কল্যান্দি যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী)
কল্যান্দি যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ১৪ই নভেম্বর নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দলে-দলে সেনবাগের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছিলেন। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ এলাকা তাঁদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান হয়ে ওঠে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওবায়েদ উল্যার দল ফেনী-চৌমুহনী সড়ক (বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা গাজী লোকমান সড়ক)-এর উত্তর পাশে মোহাম্মদপুর গ্রামে অহিদুর রহমান চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে অবস্থান নেয়। ক্যাম্পটি প্রধান সড়কের কাছাকাছি হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলাফেরা সড়ক থেকে দেখা যেত। ১৪ই নভেম্বর সকাল ৮টার দিকে ঐ সড়ক দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি লরি ও একটি জিপ যাচ্ছিল। ঐ সময় আবুল কাশেম, হাফেজ আহম্মদ, নায়েক সফি এবং অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা পেট্রোল ডিউটিতে ছিলেন। পাকসেনারা মোহাম্মদপুর রামেন্দ্র মডেল উচ্চ বিদ্যালয় (কল্যান্দি হাইস্কুল নামে পরিচিত)-এর পূর্ব-উত্তর পাশে তাঁদের দেখে ফেলে এবং সড়কের ওপর গাড়ি থামিয়ে গুলি ছোড়ে। এর জবাবে নায়েক সফিও পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে একজন পাকসেনা নিহত হয়। তাদের কেউ-কেউ নিহত সৈন্যের লাশ গাড়িতে তোলে এবং অন্যরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দিকে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে যায়। পেট্রোল ডিউটিরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে একটি এসএমজি ও দুটি রাইফেল ছিল। তা দিয়েই তাঁরা শত্রুর মোকাবেলা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সেদিন ৬-৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। কমান্ডার ওবায়েদ উল্যাহ কভারিং ফায়ার করতে থাকেন, আর আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা ক্রলিং করে পেছনে যেতে থাকেন। ইতোমধ্যে দাগনভূঞার দিক থেকে আরো দুই লরি পাকসেনা যুদ্ধস্থলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ভারী মেশিনগানের সামনে টিকতে না পেরে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে থাকেন। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হাফেজ আহম্মদ নিকটস্থ একটি পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে অহিদের রহমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে প্রবেশ করেন। পাকসেনারা তাঁকে ধরার জন্য ঐ বাড়ি ঘেরাও করে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘরের ভেতর সিলিং- এর ওপর চেয়ারম্যানের ছেলে নুরুল ইসলাম বাচ্চু লুকিয়ে ছিলেন। ঘরে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পাকসেনারা তাঁকে এবং ঐ বাড়ির ছেরাজল হকের স্ত্রী করফুলের নেছাকে গুলি করে হত্যা করে। হাফেজ আহম্মদ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা এ এলাকা থেকে সরে যেতে সক্ষম হন। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোনো গুলির আওয়াজ না পেয়ে পাকসেনারা হাফেজ আহম্মদকে নিয়ে চলে যায়। তারা তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন করেও কোনো তথ্য না পেয়ে ফেনী যাওয়ার পথে কল্যান্দি থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে তুলাতলী বাজারের কাছে তাঁকে গুলি করে ফেলে যায় এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়। এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি সোনাইমুড়ী উপজেলার কাশিপুর গ্রামে। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে ফেনী-চৌমুহনী সড়কের পাশে দাফন করে। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তাঁর কবর পাকা করে সেখানে একটি নামফলক লাগানো হয়।
কল্যান্দি যুদ্ধে ওবায়েদ উল্যা কমান্ডার, আবুল কাশেম, শাহজাহান, আবদুস সাত্তার, ফয়েজ আহম্মদ, আবদুল হক, শেখ আহম্মদ, ছায়েদুল হক, আবদুল গোফরান, আবুল কালাম, শহীদ উল্যাহ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। শহীদ হাফেজ আহম্মদ ব্যতীত আর সকলেই ছিলেন সেনবাগ উপজেলার অধিবাসী। [মুহম্মদ আবু তাহের]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড