You dont have javascript enabled! Please enable it!

করিম বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম)

করিম বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের মল্লপাড়ার অধিবাসী সিরাজুল করিম। তিনি ক্যাপ্টেন করিম নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্পোরাল। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। ৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে অগ্রসর হলে মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে লে. মাহফুজুর রহমান মদুনাঘাটে ডিফেন্স নেন। ক্যাপ্টেন করিমও ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে লে. মাহফুজুরের সঙ্গে যোগ দেন। ১১ই এপ্রিল খুব ভোরে মেজর মীর শওকত আলী কালারপুলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সৈন্যদলের কাছে কালারপুলের অবস্থা জানার জন্য সেখানে যান এবং সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি ক্যাপ্টেন অলি আহমদের পাঠানো খবরে জানতে পারেন যে, কয়েকশ পাকিস্তানি সৈন্য কালুরঘাট আক্রমণ করেছে, ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী গুরুতর আহত এবং লে. শমসের মুবিন চৌধুরীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল ৯টার দিকে তিনি কালারপুল থেকে কালুরঘাটে এসে সেখানে ডিফেন্সরত সবাইকে পিছু হটার নির্দেশ দেন। তাঁরা পিছু না হটা পর্যন্ত লে. মাহফুজুরকে মদুনঘাট ডিফেন্সে অবস্থান করতে বলেন। ক্যাপ্টেন করিমও তাঁর কোম্পানি নিয়ে মাহফুজুরের সঙ্গে মদুনাঘাট ডিফেন্সে অবস্থান গ্রহণ করেন।
১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের পতনের পরে ইপিআর, পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৪৫০ জন সৈনিক কালুরঘাট থেকে পটিয়ায় একত্রিত হয়ে মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১২ই এপ্রিল তাঁরা বান্দরবানে পৌঁছান এবং সেদিনই তাঁরা কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছে ডিফেন্স গ্রহণ করে মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করেন। অন্যদিকে লে. মাহফুজুর রহমান ক্যাপ্টেন করিমকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে চললেও এক পর্যায়ে তাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে রাউজানের নোয়াপাড়ায় নতুন ডিফেন্স নেয়ার পর সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সফলভাবে ডিফেন্স গ্রহণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ১৪ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন করিমসহ তিনি তাঁর অধীনস্থ ২০০-র অধিক সৈনিক নিয়ে মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে তাঁর সঙ্গে মহালছড়িতে একত্রিত হন। এখান থেকে মাহফুজুর রহমান এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে রাঙ্গামাটির বুড়িঘাট বাজারে ডিফেন্স গ্রহণ করেন। এখানেও তাঁর সঙ্গে ক্যাপ্টেন করিম ছিলেন। আরো ছিলেন দুজন ছাত্রনেতা, সুবেদার খায়রুজ্জামান, দুজন বেসামরিক কর্মকর্তা, কেপিএমের কেমিক্যাল প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইসহাক ও চন্দ্রঘোনার খ্যাতিমান ফুটবলার মারি-। মদুনাঘাট ডিফেন্স ও যুদ্ধ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রামগড়ের যুদ্ধ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন করিম পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি লড়াইয়ে মাহফুজুরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে গমন করে সেখান থেকে ৭ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ গ্রুপটির নম্বর ছিল এফএফ-৭। গ্রুপটি চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হলেও এর ৫ জন সদস্য পালিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম শহরে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে ক্যাপ্টেন করিম পটিয়ার হুলাইন গ্রামে এডভোকেট জালাল উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন তাঁর গ্রুপের সদস্য- সংখ্যা তিনিসহ মাত্র ২। তাঁর গ্রুপের পালিয়ে যাওয়া ৫ জনের দুজনের নাম সোবহান ও ইউসুফ। ইউসুফ স্বাধীনতাবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলে যোগ দিয়ে তাকে ক্যাপ্টেন করিমের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করে। তখন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তা কার্যকর করা হয়) পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে রাউজানের নোয়াপাড়ায় ক্যাপ্টেন করিমের বাড়িতে হানা দেয়। তাদের সঙ্গে দলত্যাগী ইউসুফও ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা করিমকে খুঁজে না পেয়ে তাঁর ছোটভাই সিরাজুল ইসলামকে বন্দি করে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর একনিষ্ঠ অনুসারী ও চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজের ভাই আবদুল মজিদকেও নির্যাতন চালানো হয়। সিরাজুল ইসলামকে নির্যাতন চালানোর পর কোতোয়ালী থানায় সোপর্দ করে কারাগারে প্রেরণ করা হলে তিনি প্রায় দেড়মাস পর সেখান থেকে ছাড়া পান। এরপর তিনি পটিয়ায় এসে ক্যাপ্টেন করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর বাহিনীতে যোগ দেন।
ক্যাপ্টেন করিমের পূর্বে পটিয়ার করণখাইনের অধিবাসী অধ্যাপক শামসুল ইসলাম বগাফা বিএসএফ সেন্টার থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটি গ্রুপ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর দুর্বল নেতৃত্ব ও অদূরদর্শিতার কারণে গ্রুপটি অচিরেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে করিমের সঙ্গে অধ্যাপক শামসুল ইসলাম সাক্ষাৎ করে উভয়ের আলোচনার ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন করিমকে প্রধান করে ১৩ জনের একটি গ্রুপ গঠিত হয়। এ-সময় আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার ও অনিল লালার সঙ্গে ক্যাপ্টেন করিমের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
এক পর্যায়ে বেঙ্গুরায় দেলা মিঞার বাড়ির সম্মুখে -রাজাকার-দের আক্রমণে ক্যাপ্টেন করিম গুলিবিদ্ধ হন। তাঁরই বাহিনীর সদস্য মনসা গ্রামের ডা. নুরুল ইসলাম ও বিনিহারা গ্রামের ডা. শামসুল আলমের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি বুধপুরা হাসপাতালের ডা. এম এন রায়ের বাসায় ও পেরপেরা গ্রামের ব্রজেন্দ্র লাল বর্দ্ধনের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এঁরা দুজনও তাঁর বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তখন তাঁর গ্রুপটি বেশ বড় আকার ধারণ করে। আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, আহমদ শরীফ মনির, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম ও ডা. শামসুল আলমের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে চন্দনাইশ, পটিয়া, কর্ণফুলী, আনোয়ারা, বোয়ালখালী, রাউজান, হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়া থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৪০০-র অধিক মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন করিম গ্রুপকে বিশাল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত করে।
করিম বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম নিজে ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন নায়েক আজিজুল হক (পিতা আবদুল হাকিম, শাহমীরপুর, কর্ণফুলী) এবং অপারেশন কমান্ডার ছিলেন নায়েক আজিজুল হক, হাবিলদার গোলামুর রহমান (চাতরি, আনোয়ারা), হাবিলদার নুরুল আলম (গৈড়লা, পটিয়া), হাবিলদার নুরুন্নবী (চরকানাই, পটিয়া), হাবিলদার আবদুল লতিফ, সুবেদার সোলায়মান (হুলাইন, পটিয়া) ও কর্পোরাল জাফর (নোয়াপাড়া, রাউজান)। করিম বাহিনীর সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, আহমদ শরীফ মনির ও ডা. শামসুল আলম এবং প্রশিক্ষক ছিলেন নায়েক আজিজুল হক, হাবিলদার গোলামুর রহমান, হাবিলদার নুরুল আলম, হাবিলদার নুরুন্নবী (চরকানাই, পটিয়া), হাবিলদার আবদুল লতিফ, ল্যান্স নায়েক মোতালেব ও সুলতান আহমদ।
করিম বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন পটিয়া ও কর্ণফুলীর আবদুর রহমান, রুস্তম আলী, নুরুল আমিন-১, নুরুল আমিন-২, মোহাম্মদ ইসহাক, মোহাম্মদ আলী মাস্টার, আবুল হোসেন মাস্টার, রফিক (বুধপুরা), আবদুল (বুধপুরা), জাহেদুল হক, মীর মোহাম্মদ, মুন্সী মিয়া, আলী আকবর, দানা মিয়া, আবুল কালাম, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ ইউসুফ (গোরনখাইন), আনসার কমান্ডার মুন্সী মিয়া, বদিউজ্জামান (বরলিয়া), তেমিয় বড়ুয়া (পিঙ্গলা), আহমদ হোসেন মেম্বার (উত্তর দেয়াঙ), ইদ্রিস মাস্টার, শেখ বদি, মোজাম্মেল হক, সিদ্দিক মেম্বার, আহমদ ছফা (দ্বারক), ব্রজেন্দ্র লাল বৰ্দ্ধন (পেরপেরা), জাফর আহমদ (হরিণখাইন), আনসার কমান্ডার গোলাম রশিদ, নুরন্নবী (আশিয়া), অমিয় বড়ুয়া (কর্তালা), উপগুপ্ত বড়ুয়া, নাসিরউদ্দিন শরীফ (পেরলা), মোজাহেরুল হক চৌধুরী (বরলিয়া), আবুল কাশেম (বরলিয়া), অনিল লালা (গৈড়লা), আবদুশ শুক্কুর (মালিয়ারা), নুরুল আনোয়ার (জিরি), ইসহাক (জিরি), আবুল বশর চৌধুরী (জিরি), ফজল আহমদ (জিরি), রুহুল আমিন, জহির আহমদ (সাইদাইর), রুহুল আমিন মথু (বিনিনিহারা), ইবরাহিম মিয়া (গৈড়লা), আবু সুলতান (এয়াকুবদণ্ডি), যদু গোপাল বৈঞ্চব, মনজুর, বারিক, জামাল উদ্দিন খান (পিঙ্গলা), ডা. মিলন বড়ুয়া (পিঙ্গলা), রাজমোহন বড়ুয়া (পিঙ্গলা), অনিল বড়ুয়া (পিঙ্গলা), দুলাল বড়ুয়া (পিঙ্গলা), মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরী, প্রদ্যোৎ কুমার পাল দুলাল (মঠপাড়া), মোয়াজ্জেম হোসাইন চৌধুরী (হুলাইন), আবুল হাশেম মাস্টার, নিজামুল হক (মনসা), আবুল কাশেম (মনসা), আবদুস সালাম (মনসা), রফিক, নূর হোসেন, আহমদ নবী (হুলাইন), মাহফুজুর রহমান খান (হুলাইন), জামাল (বরলিয়া), এম এন ইসলাম (পিতা ইসহাক মিয়া, জুলধা), মোহাম্মদ মুছা (চরলক্ষ্যা), আবদুস সবুর (চরলক্ষ্যা), নুর আহমদ (দক্ষিণ শাহমীরপুর), মোহাম্মদ মুসা (পিতা আবুল হোসেন, শাহমীরপুর), শাহাদুল হক (পিতা হাজি আহমদুর রহমান, দক্ষিণ শাহমীরপুর), নুরুল আলম (শাহমীরপুর), নায়েক শামসুল ইসলাম (দৌলতপুর), শামসুল আলম (পিতা আবদুল জব্বার, দৌলতপুর), আবু তাহের বাঙালি (পিতা মোহাম্মদ শরীফ, দৌলতপুর), কামাল উদ্দিন চৌধুরী (পিতা আবদুন নূর চৌধুরী, শাহমীরপুর), লিয়াকত আলী খান (পিতা মাহবুব আলী খান, দৌলতপুর), নূর হোসেন (পিতা হাজি মো. শরীফ, দক্ষিণ শাহমীরপুর), আবদুর রশিদ (দক্ষিণ শাহমীরপুর), গোলাম শরীফ (দক্ষিণ শাহমীরপুর), নুরুজ্জামান (বড়উঠান) ডা. সাত্তার (বড়উঠান); বোয়ালখালীর আ হ ম নাসির উদ্দিন, ল্যান্স নায়েক ওবায়েদ, নেভাল সদস্য জহির আহমদ (সারোয়াতলী), আবুল মনসুর সিদ্দিকী (সারোয়াতলী), পীযূষ রক্ষিত, এখলাস (আহলা), জলিল, আমির আহমদ, এস এম সেলিম, সুজিত নাগ (সারোয়াতলী), আজিম; আনোয়ারার আনসার কমান্ডার বজল আহমদ (কৈনপুরা), হাবিলদার আহমদ উল্লাহ (চাতরি), হাবিলদার আজিম (চাতরি), হাবিলদার শাহ আলম (চাতরি), ইমাম শরীফ (গুয়াপঞ্চক), আবুল হাশেম, আবদুল কাদের (চাতরি); রাউজানের সিরাজুল ইসলাম (ক্যাপ্টেন করিমের ছোট ভাই), ডা. শাহনেওয়াজ বাবুল, ল্যান্স নায়েক ইসহাক, ইদ্রিস (বাগোয়ান)।
করিম বাহিনীতে পটিয়ার ৬ জন ডাক্তার ছিলেন। তাঁরা হলেন ডা. শামসুল আলম (বিনিনিহারা), ডা. নুরুল ইসলাম (মনসা), ডা. এম এন রায় (বুধপুরা হাসপাতাল), ডা. শৈবাল দাশ (মহিরা), ডা. বদিউর রহমান (ধলঘাট হাসপাতাল) এবং ডা. উজির উদ্দিন চৌধুরী (হুলাইন)।
করিম বাহিনী পটিয়ায় তিনটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। চরলক্ষ্যা, শাহমীরপুর, দৌলতপুর, মুকুটনাইট, হাবিলাসদ্বীপ ও বড়উঠান নিয়ে একটি; কাশিয়াইশ, পিঙ্গলা, মহিরা, বুধপুরা, কুসুমপুরা, জিরি, কর্তালা ও বিনিনিহারা নিয়ে একটি এবং ধলঘাট, কেলিশহর, নাইখাইন ও গৈড়লা নিয়ে একটি। এছাড়াও বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া ও রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় এ বাহিনীর অনেক ক্যাম্প ও শেল্টার ছিল। এ বাহিনীর বৃহৎ ক্যাম্প ছিল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া, সরফভাটা ও শিলক এলাকায়। চট্টগ্রাম শহরে এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য শেল্টার হলো নতুন চাক্তাইয়ের লিয়াকত রাইস মিল, আগ্রাবাদের হাজিপাড়ার জালাল উদ্দিনের বাড়ি এবং পাথরঘাটার নজু মিয়া লেইনের হাজি শরিয়ত উল্লাহ্র বাড়ি। নতুন চাক্তাইয়ের লিয়াকত রাইস মিলকে অস্ত্রের শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
করিম বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে শতাধিক অপারেশন পরিচালনা করে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৈয়গ্রাম বাজারস্থ টানা ব্রিজ অপারেশন, ধলঘাট স্টেশনে রেল অপারেশন, জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন (যৌথ অপারেশন), চাপড়া রাডার স্টেশন অপারেশন, কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ি অপারেশন, বোয়ালখালী থানা অপারেশন, চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন কাউন্সিল অপারেশন, বড় উঠান ডাকপাড়া রাজাকার অপারেশন, পোমরা পাওয়ার লাইন অপারেশন (যৌথ অপারেশন) এবং রাঙ্গুনিয়া বিদ্যুৎ টাওয়ার অপারেশন। চট্টগ্রাম শহরের নিউমার্কেট, সিটি কলেজ, কোর্ট বিল্ডিং, খাতুনগঞ্জ, সদরঘাট, জুবিলী রোড, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও চকবাজার এলাকায় এ বাহিনীর গ্রেনেড হামলা উল্লেখযোগ্য। কৈয়গ্রাম বাজারস্থ টানা ব্রিজ অপারেশন সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে। সন্ধ্যার সময় পটিয়া উপজেলার জিরি ইউনিয়নের কৈয়গ্রাম বাজারে শিকলবাহা খালের ওপর নির্মিত ব্রিজটি করিম বাহিনীর যোদ্ধারা ধ্বংস করতে গেলে সেখানে রাজাকারদের সঙ্গে তাঁদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। অনেকক্ষণ যুদ্ধ চলার পর রাজাকাররা পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা আগুন লাগিয়ে রাত ৯টার মধ্যে ব্রিজটি ধ্বংস করতে সক্ষম হন। পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার বা দালালদের চলাচল ও কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করার জন্যই ব্রিজটি ধ্বংস করা হয়। এছাড়া ব্রিজের এপাড় ওপাড় জুড়ে বাজার এলাকায় রাজাকার-দালালদের অনেক দোকান-পাট ও বাড়ি-ঘরও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
২৫শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নে করিম বাহিনীর যোদ্ধারা চাপড়া রাডার স্টেশন অপারেশন পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা রাডার স্টেশনের ৫০০ গজের মধ্যে পৌঁছে সেখান থেকে ক্রলিং করে রাডার স্টেশনের প্রধান ফটকে পৌঁছান। তখন ফটকে প্রহরারত রাজাকাররা তাঁদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও রাজাকারদের দিকে গুলিবর্ষণ করেন। প্রায় এক ঘণ্টার অধিককাল ভয়াবহ যুদ্ধ চলার পর দুজন রাজাকার নিহত হলে অন্য রাজাকাররা পালিয়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা রাডার ধ্বংস করে ১২টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল উদ্ধার করে গন্তব্যে প্রস্থান করে।
একই দিন সন্ধ্যায় করিম বাহিনীর আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কালারপুল পুলিশ ফাঁড়ি অপারেশন পরিচালনা করেন। কালারপুল পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় ঐ আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন, এমনকি প্রতিরোধযুদ্ধের সময় এ ফাঁড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চললেও, ১৬ই এপ্রিল পটিয়ার পতনের পর ঐ পুলিশ ফাঁড়ি রাজাকার-মুজাহিদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কিছু পুলিশ সদস্যও তাতে যোগ দেয়। তারা কালারপুলসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রতিনিয়ত অত্যাচার, নির্যাতন ও লুটতরাজ চালাত। এ-কারণে ক্যাপ্টেন করিম সেখানে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁড়িতে পৌঁছে আক্রমণ রচনা করলে সেখানে অবস্থানরত রাজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ সদস্যরাও তাঁদের দিকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। প্রায় দুঘণ্টা এ যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ২ জন রাজাকার ও ২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হলে বাকিরা পালাতে শুরু করে। ফাঁড়িতে এ- সময় কোলাগাঁও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সোনা মিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গ্রেপ্তার করেন। ফাঁড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ১২টি রাইফেল ও ২টি স্টেনগান উদ্ধার করেন।
২৭শে সেপ্টেম্বর ভোররাতে ধলঘাট স্টেশনে রেল অপারেশন সংঘটিত হয়। করিম বাহিনীর ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার নুরুল আলমের নেতৃত্বে রাতে ধলঘাট রেলস্টেশনে পৌঁছান। প্রতিদিনের মতো চট্টগ্রাম শহর থেকে দোহাজারী অভিমুখে যাওয়া শেষ ট্রেনটি ভোররাতে ধলঘাট স্টেশনে পৌঁছলে হাবিলদার নুরুল আলমের নির্দেশে মুক্তিযাদ্ধারা ট্রেনটি থামিয়ে যাত্রী, ড্রাইভার ও গার্ডদের নামিয়ে দিয়ে সশস্ত্র ১০ জন পুলিশকে বন্দি করেন এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বারুদ ব্যবহার করে ট্রেনের ইঞ্জিনটি ধ্বংস করে দেন। অতঃপর বন্দি ১০ জন পুলিশ ও তাদের অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা দেন। করিম বাহিনীর সঙ্গে মহিউল আলম বাহিনী এবং সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপের ও অনেক মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। ভারত থেকে ৩৬টি গ্রুপের প্রধান এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার নিযুক্ত করে ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমকে বাংলাদেশে পাঠানোর সময় তাঁর হাতে ক্যাপ্টেন করিমের জন্য একটি চিঠি প্রদান করা হয়। চিঠিতে বলা ছিল— ক্যাপ্টেন করিম যেন তাঁর সব দায়িত্ব ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমকে বুঝিয়ে দিয়ে ১নং সেক্টরে গিয়ে রিপোর্ট করেন। চিঠিটি করিমের হস্তগত হলেও তিনি সে নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেন। পরে একই নির্দেশ প্রদান করে আরো দুবার ১নং সেক্টর থেকে চিঠি পাঠানো হলেও ক্যাপ্টেন করিম সে নির্দেশ পালন করা থেকেও বিরত থাকেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, ১নং সেক্টর ও ক্যাপ্টেন করিমের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে রাঙ্গুনিয়া থানার বিএলএফ কমান্ডার নুরুল আলমের হাতে ক্যাপ্টেন করিম ও তাঁর সঙ্গী ইব্রাহিম নিহত হন। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!