কয়ড়া-চরপাড়া যুদ্ধ
কয়ড়া-চরপাড়া যুদ্ধ (ধনবাড়ি, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ২২শে সেপ্টেম্বর। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেশকিছু সদস্য হতাহত হয় এবং অন্যরা ধনবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের হাতে আটক ও পরে শহীদ হন।
ধনবাড়ি-জামালপুর সড়ক থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ধনবাড়ি-পিংনা সড়কের পাশে কয়ড়া- চরপাড়া গ্রাম। ২২শে সেপ্টেম্বর কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গালের নেতৃত্বে তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে কয়ড়া- চরপাড়া নামক স্থানে এক সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর পূর্বে ১৫ই সেপ্টেম্বর কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ গোপালপুরের ভেঙ্গুলাতে নিয়ে আসেন। সেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের নিরাপত্তা বিধান করা, জামালপুর-মধুপুর সড়কে চলাচল করা পাকিস্তানি বাহিনীর গতিরোধের জন্য বিস্ফোরক দিয়ে সব ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া এবং ধনবাড়ি থেকে পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী যাতে যাতায়াত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পড়ে হুমায়ুন বাঙ্গালের ওপর। এ অবস্থায় হুমায়ুন বাঙ্গাল পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করার উপযুক্ত স্থান হিসেবে কয়ড়া খেয়াঘাটকে বেছে নেন। ২০শে সেপ্টেম্বর রাতে প্লাটুন কমান্ডার নূরুল ইসলাম পান্নার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে কয়ড়া খেয়াঘাটে ডিফেন্সে রাখেন। তাঁরা কয়ড়া খেয়াঘাট, প্রাইমারি স্কুল ও তার আশপাশে স্বেচ্ছাসেবক নাজমুল হক ও কালু মল্লিকের সহযোগিতায় কয়েকটি বাঙ্কার করে অবস্থান নেন। অন্যান্য প্লাটুন কমান্ডারদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে তিনি ২১শে সেপ্টেম্বর রাতে আরো দুটি প্লাটুনকে কয়ড়ায় গিয়ে নূরুল ইসলাম পান্নার প্লাটুনের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন, অর্থাৎ সেখানে তিন প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেবে। এক প্লাটুন কয়ড়ায় অবস্থান করবে, এক প্লাটুন নৌকাযোগে বান্দ্রা খাল দিয়ে চেরাভাঙ্গা ব্রিজে যাবে এবং তৃতীয় প্লাটুন পাইস্কা হয়ে কুইচামারা খাল দিয়ে কুইচামারা ব্রিজে যাবে। দুটি গ্রুপ বিস্ফোরক দিয়ে চেরাভাঙ্গা ও কুইচামারা ব্রিজ উড়িয়ে দেবে। কয়ড়ায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা রাত ৯টার পর খেয়া পারাপার বন্ধ করে দিতেন এবং দুটি খেয়া নৌকা ঘাটের দক্ষিণ তীরে এনে সরিয়ে রাখতেন। ২১শে সেপ্টেম্বর রাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অগোচরে কে বা কারা ২২শে সেপ্টেম্বর ভোর রাতে খেয়া নৌকা দুটি খালের উত্তর পাড়ে নিয়ে যায়। ঐ খেয়া নৌকাযোগেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-রা নীরবে নদীর দক্ষিণ তীরে পৌছেই অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। এতে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় বেশ কয়েকজন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে নিহত ও আহতদের নিয়ে খেয়া পার হয়ে ধনবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। অতঃপর কমান্ডারের নির্দেশে কয়ড়ায় অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে অন্যরা বলিভদ্র হয়ে কেরামজানী চলে যান।
মুক্তিযোদ্ধারা দুপুরের খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে কয়ড়া থেকে খবর আসে যে, পালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যরা ধনবাড়িতে গিয়ে মধুপুর ও জামালপুর হানাদার ক্যাম্পে যোগাযোগ করে বিশাল একটি গ্রুপ নিয়ে কয়ড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। এ সংবাদ পাওয়ামাত্র কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশে খাওয়া-দাওয়া ফেলে মুহূর্তেই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল চাতুটিয়া হলদিবাড়িতে অবস্থান নেয়া প্লাটুন কমান্ডার নান্নুকে সংবাদ পাঠান অতিসত্ত্বর তাঁর প্লাটুন নিয়ে চরপাড়ায় চলে আসতে। অল্প সময়ের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার নিজেও তাঁর সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরপাড়া কবরস্থান মোড়ে পৌঁছেন। একই সঙ্গে কয়ড়ার গ্রুপ চরপাড়ায় এসে পৌঁছায়। চাতুটিয়ার হলদিবাড়ি থেকেও নান্নুর গ্রুপ এসে যোগ দেয়। কোম্পানি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি গ্রুপে ভাগ করে তিন দিকে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন। প্লাটুন কমান্ডার মজনু মিয়াসহ তাঁর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গালের সঙ্গে রাখা হয়। প্লাটুন কমান্ডার নান্নুর নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা চরপাড়া কবরস্থানের একটু দক্ষিণে মসজিদ সংলগ্ন ছোট্ট একটি খাল পার হয়ে সোজা চরপাড়ার পূর্বপ্রান্তে ফসলি জমিতে অবস্থান নেয়। প্লাটুন কমান্ডার আবদুস সোবহান তুলার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা চরপাড়া প্রাইমারি স্কুল ঘেঁষে উত্তর দিকে খালপাড় হয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তানি বাহিনী কয়ড়া খেয়া পার হয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি ছুড়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। হানাদাররা যে রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, সে রাস্তাটি ধনুকের মতো বাঁকা। রাস্তার পূর্বপাশেই চরপাড়া গ্রাম। বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আর একটা লাগোয়া। কোথাও ফাঁকা নেই। গ্রামের সামনে বিস্তীর্ণ ধানি জমি। ধানক্ষেতে সামান্য পানি। সেই ধানি জমিতেই অবস্থান নেয় প্লাটুন কমান্ডার নান্নুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় গ্রুপটি। তাঁদের অবস্থান থেকে ধনুকের বাঁকের মতো রাস্তার পূর্ব মাথায় আটাপাড়া-বটতলা নামক স্থানের ফাঁক দিয়ে সবকিছু দেখা গেলেও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থানকারী কোম্পানি কমান্ডারের গ্রুপ সামনের বাড়িগুলোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীও হয়তো তাদের কোনো গ্রুপকে দেখতে পাচ্ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী কোন পর্যন্ত অগ্রসর হচ্ছে তাও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দেখতে কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল বাইনোকুলার ও বিউগল (কোম্পানি কমান্ডার যুদ্ধ শুরুর সংকেতস্বরূপ বিউগল বাজাতেন) হাতে চরপাড়া কবরস্থানের একটি বটগাছের মগডালে ওঠেন। কিন্তু চরপাড়ার বাড়িগুলোর জন্য শত্রুপক্ষকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। শুধু গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার ওপেন করার সংকেতের অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ শত্রুপক্ষের গুলি ছোড়া থেমে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার জন্য কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম (পিতা আবদুল হক সুতার, মুশুদ্দি পশ্চিমপাড়া, গোপালপুর) একটি গ্রেনেড় তাঁর কোমরে গুঁজে রওনা হন। হঠাৎ তিনি শত্রুবাহিনীর অগ্রগামী দলের একেবারে সামনে পড়ে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ হানাদার বাহিনীকে লক্ষ করে গ্রেনেড ছোড়েন। এমতাবস্থায় যুদ্ধ শুরুর সংকেতস্বরূপ বিউগল বেজে ওঠে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার ওপেন করেন। একই সঙ্গে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে গুলি ছুড়ছেন। তাঁদের গুলির আঘাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি আবদুস সালামের পায়ে বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। শত্রুপক্ষের অগ্রগামী দলের হাতে আবদুস সালাম ধরা পড়েন।
পাকিস্তানি হানাদাররা বটতলা-আটাপাড়ার মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছামাত্রই নান্নুর গ্রুপের ব্রাশ ফায়ারে টিকতে না পেরে পাশের একটি রাস্তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাস্তা সংলগ্ন উত্তর পাশের নিচু জমি দিয়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পূর্বের অবস্থান থেকে তাদের পেছনে-পেছনে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে কয়ড়া পর্যন্ত ধাওয়া করেন। ততক্ষণে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামসহ তাদের আহত- নিহতদের নিয়ে নদী পার হয়ে গাড়িতে উঠে ধনবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে-পেছনে কয়ড়া খেয়াঘাট পর্যন্ত যান। পরে জানা যায় হানাদাররা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সালামকে ধনবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে এবং নাক-কান কেটে জিপের সঙ্গে বেঁধে টানতে-টানতে নির্মমভাবে হত্যা করে।
কয়ড়া-চরপাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল (বেতডোবা, কালিহাতী), কোম্পানির টুআইসি মকবুল হোসেন (হামিদপুর, ঘাটাইল), প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস সোবহান তুলা (কোনাবাড়ী, গোপালপুর), প্লাটুন কমান্ডার হেদায়েত উল্লাহ (কড়িআটা, গোপালপুর), প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার শামসুল আলম (তেজপুর, কালিহাতী), প্লাটুন কমান্ডার নূরুল আমিন (পানকাতা, ধনবাড়ি), প্লাটুন কমান্ডার নূরুল ইসলাম পান্না (ফুলদহেরপাড়া, সরিষাবাড়ী), প্লাটুন কমান্ডার মজনু মিয়া (ঝাওয়াইল, গোপালপুর), শাহাদত হোসেন (মাইজবাড়ী, ঘাটাইল), আবুল হোসেন (মুক্তাগাছা, ময়মসিংহ), আনোয়ার হোসেন মটু (মামুদপুর, গোপালপুর), লাল মিয়া (কামার্তি, কালিহাতী), খোকা মাস্টার (চাতুটিয়া, গোপালপুর), আবদুল জলিল (চাতুটিয়া, গোপালপুর), আবদুল হাকিম (ভেঙ্গুলা, গোপালপুর), আজগর আলী (নন্দনপুর, গোপালপুর), আলাউদ্দিন খান (অর্জুনা, ভূঞাপুর), মুজাফফর আলী (নারুচি, গোপালপুর), রমজান আলী (নারুচি, গোপালপুর), বাদশা মিয়া (কড়িআটা, গোপালপুর), আবদুল মতিন (বামনহাটা, ভূঞাপুর), আজমত আলী (নলিন, গোপালপুর), আবদুর রাজ্জাক (নলিন, গোপালপুর), আজাহার আলী (পাছতেরিল্যা, ভূঞাপুর), জোয়াহের আলী খান (চিনামুড়া, কালিহাতী), আবদুল অদুদ (উত্তর গোপালপুর), মজিবর রহমান (উত্তর গোপালপুর), শ্যামল চন্দ্র দে (চরশিমলা, গোপালপুর), শাহজাহান আলী (চরশিমলা, গোপালপুর), আমিনুল ইসলাম (মজিদপুর, গোপালপুর), শাহজাহান আলী (কেরামজানী, গোপালপুর), খলিলুর রহমান (কড়িআটা, গোপালপুর), আবদুস সোবহান (বড়খালী, গোপালপুর), হাশেম আলী (বড়খালী, গোপালপুর), নজরুল ইসলাম (ফুলদহেরপাড়া, সরিষাবাড়ী), মজনু মিয়া (ফুলদহেরপাড়া, সরিষাবাড়ী), সুরুজ্জামান (ঘোড়ামারা, গোপালপুর), জাহাঙ্গীর আলম (আটিয়ামামুদপুর, মির্জাপুর), জহিরুল হক (হরিপুর, কালিহাতী), আবদুস সালাম (মুশুদ্দি পশ্চিমপাড়া, গোপালপুর; কয়ড়া-চরপাড়া যুদ্ধে শহীদ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড