকে সালদা নদীর মাঝামাঝি পর্যন্ত, অর্থাৎ রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে ছিল চার্লি কোম্পানি। চার্লি কোম্পানির এলাকা বাদ দিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ এবং সালদা নদী এলাকা (সালদা নদী রেলস্টেশন এলাকাসহ) ছিল ডেলটা কোম্পানির দায়িত্বে। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স ছিল কোনাবনে। সালদা নদী সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ক্যাপ্টেন এইচ এম এ গাফফারের পাশাপাশি মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি এবং ইপিআর-এর একটি কোম্পানি ছিল। তিনি সালদা নদী, নয়নপুর এবং কুমিল্লার বুড়িচং পর্যন্ত অপারেশন চালাতেন। গণবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যও তাঁর কমান্ডে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন ২নং সেক্টরের অধীনে ৩নং সাব-সেক্টর কমান্ডার।
২নং সেক্টরের মোট ছয়টি সাব-সেক্টরের মধ্যে অন্য তিনটি সাব-সেক্টর কুমিল্লা, কোম্পানিগঞ্জ, চাঁদপুর, লাকসাম, ফেনী, বেলোনিয়া, নোয়াখালী প্রভৃতি এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ২নং সেক্টরের অধীনে প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা এবং ৬ হাজার নিয়মিত সদস্য ছিল।
মেজর খালেদ মোশাররফ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ২নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর কমান্ডে ‘কে’ ফোর্স গঠনের পর ২নং সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন মেজর মতিন। মেজর খালেদের নামানুসারেই ‘কে’ ফোর্স-এর নামকরণ করা হয়। ২২শে অক্টোবর কসবা সদর মুক্ত করার যুদ্ধে মেজর খালেদ মোশাররফ গুরুতররূপে আহত হলে ‘কে’ ফোর্সের কম্যান্ডিং দায়িত্ব পালন করেন মেজর সালেক। এ-সময় মেজর মতিনও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ২নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর হায়দারের ওপর। ‘কে’ ফোর্সের দশম বেঙ্গল কমান্ড করেন মেজর জাফর ইমাম। নবম বেঙ্গল কমান্ড করেন মেজর মোহাম্মদ আইনউদ্দিন। চতুর্থ বেঙ্গল কমান্ড করেন মেজর গাফফার। এ-সময় বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারগণকে অনারারি মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চল আখাউড়া এবং কসবা থানার নয়নপুরে ইপিআর-এর দুটি কোম্পানি ছিল। এই কোম্পানি দুটির বাঙালি সৈনিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। আখাউড়ায় ছিল কোম্পানির হেডকোয়াটার্স। ঢাকায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার খবর ২৬শে মার্চ সকালের মধ্যেই আখাউড়া এবং কসবায় অবস্থানরত ইপিআর ক্যাম্পগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সিদ্ধান্ত নেন। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরাও প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কসবা এলাকায় তখন শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কসবার উত্তরে আখাউড়া থেকে দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া ও মুরাদনগর পর্যন্ত বিশাল এলাকা তখন হানাদারমুক্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ-সময় কসবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ও ট্রেনিং সেন্টার গড়ে ওঠে। ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত কসবা এলাকা হানাদারমুক্ত ছিল।
১৪ই এপ্রিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সড়কপথে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে কসবা থানার কুটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কুটি থেকে তারা কসবা সদরের দিকে অগ্রসর হয়। এ-সময় কসবা থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে একদল ছাত্র-জনতা থানা থেকে কিছু রাইফেল ও গুলি সংগ্রহ করে কুটি-কসবা সড়কের পাশে একটি মাঠে অবস্থান নেয়। কসবার পুরান বাজার এলাকায় অন্য একটি অবস্থানে কয়েকজন আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ সদস্য ছিলেন। কুটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি শাহপুরে মুসলিম লীগ নেতা টি আলীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছার পর আর অগ্রসর হতে পারেনি। কারণ এলাকার ছাত্র-জনতা এখানে রাস্তা কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী তখন পায়ে হেঁটে সামনের দিকে অগ্রসর হয় আর দুপাশের বাড়িঘরে আগুন লাগায়। আড়াইবাড়ি অতিক্রম করার সময় আবদুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে মাঠে অবস্থানরত ছাত্র-জনতা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীও দ্রুত পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। তাদের ভারী অস্ত্র আর মেশিনগানের গোলায় চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সারা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িঘর ছেড়ে সাধারণ লোকজন পালাতে থাকে। চারদিকে ভয়ার্ত মানুষের ঢল, আর্তচিৎকার আর হাহাকার। বাড়িঘর ছেড়ে প্রায় সকলেই পূর্বদিকে সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়। সেদিন দুপুর থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার গুলি বিনিময় হয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্র-জনতা পিছু হটে আখাউড়া-কুমিল্লা রেল লাইনের পূর্ব পাশে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী টি আলীর বাড়িতে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে।
১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কসবায় প্রবেশ করে এবং ১৫ই এপ্রিলের মধ্যে সমগ্র কসবা এলাকা দখল করে নেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে তারা কসবার কুটি, শাহপুরের টি আলীর বাড়ি, কসবা সদর, মন্দভাগ, ইমামবাড়ি, রেলস্টেশন, সালদা প্রভৃতি এলাকায় শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেয়। কসবা দখলের সময় তারা বাড়িঘর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। কাউকে-কাউকে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়। বাড়িঘর ছেড়ে এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়। পর্যায়ক্রমে এখানে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি- গঠিত হয়। রাজাকাররা হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যায় সহযোগিতা করে। তবে মে মাসের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন।
১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত কসবা উপজেলা ও তার আশপাশ এলাকা হানাদারমুক্ত ছিল। এ-সময় জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিডিপি, মুসলিম লীগ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নীরব ভূমিকা পালন করে। ১৪ই এপ্রিল কসবা এলাকা পতনের পরই তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। কসবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুলুক হোসেনকে আহ্বায়ক করে কসবা থানা শান্তি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা ছিল— তফাজ্জল আলী ওরফে টি আলী (শাহপুর; মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, পাকিস্তানের সাবেক রাজস্ব ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল), হাফেজ আবদুল আহাদ (চেয়ারম্যান, খাড়েরা শান্তি কমিটি), শামসুল হক ভূঁইয়া (রানীয়ারা; চেয়ারম্যান, কুটি শান্তি কমিটি), তবদিল হোসেন (চেয়ারম্যান, কাইয়ুমপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি, পরে নিহত), আবদুল লতিফ মোল্লা (কসবা শান্তি কমিটির সদস্য), ফজলুল হক মুন্সি (কুটি শান্তি কমিটির সদস্য), আবুল হোসেন ভেন্ডার (মনকসাই শান্তি কমিটির সদস্য), শিরো কাজী (চাপিয়া শান্তি কমিটির সদস্য), ডা. আবদুল করিম (নেমতাবাদ শান্তি কমিটির সদস্য), আবদুল মালেক মেম্বার (বিশারাবাড়ি শান্তি কমিটির সদস্য), মফিজউদ্দিন (কৈখলা; বায়েক শান্তি কমিটির সদস্য), শামসু মিয়া মেম্বার (খিদিরপুর শান্তি কমিটির সদস্য), লীল মিয়া মেম্বার (আকসিনা), নূরুল ইসলাম মেম্বার (আকসিনা), নূর মোহাম্মদ পাঠান বিহারি (বায়েক, কসবা; পাকিস্তানি বাহিনীর ইনফরমার), ফটিক মিয়া (কুটি শান্তি কমিটির সদস্য), আবুল হোসেন (চেয়ারম্যার, মনকসাই), মাওলানা গোলাম হাক্কানী (অধ্যক্ষ, আড়াইবাড়ি দাখিল মাদ্রাসা), মুজিবুর রহমান (আলবদর- ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সদস্য; একাত্তরে ময়মনসিংহ শহরে কর্মরত ছিল, পরবর্তীতে কসবা জামায়াতে ইসলামীর আমীর), তোতা মিয়া ভূঁইয়া (কৈখলা; বায়েক ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান), আলী আশরাফ মেম্বার (গৌরাঙ্গলা), আবুল হাশেম মেম্বার (আড়াইবাড়ি), আবুল খায়ের (আড়াইবাড়ি), জহিরুল হক চেয়ারম্যান (সৈয়দবাদ), সহিদ মিয়া (আড়াইবাড়ি; কুখ্যাত রাজাকার, পরে নিহত), সিদ্দিক মাস্টার (আড়াইবাড়ি; কুখ্যাত রাজাকার, পরে নিহত), মুসিদুর রহমান সুন মিয়া (কুটি), মনু মেম্বার (কুটি), গাজি মিয়া হাজি (কুটি), আবদুল গনি (কুটি), আবদুল কুদ্দুছ (কুটি), সুরুজ মিয়া (কামালপুর, পরে নিহত), লতিফ মোল্লা (মীরতলা; চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), নূর ইসলাম মেম্বার (আকসিনা), মালেক বেপারী (বিশারাবাড়ি), আলী আরশাদ (কাইয়ুমপুর, কুখ্যাত রাজাকার), শফিক মিয়া (আড়াইবাড়ি, রাজাকার), বজলুর রহমান মাস্টার (চন্দ্রপুর), আসিফ ভূঁইয়া, (চন্দ্রপুর), লিলু ভূঁইয়া (চন্দ্রপুর), আবদুর রব (নেমতাবাদ, বিনাউটি; রাজাকার), সেলিম মিয়া (নেমতাবাদ, বিনাউটি; রাজাকার), আইয়ুব আলী (হাজিপুর, বিনাউটি) প্রমুখ।
