মুক্তিযুদ্ধে কর্ণফুলী উপজেলা (চট্টগ্রাম)
কর্ণফুলী উপজেলা (চট্টগ্রাম) ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ এলাকার জনগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ৭০-এর নির্বাচনে তারা পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ, পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে এমএনএ এবং আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া (বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলা) আসনে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে এমপিএ নির্বাচিত করে। নির্বাচনের পরবর্তী বিশেষত মার্চের ঘটনাবলি তাদের স্বাধীনতাকামী করে তোলে।
মার্চের ১ তারিখ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ঘোষণায় মার্চের ৩ তারিখ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনুসরণে কর্ণফুলীতে ২-৬ মার্চ হরতাল পালিত হয়। ইতোমধ্যে পটিয়া থানা (বর্তমান চন্দনাইশ, পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলা) ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক সামশুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক ও মনোজ সিংহ হাজারীকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে পটিয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এতে কর্ণফুলী থেকেও সদস্য ছিলেন। কর্ণফুলীর হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে স্থানীয় আনসার বাহিনী এবং অবসরপ্রাপ্ত ইবিআর ও ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিকরা কাঠের রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এ ট্রেনিং চলে।
এদিকে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমানকে সদস্য-সচিব করে পটিয়া সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এতে কর্ণফুলী থেকেও সদস্য ছিলেন। পশ্চিম পটিয়া (বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলা) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ফরিদ বাঙালি, নুরুল ইসলাম, আলী নূর, রফিক আহমদ খান, কামাল, সিদ্দিক বিকম, আবুল হাশেম, ফজল আহমদ, মোহাম্মদ আসলাম, হামিদুল হক, এম এন ইসলাম, এয়াকুব, নুরুল আফসার, আবু তাহের বাঙালি, ফেরদৌস চৌধুরী, মুক্তিমান বড়ুয়া, ইউনুছ, নুরুল আমিন, রশিদ আহমদ, রফিকুল আলম চৌধুরী, হারুন অর রশিদ (পিতা সাহেব মিয়া) প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। কর্ণফুলীতে ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বর আক্রমণ সংঘটিত হলে কর্ণফুলী উপজেলার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতির নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু হয়। কর্ণফুলীর বিভিন্ন স্থানে আবারো মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়। পালিয়ে আসা ইবিআর-ইপিআর-পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ট্রেনিং প্রদানে এগিয়ে আসেন। তাঁদের কাছে অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আওয়ামী লীগ থেকে: সালেহ আহমদ সওদাগর (পিতা নজির আহমদ, জুলধা), হাবিবুর রহমান (চরলক্ষ্যা), নুরুল ইসলাম (পিতা মৌলবি জামাল আহমেদ, চরলক্ষ্যা), সালেহ আহমদ (জুলধা), নুরুল ইসলাম ওরফে কালা মিয়া (চরপাথরঘাটা), কালা মিয়া সওদাগর (ঈছানগর), অনিল চন্দ্র রায় (ডাঙার চর), আবুল হোসেন (পিতা আরবান আলী, চরলক্ষ্যা), নুরুল মোস্তফা (পিতা শফিক আহমেদ, জুলধা), এ টি এম হাশেম (চরলক্ষ্যা), জোবায়ের আহমদ (চরলক্ষ্যা), মো. ইব্রাহিম (চরফরিদ), আবদুল মন্নান (ঈছানগর), এরশাদ আহমদ চৌধুরী (পিতা ওমরা মিয়া চৌধুরী, শিকলবাহা), এডভোকেট নুর মোহাম্মদ (শিকলবাহা), আবদুস সালাম (শিকলবাহা, সৈয়দুল আলম চৌধুরী (শিকলবাহা), মো. ইছহাক মেম্বার (শিকলবাহা), মো. সোলেমান বাঙালি (শিকলবাহা), মো. সোলেমান (শিকলবাহা), মো. হোসেন মেম্বার (শিকলবাহা), আবদুল গফফার খান (বড়উঠান), মাস্টার শফিকুর রহমান (বড়উঠান), ফজল করিম (দৌলতপুর), আলী আহমদ (দৌলতপুর), আবদুন নুর (শাহমীরপুর), আলহাজ্ব মো. ইউসুফ (শামীরপুর), বদিউল আলম (দক্ষিণ শাীরপুর), আবুল হোসেন (দক্ষিণ শাহমীরপুর), আবুল কালাম (দক্ষিণ শামীরপুর), মো. ইবরাহিম (দক্ষিণ শাীরপুর), জাফর আহমদ (শামীরপুর), জানে আলম মাস্টার (দক্ষিণ শাহমীরপুর), মোকাররম মিয়া (শামীরপুর), আনোয়ারুল হক (শামীরপুর), ডা. কামাল উদ্দিন খান (বড়উঠান); ছাত্রলীগ থেকে: এম এন ইসলাম (পিতা ইসহাক মিয়া, জুলধা), কামাল উদ্দিন (শাহ্ মীরপুর), মো. ইউনুছ (চরলক্ষ্যা), নূর হোসেন (শামীরপুর), এম এ ছালাম (চরলক্ষ্যা), কামাল উদ্দিন (শিকলবাহা), পবন দাস (শিকলবাহা), শাহাদুল হক (শাহ্র্মীরপুর), এরশাদ আহমদ (চরপাথরঘাটা), সিদ্দিক বিকম (শিকলবাহা), আবু তাহের বাঙালি (পিতা মো. শরীফ সওদাগর) এবং ন্যাপ (মুজাফ্ফর) থেকে: সাইফুদ্দিন খান (বড়উঠান)।
উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন— শাহজাহান ইসলামাবাদী (গ্রুপ কমান্ডার, শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ; তিনি অপারেশন কমান্ডারও ছিলেন) এবং নায়েক আজিজুল হক (অপারেশন কমান্ডার; তিনি স্থানীয়ভাবে গঠিত একটি গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন)।
এ উপজেলায় দুটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল মহিউল আলম বাহিনী ও করিম বাহিনী। মহিউল আলম বাহিনীর প্রধান ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন মুরিদুল আলম, ফরিদুল আলম ও শাহজাহান ইসলামাবাদী। করিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম (প্রকৃত নাম সিরাজুল করিম, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কর্পোরাল) এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, আহমদ শরীফ মনির ও অধ্যাপক শামসুল ইসলাম। এ দুটি বাহিনী পটিয়া উপজেলায়ও যুদ্ধ করেছে।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর ২৬শে মার্চ সকাল ৯.৩০টার দিকে পটিয়া কলেজ বাঙালি ইপিআর ও ইবিআর সদস্যদের ক্যাম্পে পরিণত হয়। এরপর পটিয়া ক্লাব ও শশাঙ্কমালা (পরে আবদুর রহমান) গার্লস হাই স্কুলও ইবিআর ও ইপিআর সদস্যদের ক্যাম্পে পরিণত হয়। পটিয়া কলেজ ক্যাম্প গঠিত হওয়ার পর অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ একটি যুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। ক্যাম্পসমূহ থেকে সৈনিকরা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতেন। কর্ণফুলীর জনগণ পটিয়া সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে এসব ক্যাম্পে, এমনকি কালুরঘাটের প্রতিরোধযোদ্ধাদের কাছেও খাদ্য ও রসদপত্র প্রেরণ করত। মে মাসে আনোয়ারা মেরিন একাডেমি ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী কর্ণফুলীতে প্রবেশ করে এবং জুলধার জামতল বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- তমিজ গোলাল (চরলক্ষ্যা), আবদুল জলিল চৌধুরী ওরফে জলিল সওদাগর (শিকলবাহা), হাজি মদন আলী (শিকলবাহা), আলিমুদ্দিন (চরলক্ষ্যা), আজিজুর রহমান (চরলক্ষ্যা), আবদুল আউয়াল চৌধুরী (দৌলতপুর), জেবল হোসেন মাঝি (পিতা আবুল হোসেন, শিকলবাহা), জালাল আহমেদ (পিতা লাল মিয়া, শিকলবাহা), আহমেদ আলী (পিতা আজিজুর রহমান, চরচাকতাই, পাঁচলাইশ), আহমদ হোসেন চৌধুরী ওরফে আহমদ চেয়ারম্যান (বড়উঠান), ডা. উমর ফারুক (শিকলবাহা), মাস্টার নাছির আহমেদ (শিকলবাহা), আবদুস সালাম চৌধুরী ওরফে টিক্কা খান (বড়উঠান), হাফেজ মাওলানা ইউনুছ (পিতা মাওলানা আবদুস সোবহান, মধ্যম শাহ্মীরপুর রাজ্জাকপাড়া) প্রমুখ।
মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ, পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলা) থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। খায়ের আহমদ চৌধুরী (পিতা রহমত আলী, পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরীপাড়া)-কে আহ্বায়ক করে গঠিত এ কমিটিতে কর্ণফুলী থেকে সম্পৃক্ত ছিল শিকলবাহার জলিল সওদাগর, চরলক্ষ্যার তমিজ গোলাল, বড়উঠানের আহমদ চেয়ারম্যান প্রমুখ। এরপর বিভিন্ন ইউনিয়নেও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। সেগুলো হলো— চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন: চেয়ারম্যান আলিমুদ্দিন, সদস্য আজিজুর রহমান, আহমদ হোসেন ডিলার, আনোয়ার (জুলধা), ওমর আলী (চরপাথরঘাটা); শিকলবাহা ইউনিয়ন: চেয়ারম্যান আবদুল জলিল চৌধুরী ওরফে জলিল সওদাগর (এখানে পাল্টা একটি শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল, যার চেয়ারম্যান ছিল হাজি মদন আলী), সদস্য মাস্টার নাছির আহমেদ (শিকলবাহা) প্রমুখ; বড়উঠান ইউনিয়ন: চেয়ারম্যান আহমদ হোসেন চৌধুরী ওরফে আহমদ চেয়ারম্যান (পাল্টা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল দৌলতপুর নিবাসী আবদুল আউয়াল চৌধুরী। সে চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গি বাজারে অবস্থিত তার মডার্ন প্রেস থেকে কর্মকাণ্ড চালাত), সদস্য আবদুস সালাম চৌধুরী ওরফে টিক্কা খান, হারুন, শমসের (শাহ্র্মীরপুর), হাশেম (শাহমীরপুর) প্রমুখ।
শান্তি কমিটির সম্মতিক্রমে নুরুল হক (পিতা আজিজুর রহমান, বৈলতলী)-কে পটিয়া থানার কমান্ডার নিযুক্ত করে বিশাল রাজাকার- বাহিনী গঠন করা হয়। তার অধীনে সহস্রাধিক রাজাকার ছিল। থানা হেডকোয়ার্টার্সে দুই শতাধিক এবং প্রত্যেক ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের অধীনে ১০ জন করে রাজাকার নিয়োজিত ছিল। রাজাকার বাহিনী সাব মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর (চট্টগ্রাম সেক্টর)-এর অধীনে কাজ করত। নুরুল হক কমান্ডার হলেও তার পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি অপরাধ কর্মে লিপ্ত ছিল তার ভাই আহমদ সৈয়দ ও বাদশা।
উপজেলার রাজাকাররা হলো- জেবল হোসেন মাঝি (পিতা আবুল হোসেন, শিকলবাহা), ফজল আহমেদ (পিতা ওসমান খান, শিকলবাহা), জাকের আহমেদ (পিতা সুলতান আহমেদ, শিকলবাহা), নওয়াব আলী (পিতা সাইদ আহমেদ, খোয়াজ নগর), আবদুল মালেক (পিতা আবদুল জলিল, খোয়াজ নগর), শাহ আলম (পিতা মো. হানিফ, চরলক্ষ্যা), মহিম আহমেদ (পিতা মিয়াজান, ঈছানগর), আলী আহমেদ (পিতা আনোয়ার আলী, দৌলতপুর), আবদুর রহমান (পিতা মকবুল আহমেদ, দৌলতপুর), নুর আহমেদ (পিতা ইমাম শরীফ, দৌলতপুর), আবদুন নুর (পিতা আবদুর রহমান, দৌলতপুর), মোহাম্মদ ইদ্রিস (পিতা বাচা মিয়া, দৌলতপুর), আবদুল করিম (পিতা আবদুল লতিফ, ঈছানগর), শাহজাহান কবির (পিতা সেকেন্দার আহমেদ, ঈছানগর), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা ফয়জুর রহমান, দৌলতপুর) প্রমুখ। ২৬শে জুলাই এরা রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর মাধ্যমে পটিয়া থানা (বর্তমান চন্দনাইশ, পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলা) আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। মনসার আবুল কালাম আলবদর এবং সাতবাড়িয়ার মোজাফ্ফর আহমদ আলশামস বাহিনীর থানা কমান্ডার নিযুক্ত হয়। মুজাহিদ বাহিনীর পটিয়া থানা কমান্ডার ছিল নুর মোহাম্মদ (পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরীপাড়া)। এসব সংগঠন মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ করে পাকবাহিনীকে সরবরাহ করত এবং হত্যা, গণহত্যা ও নারীনির্যাতনে পাকবাহিনীকে সহায়তা দিত। লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ ও হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করণেও এসব সংগঠন লিপ্ত ছিল।
