You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগার

কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগার (১৯২১-২০১৮) প্রথম মার্কিন কংগ্রেসম্যান যিনি ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, কংগ্রেসে পাকিস্তানকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের দাবি উত্থাপন করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর ভূমিকা বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে প্রবল জনমত তৈরিতে সহায়তা করে। তিনি তাঁর ভারত সফর, বিবৃতি প্রদান এবং কংগ্রেসে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তৃতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে Friends of Liberation War সম্মাননা প্রদান করা হয়।
কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগার ১৯২১ সালের ২রা মার্চ আমেরিকার নিউ জার্সির বেয়নি-তে জন্মগ্রহণ করেন। বেয়নি হাইস্কুলে অধ্যয়নের পর ১৯৪৬ সালে তিনি জন মার্শাল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জন মার্শল ল স্কুল থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতেও অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি নিউ জার্সি থেকে ডেমোক্রেটিক দলের মনোয়ন নিয়ে প্রথমবার মার্কিন প্রতিনিধি সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিনিধি সভার সদস্য ছিলেন। একজন দক্ষ কংগ্রেসম্যান হিসেবে তাঁর ব্যাপক খ্যাতি ছিল। কংগ্রেসের হাউস ফরেন এফেয়ার্স কমিটি ও গভর্নমেন্ট অপারেশন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ফরেন এফেয়ার্স কমিটির এশিয়া-প্যাসিফিক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানপন্থী যে নীতি গ্রহণ করে, তার সমালোচনা ও বিরোধিতায় যেসব মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগার। তিনি কেবল সরকারি নীতির সমালোচনাই করেননি, বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানও গ্রহণ করেন। ১৩ই মে কংগ্রেসে দেয়া বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদাররা যে হত্যাযজ্ঞ। চালাচ্ছিল তার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি এ বক্তৃতায় বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলি যে আধুনিক সময়ের এক মানবিক বিপর্যয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তা জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘I firmly believe that one of the great human tragedies of modern times may be in the process of being created.’ গ্যালাগার জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের সাক্ষ্য (testimony) গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। বাংলাদেশ থেকে আগত অসংখ্য মানুষের মানবেতর জীবনযাপন তাঁকে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তিনি ৯ই জুন এক বিবৃতি দেন। তাতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেয়াকে ‘কসাইখানা ও প্লেগের জীবাণু ছড়ানোয়’ পৃষ্ঠপোষতার নামান্তর বলে উল্লেখ করেন। এ বিবৃতিতে তিনি বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের জাতিগত নিপীড়ন ও শরণার্থীদের কষ্টকর জীবন সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেন। ১৭ই জুন গ্যালাগার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর বক্তৃতা করেন। এ বক্তৃতায় তিনি ‘All American aid to Pakistan must cease’ উল্লেখ করে বলেন যে, বাংলাদেশ থেকে লাখ-লাখ মানুষের ভারতে আগমন সে-দেশের স্থিতিশীলতা ও এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপমহাদেশীয় নীতি পরিবর্তিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘The sheer number of refugees threatents the stability of India, poses a threat to peace on the subcontinent and, in my opinion, compels a formal change in U. S. policy.’ পাকিস্তানিরা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য পূর্বে প্রাপ্ত মার্কিন সাহায্য কীভাবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক কাজে ব্যবহার করছে, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘…boats provided to alleviate the suffering caused by flood and cyclone in November [90] are now being used to transport troops on their raids throughout the countryside of East Pakistan.’ কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগার ৮ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রতিনিধি সভায় দেয়া বক্তৃতায় ভারত কেন যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সৈন্যদের কীভাবে গ্রহণ করেছে, তা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এক কোটি শরণার্থী নিয়ে এমনিতে ভারত সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখনো যে বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের রক্ষা করার জন্য ভারতের সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এ- যুদ্ধ আর কিছু নয়, এটি বাঙালিদের জন্য ‘a war of national liberation’. নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন যখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছিল, তখন মার্কিন কংগ্রেসে গ্যালাগারের এ ভূমিকা বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম বন্ধুত্বের পরিচায়ক।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ কর্নেলিয়াস এডওয়ার্ড গ্যালাগারকে Friends of Liberation War সম্মাননা প্রদান করে। বাংলাদেশের বিপদের দিনের এ বন্ধু ২০১৮ সালের ১৭ই অক্টোবর ৭৯ বছর বয়সে নিউ জার্সিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [জালাল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ২০১০; A MA Muhit, American Response to Bangladesh Liberation War, UPL, Dhaka 1996, Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971′, Contemporary South Asia, 1995, Oxford, 4 (2)

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!