শান্তি কমিটির সহযোগিতায় গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। এর সদস্যরা ছিল- সিদ্দিকুর রহমান মাস্টার (আড়াইবাড়ি; কসবা থানা রাজাকার কমান্ডার, ‘রাজাকার ব্রিগেডিয়ার’ নামে কুখ্যাত), সহিদ মিয়া (আড়াইবাড়ি, রাজাকার কমান্ডার), ইদ্রিছ মিয়া (বিশারাবাড়ি, রাজাকার কমান্ডার), আলেফ খাঁ (আড়াইবাড়ি), আবদুল মতিন (গজারিয়া), মোহাম্মদ আলী (গজারিয়া), আবদুল মন্নাফ (আড়াইবাড়ি), আবদুর রউফ (আড়াইবাড়ি), আবদুল মালেক (দেউশ, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিলা; ১৯৭১ সালে কসবায় কর্মরত), শহীদুল ইসলাম (তালতলা), আবদুল মজিদ (আড়াইবাড়ি), আবদুল জব্বার (কুটি), বাদশা মিয়া (ধর্মপুর), গোলাম জিলানী (কসবা সদর), নূরুল ইসলাম (আড়াইবাড়ি), ফরিদ মিয়া (কসবা সদর), আবদুর রাজ্জাক (তেতৈয়া), শামসু মিয়া মেম্বার (খিদিরপুর), কালন মিয়া (খাড়েরা), আলী আহম্মদ (কাইয়ুমপুর), নান্নু মিয়া (মাইজখার), ডাবু মেম্বার (চন্দ্রপুর), লাল চান (সৈয়দাবাদ, কুখ্যাত রাজাকার, পরে নিহত), আলী আজম (চৌবেপুর), তারু মিয়া চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া; কুটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গান গাইত), নান্নু মিয়া (চৌবেপুর), রফিকুল ইসলাম (জাজিয়ারা, পরে নিহত), আলী আহম্মদ (মাইজখার), মজিদ মিয়া (মেহারী), মঞ্জু মিয়া (কুটি), আবদুস সোবহান (কুটি), পিয়াল মোল্লা (জাজিয়ারা), শামসু মিয়া (মনকসাই), সহিদ মিয়া (মনকসাই), ইদ্রিছ মিয়া (মনকসাই), আবদুল মালেক (নোয়াগাঁও), মো. ইদ্রিছ (বিশারাবাড়ি), আবু তাহের সরকার (নয়নপুর), ফজলুর রহমান গাজি (নয়নপুর), হানিফ ভূঁইয়া (অষ্টজঙ্গল), জহর মিয়া (তালতলা), জয়নাল আবেদীন (বিশারাবাড়ি), আবদুর রহমান (বিশারাবাড়ি), সুরুজ মিয়া ভূঁইয়া (নয়নপুর), সরু মিয়া (কুটি), ওয়ালী মিয়া (কুটি), মতিউর রহমান ডিলার (বিষ্ণুপুর), আবদুল মজিদ চৌধুরী (উত্তর লেশিয়ারা), জয়নাল হোসেন মোল্লা (লেশিয়ারা), আবদুল বারী চৌধুরী (লেশিয়ারা), নূরু মিয়া (পূর্ব লেশিয়ারা), চানু মিয়া (লেশিয়ারা), আবদুর রশীদ (পূর্ব লেশিয়ারা), আবু মিয়া (পূর্ব লেশিয়ারা), আলী বক্শ (পূর্ব লেশিয়ারা), আবদুর রাজ্জাক (কুটি), ফারুক আহমদ চৌধুরী বিহারি (রাজাকার কমান্ডার), ইকবাল খান (অবাঙালি রাজাকার কমান্ডার), রেজাউল করিম (শ্যামবাড়ি; আলবদর, কুমিল্লা মাদ্রাসার ছাত্র), আবদুল করিম (নেমতাবাদ, বিনাউটি; আলবদর), আবদুল মালেক (বিশারাবাড়ি), আবদুল মালেক (নোয়াগ্রাম), হরিদাশ (মন্দবাগ, কাইয়ুমপুর) প্রমুখ।
মে মাসের মধ্যে কসবার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটির শাখা গঠন করা হয়। এর সদস্যরা যুদ্ধের নয় মাস ধরে কসবার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারীনির্যাতন প্রভৃতি জঘন্যতম কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করে। তাদের সহায়তায় গ্রামে-গ্রামে গড়ে ওঠে রাজাকার, আলবদর ও -আলশামস বাহিনী। এসব বাহিনীর অত্যাচার ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পাকিস্তানি বাহিনীকেও হার মানায়। আলবদর ও আলশামস বাহিনী ছিল জামায়াত ও মুসলিম লীগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ সন্ত্রাসী দল। আর রাজাকার বাহিনী সরাসরি শান্তি কমিটির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।
কসবা থানার বিভিন্ন গ্রামে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে খবর সরবরাহ করত। এসব খবরের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ চালাত। মন্দভাগের রাজাকার তকদিল হোসেন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নারী সরবরাহ করত। কাইয়ুমপুরের রাজাকার আলী আরশাদ, আড়াইবাড়ির সিদ্দিক মাস্টার, সফিক মিয়া, আবদুল মজিদ বিভিন্ন গ্রামে লুটতরাজ করে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা ডাক্তার করিম ও মুসলিম লীগের নেতা জহিরুল হক এলাকায় লোকজনদের ওপর অত্যাচার করে। রাজাকার সিদ্দিক মিয়া ও সহিদ মিয়া চরম অত্যাচারী ছিল। এলাকায় তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এলাকার হিন্দু বাড়িগুলো লুট করে নিয়ে তারা বিক্রি করে দেয় এবং বহু লোককে হত্যা করে।
কসবা দখলের পর ১৫ই এপ্রিল থেকেই পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে সহযোগিতা করে। কসবা থানার উত্তর-পূর্ব দিকে আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি নিভৃত দুটি পল্লিগ্রাম চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ। এখানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা এখানে দিনের পর দিন নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
২১শে মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বায়েক গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ-সময় যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে সেদিন ঘটনাস্থলেই ৭০ জন শহীদ এবং ২৭ জন আহত হন। এ ঘটনা বায়েক গ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিত।
সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে তখন বহুলোক এদিক দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। জুন মাসের শেষদিকে একদিন ভৈরব ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক নারী-পুরুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসে চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ গ্রামে পৌঁছায়। তখন রাত হয়ে যাওয়ায় এবং এলাকাটি শত্রুমুক্ত থাকায় স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে তারা গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। পরদিন ২২শে জুন সকালে ভারতে যাবার পথে রাজাকাররা তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে অনেকে আহত হয়। রাজাকাররা ২৫ জনকে বন্দি করে কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে কয়েক দিন বন্দি রাখার পর তাদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। হানাদাররা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত কসবার পূর্বাঞ্চলে চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ এলাকাটি ছিল মুক্তাঞ্চল। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষ স্থল ও জলপথে এসে চণ্ডীদ্বার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিত এবং এখান থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরায় যেত। এদিক দিয়ে তিনটি জলপথ ছিল। সেগুলো হলো, তিনলাখপির-মনিয়ন্দ, তিনলাখপির-নেমতাবাদ ও ব্রাহ্মণগাঁও-রাউথহাট। এসব জলপথে রাজাকাররা পাহারা দিত। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শরণার্থীরা ভারতের ত্রিপুরায় যাবার চেষ্টা করত। যাওয়ার সময় অনেকে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ত। শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু নর-নারী ও শিশু। রাজাকাররা তাদের টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিত এবং যুবতী নারীদের আটক করে নারীনির্যাতন ক্যাম্পে সরবরাহ করত।
জুন মাসের শেষদিকে একদিন নবীনগর, রামচন্দ্রপুর ও নরসিংদীর শতাধিক নারী-পুরুষ ভারতের আগরতলায় যাবার পথে কসবা থানার শিমরাইল গ্রামের দুর্গাচরণের বাড়ি এবং চণ্ডীদ্বার গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। নৌকাযোগে বাদৈর হাতনির বিল দিয়ে অগ্রসর হয়ে তারা সিনাই নদীর তীরে এসে নামে। আগের দিন বিকেলেও একদল লোক এসে গ্রামের একটি স্কুলে আশ্রয় নেয়। তখন আবহাওয়া ভালো ছিল না। শরণার্থীরা খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং উদ্বিগ্ন। ছোট শিশুদের কান্না আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় সকলেই অস্থির। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কেউ-কেউ রওনা দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। কেউ-কেউ রওনা দিয়েছে। এরই মধ্যে টি আলীর বাড়িতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে শরণার্থীদের খবর পৌঁছে যায়। স্থানীয় রাজাকাররা রাতেই এ খবর পৌঁছে দেয়। সকালের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা অতর্কিতে এসে শরণার্থীদের ওপর হামলা করে। প্রথমে তারা টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুট করে। তারপর শুরু করে বেয়নেট চার্জ। নারীদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। প্রাণে বাঁচার জন্য সকলে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। চতুর্দিকে হাহাকার আর নারী- -পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ে। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষও প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছাড়ে। গুলির শব্দে সারা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এলাকাটি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য একটি দল একই সময় চাপিয়া ও চন্দ্রপুর গ্রাম আক্রমণ করে। সেখানে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর আক্রমণ করে চণ্ডীদ্বার গ্রামে আশ্রিত শরণার্থীদের ওপর। বিমল নামের একজনের দলে ৭২ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল। লতুয়ামুড়ায় তারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং গ্রামের পাশেই হত্যার শিকার হয়। চণ্ডীদ্বার স্কুলে তখনো কিছু শরণার্থী ছিল। তারা দরজা-জানালা লাগিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী ঘরের দরজা ভেঙে টেনে-হিঁচড়ে বের করে বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে তাদের সকলকে হত্যা করে। চণ্ডীদ্বার বাজার ও সিনাই নদীর তীরে শতশত লাশ ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনা চণ্ডীদ্বার গণহত্যা- নামে পরিচিত।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল সিনাই নদী অতিক্রম করার সময় যাকে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। হরিয়াবহের কুতুব মিয়ার বাড়ি থেকে দেবগ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব তিনজন মহিলা সিনাই নদী সাঁতরিয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা পর্যায়ক্রমে তাদের ধর্ষণ করে। চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস জঘন্যতম নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। চণ্ডীদ্বার বাজারের উত্তর পাশে একটি মঠ ছিল। এর আশপাশে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ হত্যা করা হয়। তাদের সকলেই ছিল শরণার্থী। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে এখানে তাদের হত্যা করা হয়। পাঁচ মাসে এখানে পাঁচ শতাধিক নর-নারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ গ্রামের মাটি খুঁড়লে মানুষের কংকাল বেরিয়ে আসে। একটি পুকুর খননের সময় এখানে অসংখ্য নরমুণ্ডু ও কংকাল পাওয়া যায়। এ দুটি গ্রাম একটি গণকবরে পরিণত হয়েছিল। পুরো এলাকাটাই যেন একটি বধ্যভূমি। হরিয়াবহের খুরশিদ মিয়ার বাড়ির চৌকির নিচে বাচ্চাসহ লুকিয়ে থাকা এক মহিলাকে চুল ধরে টেনে বের করে রাজাকাররা ধর্ষণ করে। তার কোলের বাচ্চাটিকে মাটিতে আছড়ে মায়ের সামনে হত্যা করা হয়। গণধর্ষণের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উক্ত মহিলাও ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
হরিয়াবহের শফিক মিয়া ও ইউনুছ খাঁর বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। এদুটি ক্যাম্পে প্রতিদিনই নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। রাজাকাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে ক্যাম্পে আটকে রাখত এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও বাংকারে তাদের সরবরাহ করত। ইউনুছ খাঁর বাড়ির দক্ষিণ ভিটায় একটি কুঁড়েঘর ছিল। রাজাকাররা এখানে নারীদের আটক রেখে নির্যাতন করত। এ ঘরের মাটির দেয়ালগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়েছিল। ইউসুফ খাঁর বাড়ির উত্তর পাশে একটি বিশাল গর্ত ছিল। রাজাকারদের হাতে নিহত অসংখ্য নারী- পুরুষ ও শিশুর লাশ এ গর্তে ফেলা হয়েছিল। প্রতিদিন এখানে নতুন-নতুন লাশ পড়ত।
রাজাকার কমান্ডার ইকবাল খানের নেতৃত্বে রাজাকাররা নরসিংদীর একটি হিন্দু পরিবারকে নৌকা থেকে ধরে এনে তিনজনকে হত্যা করে এবং একজন মহিলাকে চণ্ডীদ্বার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর চণ্ডীদ্বার মসজিদের পাশে একটি দোকানে নিয়ে তাকে তারা উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। এ মহিলাকে তিনদিন পর্যন্ত সেখানে আটক রেখে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করা হয়। উপর্যুপরি ধর্ষণের ফলে মহিলার মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাজাকাররা ছিল আকসিনা, শাহপুর, বকাবাড়ি ও আড়াইবাড়ি গ্রামের।
জুলাই মাস থেকে চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করে। চণ্ডীদ্বার গোডাউন এবং ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে শতশত লোককে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তারা ছিল গ্রামের গরিব-অসহায় মানুষ। তারা মাসের পর মাস বন্দিশিবিরে নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের দিয়ে বাংকার তৈরি, গুলির বাক্স বহন, গাছকাটা ও নিহতদের মাটিচাপা দেয়ার কাজ করানো হতো।
চণ্ডীদ্বার ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে ভয়ানক চেহারার এক পাকিস্তানি অফিসার ছিল। বন্দি মহিলাদের দিয়ে সে গায়ে তেল মালিশ করাত। প্রকাশ্য দিবালোকে নারীদের ধর্ষণ করত। তার দেখাদেখি রাজাকাররাও অনুরূপ কাজ করত। প্রতিদিনই এখানে মানুষ খুন করা হতো।
হরিয়াবহের জুজু মিয়া গানপুরে ধরা পড়েন। নওগাঁর আবন মিয়া, মুক্তল হোসেন ও আলী হোসেন পূর্ব থেকে হরিয়াবহের সোনা মিয়া নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে বন্দি ছিল। আবন প্রচণ্ড ক্ষ্যাপা ও পাগলা প্রকৃতির মানুষ ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধা ভেবে পাকিস্তানিরা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে তাকে হত্যা করে। অন্য একজনের পা-দুটি গাছের সঙ্গে বেঁধে নিচের দিকে ঝুলিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুক্তল হোসেন ও আলী হোসেন দুজন সহোদর ভাই। তাদেরও হত্যা করে একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়। এরূপ ভয়াবহ অবস্থা দেখে লতুয়ামুড়া থেকে ধরে আনা ৭০-৭৫ জন নর-নারী ও শিশু আর্তচিৎকার শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর একজন অফিসারের নির্দেশে বিহারি রাজাকার কমান্ডার ইকবাল খান ও অন্য একজন সৈনিক তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ মানুষের আর্তচিৎকারে সেদিন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। জুজু মিয়া এই মৃত্যুকূপ থেকে বাঁধন ছিঁড়ে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে যান।
উপজেলার সদর (পশ্চিম) ইউনিয়নের আকসিনা গ্রামে ১৭ই মে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ১৩ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা আকসিনা গণহত্যা নামে পরিচিত।
হাজিপুর এলাকা দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের গ্রামের বহু লোককে ধরে নিয়ে যায়। হাজিপুর স্কুলের কাছে তাদের একত্রিত করে মুসলমানদের ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু রাউথহাট গ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের ১৪ জন লোককে আলাদা করে ১৪ই মে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা হাজিপুর গণহত্যা- নামে পরিচিত। ৮ই সেপ্টেম্বর সংঘটিত মান্দারপুর গণহত্যায় ৩৪ জন সাধারণ শহীদ হন এবং ৩০ জনকে জীবিত মাটিচাপা দেয়া হয়।
কসবার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির স্থাপন করেছিল। ঐসব নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরে মহিলাদের আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। পুরুষদের আটক করে নির্যাতনের পর কাউকে-কাউকে হত্যা করা হয় এবং অন্যদের ছেড়ে দেয়া হয়। যাদের বন্দি করে রাখা প্রয়োজন মনে করেছে, তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার কিংবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন নির্যাতন ভোগ করার পর তাদের অনেকেই হত্যার শিকার হয়। কোনো-কোনো ক্যাম্পে পুরুষদের আটক রেখে তাদের দিয়ে পরিখা কিংবা বাংকার খনন ও যুদ্ধক্ষেত্রে মালামাল পরিবহন করানো হয়, অবশেষে তারাও হত্যার শিকার হয়। কসবা থানার বিভিন্ন গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নারীনির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। টি আলীর বাড়িতে যে ক্যাম্প ছিল, সেখানে রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবতি মেয়েদের ধরে এনে পাকসেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য সরবরাহ করত। যেসব মহিলা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পায়, তাদের অনেকে আত্মগোপন করে অন্যত্র চলে যায়। আর যারা অসহায় ছিল, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। অনেককে ঢাকায় নিয়ে বীরাঙ্গনা হিসেবে সাহায্য দেয়া হয়। অনেককে বিয়ে ও চাকরি দেয়া হয়।
মাইজখার গ্রামে নারীনির্যাতনের ক্যাম্প ছিল। মাইজখার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতাধিক মহিলাকে আটক রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়। কামালপুর, মইনপুর, গোবিন্দপুর, কাইয়ুমপুর প্রভৃতি গ্রামের ১৭ জন মহিলা এখানে আটক ছিল। রাজাকার নান্নু মিয়া ও আলী আহাম্মদ (মাইজখার) বিভিন্ন গ্রাম থেকে মহিলাদের ধরে এনে এ ক্যাম্পে সরবরাহ করে। মুক্তিপণের বিনিময়ে কোনো- কোনো মহিলাকে ছেড়ে দেয়। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে, পিতার কাছ থেকে মেয়েকে, ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে তারা ছিনিয়ে আনে। এখানে আটক শতাধিক মহিলার মধ্যে ১৭ জন ছিল স্থানীয়। অন্যরা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার।
কসবা এলাকায় ১৫টি নারীনির্যাতন ক্যাম্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো— টি আলীর বাড়ি, কাইয়ুমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাইজখার প্রাথমিক বিদ্যালয়, চণ্ডীদ্বার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কামালমুড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারগাছ উচ্চ বিদ্যালয়, চণ্ডীদ্বারের শফিক মিয়ার বাড়ি, হরিয়াবহের ইউনুছ খাঁর বাড়ি, ইমামবাড়ি রেলস্টেশন, সৈয়দাবাদ মোড় (বাসস্ট্যান্ড), সালদা রেলস্টেশন, অনন্তপুর, চকচন্দ্রপুর ও কুটি বাজার। এছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও বাংকারে নারীনির্যাতন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক মহিলা এসব স্থানে বন্দি ছিল। কসবা শত্রুমুক্ত হবার পর টি আলীর বাড়ি থেকে দেড়শ মহিলাকে উদ্ধার করা হয়। কসবায় নারীনির্যাতনের মূল নায়ক ছিল আড়াইবাড়ির রাজাকার কমান্ডার সিদ্দিক মিয়া।
কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের কোল্লাপাথরে ৪৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরে ১৩ জন ও খিরনালে ২৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়। কুল্লাপাথরে অজ্ঞাতপরিচয় আরো তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়। কসবার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা থেকে দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পর্যন্ত বিশাল এলাকা ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শরণার্থীরা এদিক দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে হত্যার শিকার হয়। দীর্ঘ প্রায় নয় মাসে কসবার বিভিন্ন গ্রামে হাজার-হাজার শরণার্থী নিহত হয়। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও হত্যার শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক হত্যার শিকার হয় গোপীনাথপুর ইউনিয়নের চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ গ্রামে। এ উপজেলার হরিয়াবহ বধ্যভূমি – ও শাহপুর পাকবাহিনী ক্যাম্প বধ্যভূমি- উল্লেখযোগ্য।
উপজেলার সালদা, মন্দভাগ, কুটি, চরনাল, ইয়াকুবপুর, লতুয়ামুড়া, কাইয়ুমপুর, নয়নপুর, কাশিমপুর, নোয়াগাঁও, কল্যাণসাগর, গোসাইল, চন্দ্রপুর প্রভৃতি এলাকায় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনী কসবা থানার বিভিন্ন অবস্থানে সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীও তাদের ওপর আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২২শে মে মুজাহিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হকের নেতৃত্বে একটি গেরিলা দল সালদা নদী এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। গেরিলা দলটি আক্রমণের পরপরই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। একই এলাকায় ২৫শে মে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি সেনাদের একজন জেসিও এবং পাঁচজন সৈনিক নিহত হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সালদা নদীর অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য কুটি থেকে আরো সৈন্য পাঠায়। ২৭শে মে সকাল ৭টার দিকে তারা মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে এবং ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। তাদের দুটি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী সামনে অগ্রসর হতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২৬শে মে রাতে সুবেদার ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি সেকশন রকেট লাঞ্চার নিয়ে সালদা নদী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এতে শত্রুদের দুটি বাংকার ধ্বংস হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে কভারিং ফায়ার করে মুক্তিযোদ্ধারা সরে আসতে সক্ষম হন। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন অফিসারসহ ৯ জন সৈনিক নিহত হয়। ২৭শে মে মন্দভাগ সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল এগিয়ে এসে কুটি এলাকায় সিএন্ডবি রাস্তার ওপর পাকিস্তান বাহিনীর গাড়ি আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯ জন নিহত হয় এবং কয়েকটি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ২ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দি করে। ২৯শে মে ভোর ৪টার দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি সালদা নদী শত্রুঘাঁটির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। শত্রুরা পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৭ জন হতাহত হয়। তাদের কয়েকটা বাংকার ধ্বংস হয়ে যায়। ভোর ৫টা পর্যন্ত এ আক্রমণ চলে। মুক্তিবাহিনী কভারিং ফায়ার করে স্থান ত্যাগ করে। ৩১শে মে মুক্তিবাহিনীর একটি পেট্রোল পার্টি কুটির নিকট শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধানে যায়। তাঁরা দেখতে পান যে, পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ ৬ জন সৈনিকসহ কুটি গ্রামে প্রবেশ করছে। জিপটি গ্রামের পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা জিপ থেকে নেমে গ্রামের ভেতরে যায়। মুক্তিবাহিনীর ছোট দলটি বোমা ছুড়ে ড্রাইভারসহ জিপটি ধ্বংস করে দেয়। একই দিন সুবেদার আবদুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সালদা নদী রেলস্টেশন এলাকায় শত্রুবাহিনীর অবস্থান অনুসন্ধানে যায়। এ-সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন সৈনিক গাছের ওপর বসে দূরবীণ লাগিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান খুঁজছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আড়াল থেকে তাদের দেখতে পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করে তাদের হত্যা করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা নদী ঘাঁটিটি প্রায় তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলেন এবং প্রতিদিন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে বাংকার থেকে মাথা তোলার সুযোগ ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কুটি ও সালদা নদীর রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা এম্বুশ পেতে থাকতেন। এর ফলে পাকিস্তানিদের পক্ষে রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কসবা-আখাউড়া রেললাইন ব্যবহারের চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ৬ই জুন পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি কোম্পানি কুমিল্লা থেকে সালদা নদীর দিকে এগিয়ে আসে। রেললাইন ধরে তারা নয়নপুর স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছায়। সকাল ৬টার দিকে সালদা নদীর পূর্ব দিক থেকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিন্টের এ কোম্পানি তাদের ওপর আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ জন হতাহত হয়। এরপর তারা পিছু হটে। একই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য একটি দল ট্রেনে করে সালদা নদীর দিকে এগিয়ে এলে নয়নপুরের দক্ষিণে তারা মুক্তিবাহিনীর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে তারা রাজাপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এর ৪-৫ ঘণ্টা পর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে তারা নয়নপুর পৌঁছতে সক্ষম হয়। নয়নপুর স্টেশনে এসে তারা যখন বাংকার খনন করছিল, তখন মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান থেকে তাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে তারা কিছুটা পিছু হটে নয়নপুর গ্রামের ভেতরে বাংকার খনন করে অবস্থান নেয়। ঐদিনই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি পেট্রোল পার্টি কসবার দিকে অগ্রসর হলে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন তাদের ওপর এম্বুশ করে। এম্বুশে পাকিস্তানি বাহিনীর ২০ জন হতাহত হয়। এরপর ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা আড়াইবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়।
১১ই জুন সকাল ৬টার দিকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির একটি প্লাটুন কসবা থানার চারনাল নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে শত্রুবাহিনীর একটি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর গোলার আওতায় পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। এ আক্রমণে শত্রুবাহিনীর ১২ জন সৈনিক নিহত হয়। এ অপারেশনে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে পরে মারা যান। পাকিস্তানি সেনারা পর্যুদস্ত হয়ে ঐ স্থান ছেড়ে ইয়াকুবপুরের দিকে পলায়ন করে। পালানোর সময় ইয়াকুবপুর গ্রামের পাশে তারা মুক্তিবাহিনীর অন্য একটি এম্বুশ পার্টির কবলে পড়ে। এখানেও পাকিস্তানি বাহিনীর ৮ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। এ-দুটি এম্বুশে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে পাকিস্তানি বাহিনী সেদিনই ইয়াকুবপুর এলাকা ত্যাগ করে।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তীব্র চাপের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী কসবা থানার সালদা নদী অবস্থানটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় তাদের সালদা নদী অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা চালায়। তাদের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি মর্টার প্লাটুন সালদা নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। এ প্লাটুনটি রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানটি ঘুরে পেছনে যেতে সক্ষম হয়। সকাল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে পূর্বনির্ধারিত স্থানে তাঁরা নিজেদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। এরপর মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে অতি নিকট থেকে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থানের এত নিকট থেকে আক্রান্ত হবার কথা কল্পনা করতে পারেনি। তাই এ আক্রমণে তাদের একজন জেসিও-সহ ৩২ জন হতাহত হয়। তাদের একটি শক্তিশালী দল রাতে সালদা নদী অবস্থান থেকে কসবার টহলের জন্য গিয়েছিল। সকালে ফেরার পথে তারা মুক্তিবাহিনীর প্লাটুনটিকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এ অবস্থা টের পেয়ে মুক্তিবাহিনীর দলটি গুলি ছুড়তে-ছুড়তে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সালদা নদী অবস্থানটিকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলে।
কসবা উপজেলার একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হলো সৈয়দাবাদ যুদ্ধ, যা ১৯শে জুন সংঘটিত হয়। এতে বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কয়েকটি গাড়ি ও একটি ট্রাকে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
২২শে জুন রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল চন্দ্রপুর ও লতুয়ামোড়ার দিকে অগ্রসর হয়। এ সংবাদ পেয়ে ২নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. হুমায়ূন কবির তাদের এম্বুশ করার জন্য চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির তিনটি প্লাটুনকে ইয়াকুবপুর, কুইয়াপানিয়া ও খিরনাল এলাকায় পাঠিয়ে দেন। ২৩শে জুন সকালের মধ্যে তাঁরা নিজ-নিজ জায়গায় অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা সারারাত চলার পর সকালে মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে। ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে আসতেই তিনদিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রথম আক্রমণেই তাদের ৮ জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা কিছুটা পিছু হটে আবার আক্রমণ চালায়। দিনভর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। সন্ধ্যার দিকে পিছু হটে যাবার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ইয়াকুবপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে। সেখানেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়- ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। অতঃপর পিছু হটে তারা লতুয়ামোড়ার কাছে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করতে থাকে। পরদিন ২৪শে জুন পাকিস্তানি বাহিনী যখন প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করছিল, তখন চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি প্লাটুন পুনরায় তাদের ওপর আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯ জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন আহত হন। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করেও পাকিস্তানি বাহিনী লতুয়ামোড়ায় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। লে. হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীও তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে।
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সালদা নদী অবস্থান থেকে মন্দভাগ দখলের চেষ্টা চালায়। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তা পর্যন্ত এলাকায় শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এ অবস্থানটির কারণে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন চালু করতে পারছিল না। এছাড়া সালদা নদীর ছিটমহল এলাকায় ছিল মুক্তিবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি। এ ঘাঁটিটিও তারা দখল করতে পারছিল না মন্দভাগ এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক শক্তিশালী ঘাঁটির কারণে। বারবার চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়। মন্দভাগ দখলের লক্ষ্যে ২৪শে জুন বিকেল ৩টায় পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা নদী অবস্থান থেকে এক কোম্পানি এবং কসবার টি আলীর বাড়ি থেকে একটি কোম্পানি দুদিক থেকে এগিয়ে এসে কাইয়ুমপুরে একত্রিত হয়। এখান থেকে তারা কামান, মর্টার ও মেশিগানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর মন্দভাগ অবস্থানে আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড গোলাগুলি করে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী দলটি মন্দভাগ রেলস্টেশনের তিনশ গজের মধ্যে জেলা বোর্ড সড়কের কাছে পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী যোদ্ধারাও বাংকার থেকে প্রচণ্ডভাবে গোলা বর্ষণ করতে থাকেন। দীর্ঘ সময় চেষ্টার পরও পাকিস্তানি সেনারা যখন আর অগ্রসর হতে পারছিল না, তখন তারা পিছু হটে। এ আক্রমণের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ২৪ জন হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কাইয়ুমপুর অবস্থানও তুলে নিয়ে সালদা নদীর মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর টহলদল সাইদাবাদ থেকে কর্নেলবাজার পর্যন্ত যাতায়াত করত। এ খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল আখাউড়া থানার খোলাপাড়া এবং তুলাইশিমুল গ্রামের পাশে অবস্থান নেয়। ২৭শে জুন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহলদল খোলাপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৮ জন নিহত হয়। এর পরদিন ২৮শে জুন তুলাইশিমুল গ্রামের পাশে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে। এম্বুশ পার্টির গুলিতে জিপটি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রাস্তার নিচে পড়ে যায়। জিপে থাকা ৫ জন পাকিস্তানি সেনাও সঙ্গে-সঙ্গে নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দলটি পাকসেনাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।
২৮শে জুন পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এ ঘোষণা শোনার পর মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর হেডকোয়ার্টার্সে সাব-সেক্টর কমান্ডারদের এক জরুরি সভা আহ্বান করেন। সভায় যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, ইয়াহিয়ার ভাষণের সময় পাকিস্তানিরা যখন রেডিও শোনার জন্য নিজ-নিজ ক্যাম্পে একত্রিত হবে, তখন তাদের সর্তকতামূলক অবস্থান কিছুটা শিথিল হবে। এ সুযোগে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করতে হবে। এজন্য মেজর খালেদ মোশাররাফ সাব-সেক্টর কমান্ডারদের সন্ধ্যা সাড়ে ছটার পর যখন ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুরু হবে, ঠিক তখন সকল এলাকায় একযোগে সঙ্গে আক্রমণের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ অনুযায়ী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি তিনদিক থেকে নয়নপুর পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের দিকে সতর্কতার আগ্রসর হয়। ভাষণ শুরু হবার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করেন। অতর্কিত এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হতচকিত হয়ে যায়। দ্রুত বাংকারে অবস্থান নেয়ার জন্য তারা ছুটাছুটি এবং চিৎকার শুরু করে দেয়। এ-সময় মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগানের গোলায় অনেকেই নিহত হয়। আধঘণ্টা এভাবে গুলি চালাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অবস্থান পরিত্যাগ করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান। এ-যুদ্ধে ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বহু আহত হয়। একই সময়ে লে. হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল লতুয়ামোড়ায় শত্রুদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। এখানে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এরপর মুক্তিবাহিনী অক্ষত অবস্থায় নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ছিল। সেসব রেজিমেন্টে নিযুক্ত বাঙালিদের অনেককে ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানিরা হত্যা ও বন্দি করে। অনেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। কিন্তু তাঁদের কাছে কোনো কামান ছিল না। মেজর খালেদ মোশাররফ এসব সৈনিকদের নিয়ে একটি গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি ভারতের সেনা অধিনায়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানান। অনেক ছোটাছুটির পর তিনি কয়েকটি ৩.৭ ইঞ্চি ছোট কামান সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এ কামানগুলো সেকেলে হিসেবে পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু তবুও এগুলো পাবার পর নবগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীর মধ্যে নতুন সাড়া জাগে। পারদর্শী লোকের অভাব থাকায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং গণবাহিনী থেকে লোক ভর্তি করে তাঁদের ট্রেনিং দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন পাশা পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর লোক ছিলেন। রাতদিন খেটে তিনি নবগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত করে তোলেন। এ ব্যাপারে মেজর খালেদ মোশাররফও অনেক পরিশ্রম করেন। এভাবেই বাংলাদেশে প্রথম গোলন্দাজ বাহিনীর জন্ম হয়। জন্মের পর জুলাই মাস থেকে এ বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের পরিচয় দেয়।
পাকিস্তানি সেনাদের নিকট ছিল অত্যাধুনিক কামান। আর সেসব কামানের গোলা নিক্ষেপের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। সে তুলনায় মুক্তিবাহিনীর পুরাতন কামানগুলোর গোলা ক্ষেপণের ক্ষমতা ছিল পাকিস্তানিদের অর্ধেকের চেয়েও কম। মুক্তিবাহিনীর কামানগুলো নষ্ট করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী সব সময় সচেষ্ট ছিল। সেজন্য মুক্তিবাহিনীর কামনাগুলো বেশিক্ষণ এক স্থানে রাখা সম্ভব হতো না। অধিকাংশ সময় তাঁরা কামানগুলো মাথায় করে শত্রুবাহিনীর কাছাকাছি কোনো দুর্গম এলাকায় নিয়ে যেতেন এবং শত্রুর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতেন। এসব আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত। মুক্তিযোদের আক্রমণের কৌশল ছিল অনেকটা কমান্ডো ধরনের। ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতেই তাঁরা আক্রমণ পরিচালনা করতেন।
১২ই জুলাই কসবাস্থ সিএন্ডবি রাস্তার দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি পেট্রোল পার্টি অগ্রসর হয়। হানাদার বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এ পেট্রোলটি যখন কুটির নিকট দিয়ে টহল দিচ্ছিল, তখন দেখতে পায়, কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এসে কুটিতে সমবেত হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে তারা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে প্রায় এক ব্যাটালিয়নের মতো সৈন্যের একটি দল মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। অপর দুটি দলের একটি নয়নপুরের দিকে এবং অন্যটি লতুয়ামোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর পেট্রোলটি বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি সেনারা নয়নপুর, মন্দভাগ বাজার, লতুয়ামোড়া এবং টি আলীর বাড়িতে তাদের অবস্থানগুলো শক্তিশালী করার জন্য যাচ্ছে। মন্দভাগের দিকে অগ্রসরমাণ দলটি মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত এসে বাজারের আশপাশ এবং দোকানের ভেতরে বাংকার তৈরি করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী যাতে তাদের ওপর গোপনে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য তারা পাট এবং ধানক্ষেত কেটে পরিষ্কার করে ফেলে। এ সংবাদ পেয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগেই তাদের ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ক্যাপ্টেন গাফফারকে তিনি চতুর্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে মন্দভাগ বাজার আক্রমণের নির্দেশ দেন। ১২ই জুলাই বিকেলে ক্যাপ্টেন গাফফার গোলন্দাজ বাহিনীসহ তাঁর কোম্পানি নিয়ে মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হন। সন্ধ্যার পূর্বেই ছোট-ছোট কয়েকটি দল পাঠিয়ে তিনি শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে গোপন সংবাদ সংগ্রহ করেন। গোলন্দাজ বাহিনী নৌকাযোগে কামানগুলো নিয়ে গোপন পথে বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই ক্যাপ্টেন গাফফার শত্রুদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। প্রথমেই গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলো শত্রুদের অবস্থানের অতি নিকট থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে- সঙ্গে চতুর্থ বেঙ্গলের অস্ত্রগুলোও গর্জে ওঠে। ফলে শত্রুবাহিনীর বাংকার এবং বাজারের ঘরগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এত নিকট থেকে কামানের গোলার আক্রমণ হবে তা পাকিস্তানি সেনারা কল্পনা করতে পারেনি। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রথম আক্রমণেই পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৭০ জন সৈনিক হতাহত হয়। অল্পক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরোধ শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে এবং মন্দভাগ বাজার এলাকা ছেড়ে রাতের আঁধারেই তারা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বহু অস্ত্র ক্যাপ্টেন গাফফারের হস্তগত হয়।
১৩ই জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দল সালদা নদী এলাকায় এম্বুশ করে। দুপুর একটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি স্পিড বোট এ এম্বুশে পড়ে। এম্বুশ পার্টির গুলিতে স্পিড বোটটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এম্বুশ দলটি নিরাপদে মন্দভাগ অবস্থানে ফিরে যায়।
সালদা নদী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। এখান থেকে পাকিস্তানি সেনারা নয়নপুরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়। ১৭ই জুলাই তাদের একটি দল সালদা নদী রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক হাজার গজ দূরে মনোয়া ব্রিজের পাশে বাংকার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। এ-সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানি তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনারা সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাদের বহু লোক এখানে হতাহত হয় এবং তারা পুনরায় সালদা নদীতে পিছু হটে। কসবা থানার কাশিমপুর রেলসেতুর নিকট পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি প্লাটুন অবস্থান নিয়ে সেতুটি পাহারা দিচ্ছিল। ১৮ই জুলাই ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কাশিমপুর সেতুর দিকে রওনা হয়। রাত ৮টার দিকে তারা সেতুর নিকটবর্তী পাক অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ১৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। যারা বেঁচে ছিল তারা অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী সেতুটিতে বিস্ফোরক লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
১৯শে জুলাই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কসবা থানার মনোয়া রেল ব্রিজের দক্ষিণ পাশে অবস্থান নিয়ে বাংকার খোঁড়ার চেষ্টা করে। এবারও তারা মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং মর্টার, কামান ও মেশিনগানের গুলিতে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেতুটি ধ্বংস করে দেন। একই দিন হানাদার বাহিনীর ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি কুটি থেকে সালদা নদী দিয়ে মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হয়। এ সংবাদ পেয়ে নায়েব সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেয়ার জন্য এগিয়ে যায়। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগ বাজারের নিকট পৌঁছে অতর্কিতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাদের অন্তত ৬০ জন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা নদীতে ঝাঁপ দেয়া শুরু করলে অধিকাংশই জলে ডুবে মারা যায়। নিহত পাকিস্তানিদের মধ্যে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ুম, ৫৩তম গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন বোখারী এবং কয়েকজন সিনিয়র অফিসারসহ বেশকিছু জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ছিল। ২৫শে মার্চের পর কুমিল্লা শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল ক্যাপ্টেন বোখারী।
২১শে জুলাই সন্ধ্যার পর চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানির একটি প্লাটুন সালদা নদী এলাকায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে আক্রমণ করেই মুক্তিবাহিনীর দলটি স্থান ত্যাগ করে।
মুক্তিবাহিনীর একটি রেকি পার্টি খবর নিয়ে আসে যে, ২৪শে জুলাই বিকেল ৩টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নোয়াগাঁও স্কুলে স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি জনসভার আয়োজন করেছে। এ সংবাদ পেয়ে মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফার মর্টারসহ একটি প্লাটুন নোয়াগাঁও-এর জনসভা পণ্ড করার জন্য পাঠিয়ে দেন। বিকেল ৫টার দিকে ৫০-৬০ জন পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় দালালরা স্কুল প্রাঙ্গণে জনসভা শুরু করে। সভা শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর প্লাটুনটি মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। ফলে সভা ভেঙ্গে যায় এবং পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ আক্রমণে ৭ জন দালালসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৭ জন নিহত হয়।
কসবার টি আলীর বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন অবস্থানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করত। মুক্তিবাহিনী যখন সুযোগ পেতো তখনই এখানে আক্রমণ করত। ২৩শে জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন কল্যাণসাগর দিঘির নিকট এম্বুশ পেতে বসে থাকে। প্রায় দুঘণ্টা অপেক্ষার পর পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এ এম্বুশে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন দালালসহ ২০ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। ২৬শে জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দল কসবা থানার নোয়াগাঁও এবং আকসিনার মাঝামাঝি রাস্তায় এম্বুশ করে। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল নোয়াগাঁও যাবার পথে এম্বুশে পড়ে। এতে ৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দলটি ফেরার পথে পুনরায় কল্যাণসাগর দিঘির কাছে এম্বুশ পাতে। পাকিস্তানি সেনাদের একটি কোম্পানি সাইদাবাদ থেকে কসবা যাবার পথে সে এম্বুশে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সেদিন একজন দালালসহ ২২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়।
সালদা নদীর দক্ষিণে মনোরা রেল সেতুটি মেরামতের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী চেষ্টা চালায়। ২৬শে জুলাই সকাল ১০টার দিকে সেতু মেরামতের সরঞ্জামসহ পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী একটি দল মনোরা সেতুর নিকট সমবেত হয়। সেতুর পাশে বাংকার তৈরির জন্য তারা কাজ শুরু করে। এ সংবাদ পেয়ে মন্দভাগ সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন মনোরা ব্রিজের দিকে এগিয়ে যায়। বিকেল ৫টার দিকে মুক্তিবাহিনীর দলটি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। অতর্কিত এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মনোরা সেতু থেকে পালিয়ে যায়।
কসবা থানার গোসাইল নামক এলাকা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে আক্রমণ চালাতেন। এ সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী গোসাইল এলাকায় শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। এর ফলে মুক্তিবাহিনীর যাতায়াতের গোপন পথ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর যাতায়াতের পথ নিরাপদ করার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন চতুর্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানিকে নির্দেশ দেন। ৩১শে জুলাই এ কোম্পানি দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়ে গোসাইলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান নেয়। রাত ১০টার দিকে তারা পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকটি বাংকার ধ্বংস করে দেয় এবং অন্তত ২০ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা গোসাইল ত্যাগ করে।
কসবার সালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ পুরো জুলাই মাস ধরে চলতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি সালদা নদীর উত্তর দিকে শত্রুঘাঁটি ঘিরে অবস্থান নেয়। সালদা নদী সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি শত্রুঘাঁটির দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। এর ফলে পেছন দিকে একমাত্র নদীপথ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর যাতায়াতের অন্য সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। এই নদীপথেই তখন কুটি ও কসবা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা নদী অবস্থানে রসদ- সামগ্রী সরবারহ করা হতো। এই সরবারহ পথে এম্বুশ করার জন্য মেজর আবু সালেক চৌধুরী একটি প্লাটুন শত্রুঘাঁটির পেছনের দিকে পাঠিয়ে দেন। ১লা আগস্ট রাতে এই প্লাটুনটি সালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে নদীর ওপর এম্বুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১টার দিকে দেড় শতাধিক সৈন্য ও রসদসহ ৭- ৮টি নৌকা পাকিস্তানি সেনাদের সালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। নৌকাগুলো এম্বুশ অবস্থানের আওয়তায় এলে গেরিলা প্লাটুনটি মেশিনগানের গুলি চালাতে শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৭০ জন হতাহত হয়, ৪-৫টি নৌকা ডুবে যায় এবং প্রচুর পরিমাণ রসদ নষ্ট হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর ৪ জন সৈনিক শহীদ এবং একজন আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি দল কসবার দক্ষিণে নয়নপুর রেলস্টেশন এলাকায় সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করে অবস্থান করছিল। এই ঘাঁটি থেকে তারা সালদা নদী অবস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা চালায়। মুক্তিবাহিনী সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এ-সময় মেজর আবু সালেক চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের নয়নপুর ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘাঁটিতে এক কোম্পানির চেয়েও বেশি সৈন্য ছিল। পাকিস্তানি সেনারা নয়নপুর রেলস্টেশন এবং নিকটবর্তী রেলওয়ে গুদাম এলাকায় শক্ত বাংকার তৈরি করে অবস্থান করছিল। মেজর আবু সালেক চৌধুরী পাকিস্তানি বাহিনীর এই অবস্থানটি সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করেন। তারপর পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যান। চতুর্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি এবং গণবাহিনীর কিছু সদস্য নিয়ে তিনি শত্রুঘাঁটির নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ২:৩০টার দিকে নয়নপুর স্টেশনের উত্তর দিক থেকে দুটি প্লাটুন এক সঙ্গে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। একটি প্লাটুন এগিয়ে এসে নয়নপুর রেলস্টেশনের দুশ গজ উত্তরে রেললাইন পর্যন্ত দখল করে নেয়। এ-সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাবর্ষণ তীব্র আকার ধারণ করে। মেজর সালেক তাঁর কোম্পানিকে আক্রমণ তীব্রতর করার নির্দেশ দেন। মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী একটি প্লাটুন পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যেও রেললাইনের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুর অবস্থানের পঁচিশ গজের মধ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে তাঁরা পাকিস্তান বাহিনীর ৬-৭টি বাংকার ধ্বংস করে দেন। কিন্তু রেলওয়ে গুদাম এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। মেজর সালেকের পক্ষে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। নিরুপায় হয়ে তিনি অনেক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে পশ্চাতে সরে আসেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৭ জন সৈনিক শহীদ এবং ৯ জন গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা সেদিনের মতো তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সক্ষমত হয়। কসবা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর জন্য এ- যুদ্ধ ছিল মারাত্মক বিপর্যয়ের ঘটনা।
১০ই আগস্ট মেজর আবু সালেক চৌধুরী একটি প্লাটুন নিয়ে সিএন্ডবি রাস্তার পাশে সিদলাই গ্রামে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করেন। স্থানীয় লোকদের নিকট থেকে তিনি জানতে পারেন যে, সিএন্ডবি রাস্তার ওপর দিয়ে প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে উজানিসার পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে ৪-৫টি জিপ যাতায়াত করে। এ সংবাদ পেয়ে মেজর আবু সালেক চৌধুরী সিএন্ডবি রাস্তার পাশে এম্বুশ করেন। সমস্ত দিন ও রাত অপেক্ষা করার পরও পাকিস্তানি সেনাদের এম্বুশের মধ্যে পাওয়া যায়নি। এরপর রাস্তায় মাইন বসিয়ে তিনি প্লাটুনসহ নিজ ঘাঁটিতে রওনা হন এবং পথে রসুল গ্রামের নিকট একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে ২০ জন রাজাকার নিহত এবং ৩০ জন বন্দি হয়। এরপর দলটি নিজেদের অবস্থানে নিরাপদে ফিরে যায়।
সালদা নদী, কসবা, কুটি প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে দিন-দিন সাফল্যের পরিচয় দিতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সালদা নদী অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০ জন সৈনিক নিহত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বড় রকমের এক সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানি সেনা- নিয়ন্ত্রিত সালদা স্টেশন এলাকাটি ছিল যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই স্টেশনের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং সিলেটের রেল যোগাযোগ ছিল। হানাদার বাহিনীর এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ সালদা রেলওয়ে স্টেশন এলাকা দখলের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সালদা নদীর দিকে অগ্রসর হন। এ-সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৩তম বেলুচ রেজিমেন্টের প্রায় এক ব্রিগেড সৈনিক কুটি ও কসবা এলাকায় শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে অবস্থান করছিল। এছাড়া সালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুরেও ৩০তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্তিশালী একটি ঘাঁটি ছিল। মেজর খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে সালদা নদীর উত্তর বাঁকে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে অন্য একটি কোম্পানি মন্দভাগ থেকে অগ্রসর হয়ে নয়নপুর সড়কের কাছাকাছি এলাকায় পজিশন নেয়। মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী তাঁর কোম্পানি নিয়ে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে একটি গোডাউন সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন এ এম পাশা আর্টিলারি বাহিনী নিয়ে মন্দভাগে প্রস্তুত থাকেন। আর সুবেদার জব্বার একটি মর্টার গ্রুপ নিয়ে সালদা বাঁকের পেছনে সাপোর্ট গ্রুপ হিসেবে অবস্থান নেন। সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনায় থাকেন মেজর খালেদ মোশাররফ।
৩০শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ক্যাপ্টেন এ এম পাশা প্রথম পাকিস্তান সেনাদের ওপর আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁরা কুটি, কসবা, নয়নপুর, বুড়িচং এবং চাঁদলা থেকে আর্টিলারির ফায়ার শুরু করেন। ক্যাপ্টেন আশরাফ তাঁর বাহিনী নিয়ে নয়নপুরে শত্রুবাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ করেন। আক্রমণের তীব্রতায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে পাকিস্তানি বাহিনী নয়নপুর ছেড়ে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন আশরাফ নয়নপুর তাঁর দখলে নিয়ে নেন। ক্যাপ্টেন গাফফারও সালদা নদীর উত্তর বাঁক থেকে এগিয়ে এসে তাঁর বাহিনী নিয়ে নয়নপুরের সেতু পর্যন্ত পৌঁছে যান। মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী তাঁর বাহিনী নিয়ে সালদা নদী স্টেশন শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এ-সময় নয়নপুর থেকে বিতাড়িত হানাদার বাহিনীর একটি দল সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে এসে তাদের মূল বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে মেজর সালেকের বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে সকাল নয়টা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে মেজর সালেকের গোলা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা পেছনে সরে গিয়ে তিনি মন্দভাগে আশ্রয় নেন।
এই সংঘর্ষের পর মেজর খালেদ মোশাররফ সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকার দায়িত্ব মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফারের ওপর ন্যস্ত করেন। ক্যাপ্টেন গাফফার সালদা নদী স্টেশন এলাকা দখলের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি তাঁর কোম্পানিকে চারটি প্লাটুনে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্লাটুনকে শত্রুঘাঁটির ওপর ক্রমাগত আক্রমণের নির্দেশ দেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ই অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর বড়দাসুয়া, চাঁদলা, কাইয়ুমপুর এবং গোবিন্দপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানিরাও সারারাত ধরে মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করতে থাকে।
৮ই অক্টোবর সকাল আটটার দিকে সালদা নদীর মূল শত্রুঘাঁটির তিনদিক থেকে চারটি অবস্থানের ওপর আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দুটি অবস্থান হারিয়ে অবশিষ্ট দুটি ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। সুবেদার বেলায়েত অতিদ্রুত তাঁর বাহিনী নিয়ে সালদা নদী আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান নেন। তাঁর এ অবস্থানের ফলে পাকিস্তানি সেনারা বাজার এলাকা থেকে সালদা নদী রেলস্টেশনের অবস্থানের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর সকাল ৯টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় মুক্তিবাহিনীর বহু আকাঙ্ক্ষিত সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা। পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদী স্টেশন পুনর্দখলের জন্য বাজারের গোডাউন এলাকা থেকে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। এ আক্রমণে সুবেদার বেলায়েত শহীদ হন। বহু চেষ্টা করেও সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকা পুনর্দখল করতে ব্যর্থ হয়। এ বিজয় ক্যাপ্টেন গাফফারের পরিকল্পনা অনুসারেই সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর এ বিজয়কে জনতা স্বাগত জানায় এবং আনন্দে উদ্বেলিত হন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে কসবার সালদা নদী, নয়নপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে পিছু হটে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কসবা সদর, শাহপুর, টি আলীর বাড়ি এবং কুটি এলাকায় দৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করে অবস্থান নেয়। সামরিক দিক থেকে কসবা ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই তাঁরা কসবা দখলের জন্য সচেষ্ট হন। মেজর খালেদ মোশাররফ কসবা-গঙ্গাসাগর-আখাউড়া সাব-সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কসবা দখলের নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন নবম বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি নিয়ে আর্টিলারি বাহিনীর সহায়তায় উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে কসবা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ নিজে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তুমুল সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হঠাৎ একটি শেলের স্প্রিন্টারের আঘাতে মেজর খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হন। সে অবস্থায়ই তিনি রণাঙ্গনে উপস্থিত অফিসারদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। অতঃপর তাঁকে চিকিৎসার জন্য আগরতলায় নিয়ে যাওয়া যায়।
২১শে অক্টোবর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কসবা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করা হয়। কমলাসাগর বিওপিতে তখন কসবা-আখাউড়া গঙ্গাসাগর-সাবসেক্টর কমান্ডার ও নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিনের ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে তিনি ওয়ারলেসের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। রাত সাড়ে ৪টার দিকে সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈনিক কসবা আক্রমণ করেন। নবম বেঙ্গলের অবশিষ্ট সৈন্যরাও ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নির্দেশে এগিয়ে আসেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে কসবা পুরানবাজার এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী ওখান থেকে পিছু হটে গেলেও আক্রমণ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর অবিরাম শেলিং হতে থাকে। শেলিং-এর পাশাপাশি মেশিনগানের গুলিও চলে। কমলাসাগর বিওপি এলাকায় তখন একটি শেলের আঘাতে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমপিএ গুরুতর আহত হন। এবং যুদ্ধে আহত সকল বাঙালি সৈনিককে চিকিৎসার জন্য তাঁকে আগরতলায় পাঠানো হয়। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে মুক্তিবাহিনী কসবা পুরানবাজার এলাকা দখলে রাখতে সক্ষম হয়। এ-যুদ্ধে ১৪-১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২৬-২৭ জন আহত হন। ২২শে অক্টোবর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে কসবা সদর এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। কসবা থেকে বিতাড়িত শত্রুসেনারা কুমিল্লার দিকে সরে যায়। তারা কসবা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে লতুয়ামুড়া, চন্দ্রপুর এবং আখাউড়ায় তাদের ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। ডিসেম্বরের ১ ও ২ তারিখ লতুয়ামুড়া-চন্দ্রপুর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়। এভাবে ২রা ডিসেম্বর কসবা থানার সম্পূর্ণ এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এরপর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের বাহিনী কসবা থেকে কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুর রহিম, বীর বিক্রম- (পিতা খোরশেদ মিয়া, খেওড়া), -গোলাম রসুল, বীর বিক্রম- (পিতা মোফাজ্জল ভূঁইয়া, চকচন্দ্রপুর), গোলাম মোস্তাফা খান, বীর বিক্রম- (পিতা গোলাম পানজাতন আলী খান, কুটি), আবদুল আওয়াল, বীর প্রতীক- (পিতা মুন্সি মোহর আলী, মান্দারপুর), মো. ইয়াকুব আলী, বীর প্রতীক- (পিতা আবু তাহের ভূঞা, খারেরা), শামসুল হক, বীর প্রতীক – (পিতা আবদুর রাজ্জাক, হাতুরা বাড়ি), সাহেব মিয়া, বীর প্রতীক- (পিতা আলতাফ আলী, লেশিয়ারা), খায়রুল বাশার খান, বীর প্রতীক- (পিতা আমীর আলী খান, গোপীনাথপুর) এবং মনির আহমেদ খান, বীর প্রতীক- (পিতা আলী আহমদ খান, দেলী)।
কসবা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং এখানে যুদ্ধ করতে এসে যাঁরা শহীদ হন, তাঁরা হলেন- গোলাম রসুল, বীর বিক্রম (পিতা মোফাজ্জল মিয়া, চকচন্দ্রপুর), হারুনুর রশীদ (গোপীনাথপুর), মমিনুল হক চৌধুরী বাবুল (পিতা মুক্তিযোদ্ধা মো. ফজলুল হক চৌধুরী, গোপীনাথপুর), মমিনুল হক চৌধুরী (এসএসসি পরীক্ষার্থী; ১৫ই নভেম্বর নবীনগর থানার রাধানগর এলাকায় গেরিলা আক্রমণের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে কয়েকদিন বন্দি রাখার পর ২১শে নভেম্বর তাঁকে হত্যা করা হয়), সেলিম ভূঁইয়া (পিতা রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, গোপীনাথপুর), রংগু মিয়া খন্দকার (পিতা শমশের আলী খন্দকার, গোপীনাথপুর), মনু মিয়া (পিতা আবদুল আলীম, গোপীনাথপুর), শহীদুল হক ভূঁইয়া (পিতা আবদুল গনী ভূঁইয়া, চারগাছ; ইপিআর সদস্য, দিনাজপুরে শহীদ), নূরুল ইসলাম (পিতা হাজি আবদুল খালেক, নিমবাড়ি), রফিকুল ইসলাম (পিতা আলী আকবর, রাউথহাট), জালু মিয়া (পিতা খন্দকার আবদুল মান্নান, রাণীয়ারা), মফিজুর রহমান (পিতা শামসুল হক, নেমতাবাদ), মো. সেলিম মোল্লা (পিতা আবদুর রহমান মোল্লা, সায়দাবাদ), ইদ্রিছ মিয়া (পিতা আবদুল গফুর, বিসারাবাড়ি), মাহফুজ মিয়া (পিতা হাজি সুলতান মিয়া, সিমরাইল), আবুল খায়ের (পিতা তালেব আলী, মেহারী), তাজুল ইসলাম (পিতা হাজি সুলতান মিয়া, শিমরাইল), আবদুর রউফ (পিতা জয়দুল হুসেন, ঈশাননগর), আবদুল আওয়াল (পিতা আবদুল আহাদ, শিকারপুর), রুহুল আমিন (পিতা আবদুস সাত্তার, বুগীর; সেনাসদস্য), মো. তাজু মিয়া (পিতা মো. আবু মিয়া, গোপীনাথপুর; আনসার), সাহার মিয়া (পিতা আবুল বাশার ভূঁইয়া, বুগীর; পুলিশ), আবদুল হাকিম (পিতা আবদুল মান্নাফ, ধামসার; সেনাসদস্য), আবদুস সালাম ভূঁইয়া (পিতা সরাফত আলী ভূঁইয়া, গোপীনাথপুর), জয়নাল আবেদিন (পিতা মুকতুল হোসেন, তালতলা; সেনাসদস্য), আজগর আহমদ (পিতা নায়েব আলী, পুরকুইল মেহারী; সেনাসদস্য), ফজলুল হক (পিতা আ. রাজ্জাক ভূঁইয়া, শিমরাইল মেহারী; সেনাসদস্য), আবেদ আহাম্মদ (পিতা আবদুল মজিদ, মাইজখার, কুটি; সেনাসদস্য), আবদুর রউফ (পিতা নায়েব আলী, খাড়েরা; সেনাসদস্য), মো. ইউনুছ মিয়া (পিতা মো. আবদুল করিম, বিশারাবাড়ি; সেনাসদস্য), মো. নূর মিয়া (পিতা মো. বদরউদ্দিন, আকবপুর; ইপিআর), আবু তাহের (পিতা আবদুল মজিদ, মাদলা), পরেশ মল্লিক (পিতা ভারতচন্দ্র মল্লিক, সায়দাবাদ), মো. ফয়তুল ইসলাম (পিতা মানিক মিয়া, দেলী), মোতাহার হোসেন (পিতা সরাফত আলী, মান্দারপুর), মো. শামসুল হক (পিতা আবদুর রাজ্জাক, হাতুরাবাড়ি), আবদুর রশিদ (পিতা আবদুস সালাম, শিকারপুর), সিরাজুল ইসলাম (পিতা হাজি মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, শিকারপুর), রফিকুল ইসলাম (পিতা মনছুর আলী, নোয়াগাঁও), রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (পিতা আবদুল কাদের ভূঁইয়া, বায়েক), আবদুস সালাম সরকার (পিতা রইছউদ্দিন সরকার, নেয়ামতপুর), আবদুর রহিম (পিতা আক্তারুজ্জামান, চকচন্দ্রপুর), শাহজাহান সরকার (পিতা সুরুজ মিয়া সরকার, নেমতাবাদ; ইমামবাড়ি রেলস্টেশনের উত্তর পাশে সমাহিত), মো. আবুল হোসেন (কসবা থানাধীন বাদৈর ইউনিয়নের জমশেদপুর গ্রামের উত্তর পাশে সমাহিত), মো. আবুল কাশেম (হাজীগঞ্জ), আবদুর রহিম (খেউড়া; ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত সৈনিক এবং রংপুরের চিলমারী যুদ্ধে শহীদ), আলমগীর কবির, বীর প্রতীক- (নারায়ণপুর, আখাউড়া; কসবা যুদ্ধে শহীদ এবং শিমরাইল হাইস্কুল মাঠে সমাহিত), শাহজাহান সরকার (চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, কসবার ইমামবাড়ি এলাকায় শহীদ), আবুল কাশেম (কসবা থানার সীমান্ত এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং বায়েক ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে সমাহিত), সেলিম খান (ঐ), আবু জাহিদ আবু, সাইফুল ইসলাম সাফু (কসবা এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং জমশেদপুরে সমাহিত), মোজাম্মেল হোসেন আবু (ঐ), লে. আজিজুর রহমান (২১শে নভেম্বর কসবা থানার চন্দ্রপুর যুদ্ধে শহীদ, লক্ষ্মীপুরে সমাহিত), সুবেদার আবুল হোসেন (ঐ), হাবিলদার আবদুল হালিম, বীর বিক্রম – (ঐ), হাবিলদার আবুল কাশেম (ঐ), নায়েক আবুল হোসেন (ঐ), লে. না. নূরুল হক (ঐ), সিপাহি আবেদ আলী (ঐ), সিপাহি এনামুল হক (ঐ), সিপাহি আবুল কাশেম (ঐ), সিপাহি বোরহান উদ্দিন (ঐ), সিপাহি রফিকুল ইসলাম (ঐ), সিপাহি আবদুর রাজ্জাক (ঐ), আবুল হোসেন (ঐ), সিপাহি দরশন আলী (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক; কালোবাগ, দিনাজপুর; বায়েক ইউনিয়নের কুল্লাপাথরে সমাহিত), মো. জাকির হোসেন (আর কে মিশন রোড, ঢাকা; বায়েক ইউনিয়নের কুল্লাপাথরে সমাহিত), আবদুল জব্বার (কসবা, ঐ), হাবিলদার তৈয়ব আলী (গৌরীপুর, সিলেট; ইপিআর; ঐ), নায়েব আবদুস সাত্তার (বগুড়া ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, ঐ), সিপাহি আখতার আলী (সারিয়াকান্দি, বগুড়া; ইপিআর; ঐ), নওয়াব আলী (কসবা, ঐ), নায়েব সুবেদার মো. আবদুস সালাম (মাধোকাছা, নোয়াখালী; ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), নায়েক মোজ্জাম্মেল হক (মহাদান, ময়মনসিংহ; ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মুজাহিদ নূর মিয়া (কুড়িঘর, নবীনগর; ঐ), মো. ফারুক আহমেদ (কামালপুর, কসবা; ঐ), মো. ফখরুল আলম (কুল্লাপাথর, ঐ), সিপাহি মুসলিম মৃধা (পাঁচগাঁও, ফরিদপুর; ইপিআর, ঐ), ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম (নারিয়া, ফরিদপুর; ঐ), মো. আবদুল ওয়াদুদ (মন্দভাগ, ঐ), ল্যান্স নায়েক তমিজউদ্দিন (মুরাদনগর, কুমিল্লা; ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মতিউর রহমান (চোরমপুর, কুমিল্লা; ঐ), ল্যান্স নায়েক মো. আবদুল খালেক (কুমিল্লা; ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), সিপাহি হুমায়ূন কবির (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা; ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মো. আবদুল কাইয়ূম (বড়বাইক, কুমিল্লা; ঐ), সিপাহি মো. নূরুল হক (মোতালেবগঞ্জ, কুমিল্লা; ইপিআর, ঐ), নায়েব সুবেদার মঈনুল ইসলাম (বগুড়া, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মো. মোশাররফ হোসেন (চান্দলা, কুমিল্লা; ঐ), ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান (বগুড়া, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মো. তারা মিয়া (চান্দলা, বুড়িচং, কুমিল্লা; ঐ), নায়েব সুবেদার বেলায়েত হোসেন (সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম; ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য; ঐ), মো. রফিকুল ইসলাম (কসবা, ঐ), মো. মুরশেদ মিয়া (কসবা, ঐ), পরেশচন্দ্র মল্লিক (সায়দাবাদ, কসবা; ঐ), মো. জাহাঙ্গীর আলম (হাজিগঞ্জ, কুমিল্লা; ঐ), মো. আমির হোসেন (আখাউড়া, ঐ), মো. আবদুস সালাম সরকার (কসবা, ঐ), মো. শওকত (ধাতুর পহেলা, আখাউড়া; ঐ), মো. তাজুল ইসলাম (তুলাইশিমুল, আখাউড়া; ঐ), মো. জামাল উদ্দিন (হোমনা, কুমিল্লা; ঐ), মো. আবদুল আওয়াল (শিকারপুর, কসবা; ঐ), মো. আবেদ আহমেদ (কসবা, ঐ), মো. সিরাজুল ইসলাম (দেবীদ্বার, কুমিল্লা; ঐ), মো. ফরিদ মিয়া (দুলালপুর, হোমনা, কুমিল্লা; ঐ), মতিউর রহমান (বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; ঐ), আবদুল বারী খন্দকার (দেবীদ্বার, কুমিল্লা; ইপিআর, ঐ), সিপাহি আনওয়ার হোসেন (কসবা, ঐ), সিপাহি শহীদুল হক (মজলিশপুর, কসবা; ঐ), আহাদ বক্স পাটোয়ারী (চাঁদপুর, আনসার; ঐ), মো. আবদুর রশীদ (ঝগড়ারচর, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; ঐ), মো. শহীদ মিয়া (রাজাপুর, বুড়িচং, কুমিল্লা; ঐ), আশুরঞ্জন দে (ভৈরববাজার, কিশোরগঞ্জ; ঐ), নায়েব সুবেদার বেলায়েত হোসেন, বীর উত্তম- (সালদা নদী যুদ্ধে শহীদ) এবং সুবেদার মইনুল হোসেন, বীর উত্তম। বায়েক ইউনিয়নের কুল্লাপাথর গ্রামের পাহাড় এলাকায় একটি টিলার ওপরে ৪৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, যা কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ- নামে পরিচিত। গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরে ১৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি স্থলে নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। ফলকে যাঁদের নাম লেখা রয়েছে, তাঁরা হলেন- লে. আজিজুর রহমান, সুবেদার আবুল হোসেন, হাবিলদার আবদুল হালিম, বীর বিক্রম, হাবিলদার আবুল কাশেম, নায়েক আবুল হোসেন, ল্যান্স নায়েক নূরুল হক, সিপাহি আবেদ আলী, সিপাহি এনামুল হক, সিপাহি আবুল কাশেম, সিপাহি বোরহান উদ্দিন, সিপাহি রফিকুল ইসলাম, সিপাহি আবদুর রাজ্জাক ও আবুল হোসেন। এছাড়া শহীদদের নামে দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। বিদ্যালয় দুটি হলো- শহীদ বাবুল উচ্চ বিদ্যালয় (গোপীনাথপুর) ও শহীদ স্মরণিকা উচ্চ বিদ্যালয় (হাজিপুর, বিনাউটি)। সড়কগুলো হলো— শহীদ রনদাপ্রসাদ রায় সড়ক (কসবা সদর), স্বাধীনতা সড়ক (কসবা সদর), মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সড়ক (কসবার পুরাতন রেল স্টেশন রোড), শহীদ লে. আজিজ সড়ক (চৌমুহনি থেকে গুরুহিত পর্যন্ত)। [জয়দুল হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!