কর্ণফুলী উপজেলায় একটি গণহত্যা সংঘটিত হয় শামীরপুর ফিরিঙ্গি বাড়ি গণহত্যা-। ৪ঠা জুন সংঘটিত এ গণহত্যায় ঘটনাস্থলে ১১ জন শহীদ হন এবং ১ জন গুলিতে আহত হয়ে পরদিন মারা যান। এছাড়া আরো অনেক নিরীহ লোক পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ১১ ও ২১শে এপ্রিল শিকলবাহায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন পাকক্যাম্প, চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদ, বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদ ও শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদ ছিল এ উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে শাহমীরপুর দেয়াঙ পাহাড় গণকবর। সন্দ্বীপ পাড়ার দক্ষিণে দেয়াঙ পাহাড়ে খ্রিস্টানদের মরিয়ম আশ্রম অবস্থিত। এ আশ্রমের উত্তর পাশে পাহাড়ের ঢালুতে গীর্জাঘর নামে একটি কবরস্থান আছে। এ কবরস্থানের পূর্ব পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে শাহমীরপুর ফিরিঙ্গি বাড়ি গণহত্যায় শহীদ ১১ জনের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়।
উপজেলায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশনটি হলো অপারেশন জ্যাকপট (চট্টগ্রাম)। ১৫ই আগস্ট কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা থেকে এটি পরিচালিত হয়। অপারেশনের পূর্বে সাবমেরিনার এ ডব্লিউ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নৌকমান্ডোরা চট্টগ্রাম শহর হয়ে চরলক্ষ্যায় এসে অবস্থান নেন। মৌলভী সৈয়দের নির্দেশে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি কলেজের ছাত্র ইউনুছ কর্ণফুলী পার করিয়ে তাঁদের দক্ষিণ পাড়ে আসতে সাহায্য করেন। চরলক্ষ্যায় তাঁদের আশ্রয় ছিল ইব্রাহিম সওদাগরের বাড়ি, কালা মিয়া সওদাগরের বাড়ি ও ইউনুছের খামার বাড়ি। নূর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তিও তাঁদের আশ্রয়দাতা ছিলেন।
১৫ই আগস্ট দিনের বেলা নৌকমান্ডোরা রেকি করেন এবং মধ্যরাতে অপারেশনে বের হন। এ অপারেশনে নৌকমান্ডোরা এম ভি হরমুজ, এম ভি আল আব্বাস, দুটি গানবোট, বার্জ ওরিয়েন্টসহ মোট ১০টি টার্গেট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হন। এ অপারেশনে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
চরলক্ষ্যায় নৌকমান্ডোদের থাকা-খাওয়া, পথ প্রদর্শন ও তাঁদের ঘাঁটি পাহারা দেয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা সহযোগিতা করেন, তাঁরা হলেন- আবদুল মন্নান, আলী আহমদ, ইউনুছ, কামাল উদ্দিন চৌধুরী, মো. আজিজ, এম এন ইসলাম, আবু তাহের, মোহাম্মদ ইদ্রিছ, কালা মিয়া সওদাগর, সুলতান কাওয়াল, আবদুর রহিম (ভোলা), ডা. আইয়ুব আলী, গোলাপ মিয়া, কবির আহমদ, শাকিল আহমদ, ইয়াকুব প্রমুখ। এঁদের অনেকেই ক্যাপ্টেন করিম বাহিনীর যোদ্ধা ছিলেন।
এছাড়া অরো তিনটি ছোটখাট অপারেশন পরিচালিত হয়, যেমন- বড়উঠান ডাকপাড়া রাজাকার অপারেশন, শামীরপুর পাকবাহিনীর দালাল অপারেশন ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন কাউন্সিল অপারেশন।
আনোয়ারা মেরিন একাডেমি ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা কর্ণফুলী উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে হামলা চালাত। ১৪ই ডিসেম্বর কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপ, কমান্ডার আবদুর রাজ্জাকের গ্রুপ, কমান্ডার কাজী ইদ্রিছের গ্রুপ ও কমান্ডার আবদুল হকের গ্রুপ একযোগে ক্যাম্প আক্রমণ করলে ক্যাম্পের পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে এবং আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রাসবিহারী নাথ (শিকলবাহা) ও আবুল হাশেম (দৌলতপুর, বড়উঠান)। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে রয়েছে- মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী চত্বর (মইজ্জার টেক, চরপাথরঘাটা) ও বরকতর পাড়া মুক্তিযোদ্ধা সড়ক (মধ্যম শাহমীরপুর, ৬নং ওয়ার্ড, বড়উঠান)। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড