You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে করিমগঞ্জ উপজেলা (কিশোরগঞ্জ)

করিমগঞ্জ উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে চলমান অসহযোগ আন্দোলন – এবং ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে করিমগঞ্জের লোকজন স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়। ১১ই মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগ-এর সভাপতি ও থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. হারুন-অর- রশিদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার করিমগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অতঃপর ১৯শে মার্চ করিমগঞ্জ স্কুল মাঠে এক বিশাল সমাবেশে তিনি পুনরায় স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। উক্ত সমাবেশে মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ছাত্রলীগ সভাপতি মো. ফজলুল হক পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। পরদিন ছাত্রলীগ নেতারা থানা পর্যায়ের সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, দোকানপাট ও বাসাবাড়ি থেকে আইয়ুব খানের ছবি অপসারণ করেন।
এরপর উপজেলায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন আবুল হাশেম চৌধুরী (সভাপতি, করিমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ) এবং সম্পাদক স্থানীয় ন্যাপ- নেতা খুর্শেদ উদ্দিন। তাঁদের নির্দেশনায় প্রায় প্রতিটি হাইস্কুল মাঠে বাঁশের লাঠি দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পর করিমগঞ্জে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৬শে মার্চ সকালে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতাদের কাছে খবর আসে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী তারা যেন অতিসত্বর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। এর ফলে অনেক নেতাই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে করিমগঞ্জ ত্যাগ করেন এবং সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে প্রশিক্ষণ নেন। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত আরো অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যান।
করিমগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং থানা কমান্ডার হিসেবে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— এডভোকেট আব্দুস সাত্তার এমপিএ (কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচিত), আব্দুল কুদ্দুছ মোক্তার এমপিএ (করিমগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত), আবুল হাশেম চৌধুরী (সভাপতি, করিমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ), আব্দুর রহিম শেখ (সহ-সভাপতি, করিমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ), শেখ তারু মিয়া (সহ-সভাপতি, করিমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ), মো. জোনাব আলী (সেক্রেটারি, করিমগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় মুজিব বাহিনী-র প্রধান), জমিয়ত আলী (ন্যাপ নেতা), খুর্শেদ উদ্দিন (ন্যাপ নেতা), ছাইদুর রহমান ভূঁইয়া (ন্যাপ নেতা), ডা. আব্দুস ছোবহান (পিতা আইনউদ্দিন মুন্সি, মুসলিম পাড়া, জঙ্গলবাড়ি), হারুন-অর-রশিদ (সভাপতি, করিমগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ), মো. ইকবাল (প্রচার সম্পাদক, করিমগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ), রুস্তম আলী (সদস্য, করিমগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ), ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস, আলী আজগর, মোশাররফ হোসেন নীলু মিয়া, এ বি ছিদ্দিক (রামনগর), শেখ কবির আহমদ, মো. আলাউদ্দিন, শেখ শরফউদ্দিন প্রমুখ। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এলাকার সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁদের মধ্যে মেজর এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম- (কান্দাইল; ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ২ নং সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), সেতারা বেগম, বীর প্রতীক- (কান্দাইল; মেজর হায়দারের কনিষ্ঠ বোন এবং আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন; ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল স্থাপনে তিনি ভূমিকা রাখেন এবং অসুস্থ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজ ভূঞা (টামনি গুজাদিয়া; মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে সিলেট জেলার দুর্গাপুর থেকে ডাউকি (তামাবিল) এবং জেলার পূর্বসীমা নিয়ে গঠিত ৫ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা)-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হানাদার বাহিনী ১৯শে এপ্রিল কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদরে এবং পরদিন ২০শে এপ্রিল করিমগঞ্জ থানা সদরে প্রবেশ করে। থানায় এসে তারা স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের (তাদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারী) দমন করার ব্যাপারে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয় এবং সেদিনই আবার মহকুমা সদরে ফিরে যায়। করিমগঞ্জে তাদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধকালে করিমগঞ্জ থানায় মুসলিম মুসলিম লীগ- জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি- (<পিডিপি~) এবং <নেজামে ইসলামী স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এসব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি . -রাজাকার- ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা ছিল- আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান (করিমগঞ্জ; থানা মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির সভাপতি), মৌলবি লোকমান হাকিম ওরফে লোকমান মৌলবি (খয়রত; শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), তোহা মৌলবি (ভাটিয়া; শান্তি কমিটির সহকারী সেক্রেটারি), আবু তাহের সরকার, আব্দুল মান্নান (চরপাড়া), এ টি এম নাসির উদ্দিন (রাজাকার কমান্ডার), মোস্তফা মৌলবি (দেহুন্দা), তালে হোসেন (কুর্শাখালি; আলবদর কমান্ডার), মোছলেহ উদ্দিন মাস্টার (পশ্চিম জাফরাবাদ; জামায়াত নেতা), মাহবুব মৌলবি (দেহুন্দা; পিডিপি নেতা), ছালাম মেম্বার (জামায়াত নেতা) প্রমুখ। পাকবাহিনীর নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিক আবদুল মান্নানকে প্রধান করে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। থানার অনেক তরুণ এ বাহিনীতে যোগ দেয় (যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজাকার কমান্ডার আবদুল মান্নান ও এ টি এম নাসির উদ্দিনের ফাঁসির আদেশ হয়)। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে জামায়াত নেতা তালে হোসেনকে প্রধান করে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীতেও করিমগঞ্জের অনেক যুবক যোগ দেয়।
রাজাকারের থানা কমান্ডার আবদুল মান্নান ও কোম্পানি কমান্ডার এ টি এম নাসির উদ্দিনের নির্দেশে করিমগঞ্জের রাজাকার বাহিনী হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করে। পাকবাহিনীর সহায়তায় তারা জাফরাবাদ, কান্দাইল, রামনগর, ন্যামতপুর, গুনধর, আতকাপাড়া, করিমগঞ্জ সদর, কাদিরজঙ্গল প্রভৃতি এলাকায় বিশেষত হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এসব অপকর্মে রাজাকারদের সহযোগী ছিল মোস্তফা মৌলবি (দেহুন্দা), আজাহার মৌলবি (গুজাদিয়া), তোহা মৌলবি (ভাটিয়া), আবদুল হাফিজ (খুদিরজঙ্গল), শামছুদ্দিন প্রমুখ। শান্তি কমিটির নেতারা জাফরাবাদসহ বিভিন্ন গ্রামের দরিদ্র হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। করিমগঞ্জে রাজাকার কমান্ডার এ টি এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে আয়লা ও বিদ্যানগরসহ কয়েকটি গ্রামে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। রাজাকার মোস্তফা মৌলবিও ছিল নাসির উদ্দিনের মতো অমানবিক ও দুর্ধর্ষ। সে অন্তত ৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা ও ৩ জন নারীকে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়ে করিমগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটায়। নাসির ও মান্নান বাহিনীর সদস্যরা জাফরাবাদ, সাহাপাড়া, রামনগর, মাদারিখলা, জাটিয়াপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের যুবতী মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। জাফরাবাদ ইউনিয়নের সাহাপাড়া, জয়কা ইউনিয়নের দক্ষিণ কান্দাইল, গুনধর ইউনিয়নের কয়েকটি বাড়ি, ন্যামতপুর ইউনিয়নের পালবাড়ি, রামনগরের মুক্তিযোদ্ধা আনিস ফকির ও আঃ ছাত্তারের বাড়িসহ অন্তত ১২০টি বাড়িতে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সহযোগীরা অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
করিমগঞ্জ থানায় বিশেষ কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ছিল না। যাদের ধরে আনা হতো তাদের কিশোরগঞ্জ সেনাক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সেখান থেকে কেউ আর জীবিত ফিরে আসতে পারেনি।
করিমগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি যুদ্ধ হয় – বালিয়াবাড়ির যুদ্ধ-, দেহুন্দা-গুদারাঘাট যুদ্ধ ও আয়লা-বিদ্যানগর যুদ্ধ। বালিয়াবাড়িতে ১২ই আগস্ট ও ৯ই ডিসেম্বর দুবার যুদ্ধ হয়। প্রথমবারের যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দেহুন্দা-গুদুরাঘাট যুদ্ধ হয় অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এদিন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর উভয় বাহিনী পিছু হটে। আয়লা- বিদ্যানগর যুদ্ধ হয় ১০ই নভেম্বর। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
১৪ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে করিমগঞ্জ থানার রাজাকার বাহিনী গোপনে করিমগঞ্জ ত্যাগ করে কিশোরগঞ্জ চলে যায়। ফলে এদিনটিকেই করিমগঞ্জ মুক্তদিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম, আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম- ও সেতারা বেগম, বীর প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে এ উপজেলার মোট ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ বরণ করেন। তাঁরা হলেন- লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম (হাত্রাপাড়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র; ২০শে নভেম্বর কুড়িগ্রাম জেলাধীন ভুরুঙ্গামারি উপজেলার জয়মণিরহাট গ্রামে একটি সেতু দখলের যুদ্ধে শহীদ), এ বি ছিদ্দিক (রামনগর; ২৭শে নভেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার মঙ্গলকাটার যুদ্ধে পাকসেনাদের নির্যাতনে শহীদ), আবদুর রশিদ (হাত্রাপাড়া; কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র; ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার সময় স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের হাতে ধরা পড়েন এবং কিশোরগঞ্জ শহরে পাকসেনাদের হাতে সোপর্দ করলে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়), হাবিলদার আব্দুল মালেক (পিতা আব্দুর রহিম, নানশ্রী), ডা. আব্দুস ছোবহান (পিতা আইনউদ্দিন মুন্সি, মুসলিম পাড়া, জঙ্গলবাড়ি), সৈয়দ মহিউদ্দিন (~মুজিবনগর সরকার-এর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর বংশধর), মো. গোলাম মুর্শিদ (সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কাজ করতেন), হাবিলদার মুখলেছুর রহমান (পিতা মরছব আলী, নোয়াবাদ), আব্দুল কুদ্দুছ, আব্দুর রশিদ (পিতা মোহাম্মদ আলী লতু, হাত্রাপাড়া), আব্দুল খালেক (পিতা ছৈয়দ আলী, করিমগঞ্জ সদর) ও মো. নূরুল ইসলাম খালেক (পিতা আব্দুল মজিদ, হাত্রাপাড়া)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে করিমগঞ্জ থানার জয়কা ইউনিয়নের একটি বাজারের নাম জয়বাংলা বাজার রাখা হয়েছে। এছাড়া হাত্রাপাড়ায় লেফটেন্যান্ট মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম-এর স্মরণে তাঁর নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে সামাদনগর উচ্চ বিদ্যালয়। আশফাকুস সামাদের জন্ম হাত্রাপাড়ায় হলেও তিনি ছোট খাটমারি গ্রামে এক সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তাই তাঁর নামে ঐ গ্রামের নাম রাখা হয় সামাদনগর। [সালেহ্ আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!