কলসকাঠী গণহত্যা (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল)
কলসকাঠী গণহত্যা (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল) সংঘটিত হয় ১৪ই মে। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকার- বারেক মোল্লা এবং ইসহাক হাওলাদারের দেখানো পথ অনুসরণ করে হানাদাররা হিন্দুপ্রধান এলাকা কলসকাঠীতে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়। মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ গণহত্যার শিকার হয়। স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদারদের সংবাদ দেয় যে, জেলার অনেক সমৃদ্ধিশালী হিন্দু টাকা-পয়সা নিয়ে কলসকাঠী জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী এ গণহত্যা চালায়। এতে শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। ঘটনারদিন সকাল ৮টার দিকে পশ্চিমে খয়রাবাদ, পূর্বে পাণ্ডব ও দক্ষিণে পাতাবুনিয়া নদীর মোহনা হয়ে গানবোট নিয়ে হানাদার বাহিনী কলসকাঠীতে প্রবেশ করে পালপাড়া, কুণ্ডুপাড়া, সেনপাড়া, কর্মকারপাড়া ও বাড়ৈপাড়ায় গণহত্যা চালায়। তারা এ-সময় কলসকাঠী বি এম একাডেমির ১১ জন ছাত্রকে হত্যা করে তুলাতলা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চারটি পরিবারের বাবা ও ছেলেকে হত্যা করে। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অমূল্য পালসহ কয়েকজনকে কলসকাঠী বাজারের চাউলাপট্টিতে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ খালে ফেলে দেয়। বরিশালের নামকরা উকিল শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাই বরিশাল মহিলা কলেজের কর্মচারী রমণীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কলসকাঠীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হানাদাররা বৃদ্ধ রমণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিদ্যাসাগরকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ৪২ জনের শহীদের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন— কলকাঠীর দুলাল কর্মকার (৪৫) (পিতা নিরঞ্জন কর্মকার; ব্যবসায়ী), যোগেন্দ্র লাল সেন (৫০) (পিতা বিপিন সেন; ব্যবসায়ী), নগেন কর্মকার (৪০) (পিতা রমেশ কর্মকার; শ্রমিক), কুট্টি কর্মকার (৩০) (পিতা বাবু কর্মকার; শ্রমিক), রমেশ কর্মকার (৩০) (পিতা ক্ষীরোদ কর্মকার; শ্রমিক), সন্তোষ কর্মকার (৫০) (পিতা মনোজ কর্মকার; ব্যবসায়ী), চন্দন চক্রবর্তী (১৯) (পিতা স্বপন চক্রবর্তী; ছাত্র), খোকন কুমার দাস (৪০) (পিতা তপন কুমার দাস; শ্রমিক), দুলাল চন্দ্র দাস (৩৫) (পিতা সঞ্জিত কুমার দাস; শ্রমিক), বলরাম রজব দাস (৫৫) (ব্যবসায়ী), আনন্দ নট্ট (৬০) (ব্যবসায়ী), নরোত্তম বৈষ্ণব (৫০) (পিতা রাধাকান্ত বৈষ্ণব; ব্যবসায়ী), গণেশ ভূঞ্জমালী (৩০) (পিতা শশী ভূঞ্জমালী; ব্যবসায়ী), অক্ষয় শীল (৩৫) (পিতা হরিচরণ শীল; শ্রমিক), শরৎ চন্দ্র শীল (৪০) (পিতা কালাচাঁদ শীল; শ্রমিক), কালা চাঁদ সাহা (৫৫) (পিতা চন্দ্ৰকান্ত সাহা; ব্যবসায়ী), অমৃত লাল হালদার (৩০) (পিতা শ্যাম লাল হালদার; শ্রমিক), অমরী ঘোষ (৪৩) (স্বামী রাখাল ঘোষ; গৃহিণী), দীপক (২০) (পিতা অজিত কুমার; ছাত্র), দেবেন্দ্র পাল (৩০) (পিতা নগেন পাল; শ্রমিক), বসন্ত পাল (৫০) (পিতা হরিপদ পাল; ব্যবসা); বাগদিয়া গ্রামের গণেশ পাল (৬০) (পিতা নিমাই পাল, বাগদিয়া; মৃৎশিল্পী), নীল মাধব পাল (৭০) (মৃৎশিল্পী), দিলীপ কুমার পাল (১৮) (পিতা হরেকৃষ্ণ পাল; ছাত্র), মানিক পাল (২০) (পিতা ভদ্ৰকান্ত পাল; ছাত্র), দেবু পাল (৬০) (পিতা নিশিকান্ত পাল; শ্রমিক), ধর্ম পাল (৫৫) (পিতা হরিচরণ পাল; মৃৎশিল্পী), দেবেন্দ্র পাল (৬০) (পিতা সুরেন্দ্রনাথ পাল; মৃৎশিল্পী), চন্দ্ৰকান্ত পাল (৪৫) (পিতা উমাচরণ পাল; মৃৎশিল্পী), রাধাচরণ পাল (৪৫) (পিতা হরিপদ পাল; মৃৎশিল্পী), শশীকান্ত পাল (৬০) (পিতা নন্দ পাল; মৃৎশিল্পী), গোপীনাথ পাল (৩০) (পিতা ভদ্র পাল; মৃৎশিল্পী), মহেন্দ্ৰ পাল (৫০) (পিতা বঙ্কিম পাল; মৃৎশিল্পী), ধলা চাঁন পাল (২২) (পিতা মহেন্দ্র পাল; ছাত্র), হীরা লাল পাল (৪০) (পিতা যতীন পাল; শ্রমিক), বসন্ত পাল (৫০)(পিতা কেশব পাল; শ্রমিক); বেবাজ গ্রামের শংকর কাঞ্জিলাল (৬০) (পিতা রণজিৎ কাঞ্জিলাল; ব্যবসায়ী), বিনোদ চক্রবর্তী (২১) (পিতা সচীন চক্রবর্ত; ছাত্র), ক্ষীরোদ চন্দ্র (৪৫) (পিতা মঙ্গল চন্দ্র; ব্যবসা), গোপাল মিস্ত্রি (৫৫) (ব্যবসায়ী), রমেশ মিস্ত্রি (৩৫) (পিতা মোহন মিস্ত্রি; ব্যবসায়ী) এবং কৈলাশ সিকদার (৪৫) (পিতা মৃণাল সিকদার; ব্যবসায়ী)। কলসকাঠী গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে বাজারের নিকট জমিদার বাড়ির সামনে নামফলকসহ একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড