মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়া উপজেলা (পটুয়াখালী)
কলাপাড়া উপজেলা (পটুয়াখালী) ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ এর পরপরই কলাপাড়ার স্বাধীনতাকামী জনগণ মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। ঐ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মো. আবুল হাসেম এমপিএ-র নেতৃত্বে কলাপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর কলাপাড়া থানা আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সৈয়দ মো. আবুল হাসেম এমপিএ-এর নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়৷ এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী, ডা. আবুল কাশেম, ইসমাইল হোসেন তালুকদার, আনোয়ারুল ইসলাম, উথুন অংজা ওরফে থনজয় মাস্টার, মোশারেফ হোসেন বিশ্বাস, কালাচাঁদ দত্ত (মোক্তার), উসুয়ে হাওলাদার (রাখাইন নেতা), নগেন বিশ্বাস, রণধীর দত্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আফতাব উদ্দিন মৃধা, মোতাহার উদ্দিন বিশ্বাস, জমিস বিশ্বাস, সাহজাহান মিয়া (সাজা ভাই), গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ, মাহতাব উদ্দিন মৃধা, মোতালেব খলিফা। এঁদের সঙ্গে যুবসমাজের এস এম মঞ্জুরুল আহসান, মিজানুর রহমান বিশ্বাস টুটু, শামসুল আলম, আমজেদ হোসেন হাওলাদার, গাজী আব্দুল খালেক মধু, নজিবুর রহমান নজির, সালাউদ্দিন আহম্মেদ, মেজবাহ উদ্দিন, সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন, তৌফিক উদ্দিন আহম্মেদ, মাহফুজুর রহমান তালুকদার, নুর বাহাদুর তালুকদার প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আলাউদ্দিন আহম্মেদ, ফজলুর রহমান সানু শিকদার, আমজাদ হোসেন হাওলাদার, আহসান উদ্দিন জসিম, আবুল বাসার সিদার, তপন কুমার সাহা, শিবাণী দত্ত, আফরোজা বেগম, সৈয়দা মেহেরুন নেছা মিনু প্রমুখ এলাকার জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এলাকার ছাত্র-যুবকদের খেপুপাড়া হাইস্কুল মাঠে কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরবর্তীতে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তারা দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন হাবিবুল্লাহ রানা, এস এম নাজমূল হুদা সালেক, শাহআলম তালুকদার, রেজাউল করিম বিশ্বাস, সাজ্জাদুল ইসলাম ও আরিফুর রহমান খান মুকুল। এঁরা ত্রিপুরার আগরতলা ও উত্তর প্রদেশের শাহরানপুর হয়ে যান তাড়ুয়া। সেখানে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে কলাপাড়ায় এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হাবিবুল্লাহ রানা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী কলাপাড়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং কলাপাড়া থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী কর্তৃক পটুয়াখালী জেলা সদর দখলের পর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী- ও অবাঙালিদের সমন্বয়ে কলাপাড়ায় শান্তি কমিটি – -রাজাকার- বাহিনী গঠিত হয়। সংগঠকদের মধ্যে ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ এমএলএ (মুসলিম লীগ নেতা, কলাপাড়া), নুর দারাজ মাতুব্বর (নীলগঞ্জ), মোসলেম মেম্বার (নীলগঞ্জ), মেহের উদ্দিন মাস্টার (এতিমখানা, কলাপাড়া সদর), বিহারি সিদ্দিক মিয়া (নতুনবাজার), বিহারি আতাউল্লাহ (নতুনবাজার), তালেবুর রহমান (দিঘল বালিয়াতলী), এরশাদ উল্লাহ ভূঁইয়া (বড় বালিয়াতলী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
কলাপাড়া থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা কলাপাড়া থানা সদরের পুরান বাজারের বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিবর্গ এবং বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট করে। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী রাতের আঁধারে কলাপাড়া থানার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রাম থেকে প্রফুল্ল মোহন ভৌমিক ও বিনোদবিহারী দত্তকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের দুজনের হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে আন্দারমানিক নদীতে ফেলে দেয়। কলাপাড়া থানায় স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পটি পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ৫ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কলাপাড়া থানা অপারেশন- করেন এবং ৬ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কলাপাড়া উপজেলায় ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন— সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী (পিতা বানেশ্বর চৌধুরী, পুরান বাজার), শওকত হোসেন (পিতা আলী আকবর মৃধা, উত্তর লালুয়া), আ. মজিদ (আনসার সদস্য; পিতা কালুখান, সুধিরপুর), আলী আহমেদ খান (মোবারক আলীখান, আরামগঞ্জ), আ. কদ্দুস হাওলাদার (সেনা সদস্য; দলিল উদ্দিন হাওলাদার, ফরিদগঞ্জ), এ খালেক (পিতা আছমত আলী, নাচনাপাড়া; আনসার সদস্য), আ. মোতালেব (ইপিআর সদস্য; পিতা আবুল হাসেম হাওলাদার, নিশানা বাড়িয়া), আ. রশিদ হাওলাদার, (পিতা আ. হমেদ হাওলাদার, বিপিনপুর), মো. শাহজাহান হাওলাদার (এফরান উদ্দিন হাওলাদার, মেহেরপুর), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা সৈয়দ জালাল উদ্দিন মাস্টার, আলীগঞ্জ) ও সুলতান আহম্মেদ (পিতা সেকান্দার আলী হাওলাদার, কুয়াকাটা)।
কলাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। মনোহর পট্টি ব্রিজ থেকে গেজেটেড অফিসার্স কোয়ার্টার্স পর্যন্ত পুরাতন হাসপাতাল সড়কটি শহীদ সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী সড়ক ও কলাপাড়া মহিলা কলেজ থেকে বিদ্যুৎ অফিস পর্যন্ত সড়কটি শহীদ শওকত হোসেন সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। [শামসুল আলম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড