You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.14 | কলাবাড়ি গণহত্যা (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

কলাবাড়ি গণহত্যা (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ)

কলাবাড়ি গণহত্যা (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ) সংঘটিত হয় দুবার – একবার মে মাসে এবং অন্যবার অক্টোবর মাসে। এতে ৩ শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে কোটালীপাড়ার উত্তর এলাকার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পাকহানাদার বাহিনী নৃশংস অত্যাচার, নির্যাতন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যা চালায়। ৩০শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন জোয়ানের নেতৃত্বে পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ থানা পরিষদ ভবনের সামনে একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে। সেখান থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রতিদিন গোপালগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যা সংঘটিত করে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ফলে এটি একটি বধ্যভূমি হয়ে ওঠে, যা জয়বাংলা পুকুর বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
১৪ই মে পাকবাহিনী এ ক্যান্টনমেন্ট থেকে লঞ্চযোগে কোটালীপাড়া থানার উত্তর এলাকার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে হামলা চালায়, যা কলাবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন তারা অভিযান চালিয়ে রাধাগঞ্জ, খেজুর বাড়ি, গাছবাড়ি, বুরুয়া, কলাবাড়ি প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যাসহ দুশতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে কলাবাড়ি গ্রামেই বেশি ঘরবাড়ি পোড়ানো এবং গণহত্যা চালানো হয়। তারা এদিন কলাবাড়ি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মতিলাল বাড়ৈ, সুচিত্র বাড়ৈ, রাজেন বিশ্বাস, তরণীকান্ত বালা ও ফটিক মাঝিসহ শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। এ-সময় গ্রামবাসী সুভাষ সরকার ও রতিকান্ত সরকারের নেতৃত্বে তীর, ধনুক ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রসহকারে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। পাকহানাদাররা প্রতিরোধকারীদের ওপর গুলি চালালে সুভাষ সরকার ও মতিলাল সরকার শহীদ হন। পাকবাহিনীর হামলায় সেদিন প্রায় ৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়। বেশির ভাগ লোকজন রাধাগঞ্জ বাঘিয়ার বিলের ডোঁটকুড়া বনে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। আগুনে পুড়ে শ্মশানের মতো হয়ে যায় সমগ্র কলাবাড়ি গ্রাম। লঞ্চযোগে ঘাঘর নদী দিয়ে গ্রামে ঢুকে পাকবাহিনী নদীর দুপাড়ের গ্রামটিকে তছনছ করে ফেলে। অগণিত লাশ পড়ে থাকে গ্রামের পথে-ঘাটে ও ধানক্ষেতে।
কলাবাড়ি গ্রামে দ্বিতীয়বার গণহত্যা হয় ১২ই অক্টোবর। এদিন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট নিয়ে কলাবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বন্যাকবলিত ২০০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একই দিন ভোররাতে কোটালীপাড়া থানা কামান্ডার হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মধুমতি নদী থেকে পাকবাহিনীর একটি কার্গো ছিনিয়ে কলাবাড়ি গ্রামে নিয়ে আসে। কার্গোটি রাখা হয় ঘাঘর নদীর পূর্বপাড়ে কলাবাড়ি রাধাকান্ত হাইস্কুল সংলগ্ন একটি স্থানে। এ খবর পেয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানা সংলগ্ন মিনি ক্যান্টনমেন্ট এবং বাশবাড়িয়া থেকে বিপুল সংখ্যক পাকসৈন্য স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় লঞ্চ, স্পিড বোট এবং গানবোটে করে কলাবাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। হামলায় সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়। পাল্টা হামলা চালানের মতো অবস্থা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে পড়েন। এ-সময় এলাকাবাসীর অনেকেই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যায়। বন্যাকবলিত যারা থেকে যায় তাদের ওপর শুরু হয় হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ। হানাদার বাহিনী গানবোটে বাড়িবাড়ি গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বন্যায় ভাসমান লোকজনকে ধরে কার্গোর নিকট এনে তাদের চোখ ও হাত- পা বেঁধে বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাঘর নদীতে ফেলে দেয়। এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে অম্বিকাচরণ বাড়ৈ (১১০), গোপাল চন্দ্ৰ অধিকারী (৬৫), বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী (৩৫), নিমাই ওঝা (৩৪) ও সুভাষ হালদার (৪০) সহ ২০০ জনের মতো গ্রামবাসী নিহত হয়। নলুয়া গ্রামের কালু শীল নামে এক কিশোর ঘটনাক্রমে বেঁচে যায়। হানাদার বাহিনী তাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে বেয়নেট চার্জ করে পানিতে ফেলে দেয়। কিন্তু সে অনেক দূরে গিয়ে ভেসে ওঠে এবং বেঁচে যায়। কলাবাড়ি গ্রামের কৃষক উপেন অধিকারীও বেঁচে যান কচুরিপানার ধাপের ওপর লুকিয়ে থেকে। তার চোখের সামনেই পাকবাহিনী তার পিতা গোপাল চন্দ্র অধিকারী ও ভাই বিজয় কৃষ্ণ অধিকারীকে গুলি করে হত্যা করে। তাকেও তখন বেয়নেট চার্জ করে কচুরির ধাপের ওপর অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরের দিন তার বৃদ্ধা মা লেবু রাণী অধিকারী তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যুর স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন কৃষক উপেন অধিকারী।
স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও কলাবাড়ি গণহত্যায় নিহতদের কোনো তালিকা করা যায়নি। তাদের স্মরণে কোনো স্মৃতিসৌধও নির্মিত হয়নি। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানানো হলেও এ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। [রবীন্দ্রনাথ অধিকারী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড