কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউইয়র্ক-এর ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে পণ্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত অবিস্মরণীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান। এটি ছিল বিপন্ন বাংলাদেশীদের পাশে দাঁড়ানোর একটি অসাধারণ উদ্যোগ, যা সে সময় বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুলেছিল।
২৫শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা চরম আকার ধারণ করলে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রায় এক কোটি বাঙালি প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মহিলা এবং শিশু। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে শত-শত মানুষ মারা যাচ্ছিল। রবি শংকর তখন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানতে পেরে গভীরভাবে ব্যথিত হন। যুদ্ধপীড়িত মানুষের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে তিনি তাঁর বন্ধু ও শিষ্য জর্জ হ্যারিসনকে শরণার্থী সংকটের কথা জানালে, তা হ্যারিসনের মনকেও গভীরভাবে নাড়া দেয়। বিপন্ন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন এই কনসার্টের আয়োজন করেন।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ের খ্যাতনামা জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীগণ। তাঁদের এই লাইনআপকে বলা হতো সুপার গ্রুপ। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবি শংকরসহ ৭৫ জন শিল্পী ও কলাকুশলী এতে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আমেরিকার প্রতিবাদী শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার বব ডিলান (২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত), বিটলস-এর বিখ্যাত ড্রামার রিঙ্গো স্টার, খ্যাতনামা ব্রিটিশ গিটারিস্ট ও গায়ক ইরিক ক্লাপটন, গায়ক ও সুরকার লিওন রাসেল, জার্মান বেইজিস্ট ও আর্টিস্ট ক্লাউস ভোরম্যান, আমেরিকার বিখ্যাত সেশন ড্রামার জিস কেল্টনার, কিংবদন্তি সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খান, বিখ্যাত তবলাবাদক আল্লা রাখা খান, তানপুরা বাদক কমলা চক্রবর্তী (বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী)। এছাড়াও ছিলেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ব্যাডফিঙ্গার (Badfinger) ও দ্যা হলিউড হর্নস ব্যান্ড। নেপথ্য কণ্ঠে ছিলেন ডন নিক্স, জো গ্রিন, জেনি গ্রিন, ডলরেস হল, ক্লডিয়া লিনিয়ার এবং আরো অনেকে।
১লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য দুটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিটি চারঘণ্টা ব্যাপী প্রথম কনসার্টটি শুরু হয়েছিল দুপুরে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৭টায়। একদিনের মধ্যেই দুটি কনসার্টের সকল টিকেট (৪০ হাজার) বিক্রি হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এ অনুষ্ঠান কভার করতে আসা ইলেকট্রোনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকগণ এ কনসার্ট উদ্যোগের নেপথ্য কারণ জানতে পেরে আয়োজকদেরকে ১২ হাজার ডলার অনুদান প্রদান করেন।
দুভাগে বিভক্ত এ কনসার্টের শুরুতেই রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার করুণ চিত্র। এরপর মঞ্চে আসেন রবি শংকর। বাংলাদেশ কনসার্টের উদ্যোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াও তিনি অনুষ্ঠানের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি নতুন সুর। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তিনি এটি পরিবেশনা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কিংবদন্তি সরোদবাদক আলী আকবর খান, তবলায় আল্লা রাখা খান এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য জর্জ হ্যারিসন ও রবি শংকর)। এরপর একটি স্বল্প বিরতিতে নেদারল্যান্ডের একটি টিভি চ্যানেলের ধারণ করা ১৯৭০ সালের পূর্ব বাংলার ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাস, পাকিস্তান সরকারের চরম ঔদাসীন্য এবং মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতা ও গণহত্যার ফুটেজ দেখানো হয়। এসব ফুটেজ দেখে অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাগণ বাংলাদেশে চলমান সংকটের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জানতে পারেন।
এরপর মঞ্চে আসেন জর্জ হ্যারিসন। সকল দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করে পরিবেশন করেন তাঁর বিখ্যাত ৮টি গান, যার একটি ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান এ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন তাঁর জনপ্রিয় পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে লিওন রাসেল দুটি গান করেন, যার একটি বিলি প্রেস্টনের সঙ্গে। দুটি অনুষ্ঠানই শেষ হয় জর্জ হ্যারিসনের অসাধারণ গানটি দিয়ে-
My friend come to me,
with sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies.
…
Bangla Desh, Bangla Desh
…
Relieve the people of Bangladesh.
হ্যারিসনের নিজের লেখা এবং সুরে এ গানের আকুতি দর্শক- শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ শুধু আর্থিক সাহায্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা, চলমান গণহত্যার কথা, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর মানবেতর জীবনের কথা জানিয়ে দেয়া হয় বিশ্ববাসীকে; আর বাংলাদেশের পক্ষে তা বিশ্ব জনমত গঠন করে। এছাড়াও এ কনসার্ট বিশ্ব সঙ্গীতকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে। ৪০টি মাইক্রোফোনে ধারণকৃত বাংলাদেশ কনসার্টের গান এবং কথা লাইভ রেকর্ড করা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে ভিডিও এবং অডিও অ্যালবাম আকারে প্রকাশ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর এর অডিও অ্যালবামটি তিনটি লং প্লেয়িং গ্রামফোন রেকর্ডের মাধ্যমে মুক্তি পায়। ১৯৭২ সালে ডকুমেন্টারিসহ এই কনসার্টের ভিডিও অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে এই ভিডিও অ্যালবামটি মর্যাদাপূর্ণ গ্রামি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। ২০০৫ সালে Concert for Bangladesh Revisited with George Harrison and Friends শিরোনামে নতুন করে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ কনসার্ট অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটিতে রয়েছে গানের ধারণকৃত অনুষ্ঠান এবং অন্য একটিতে রয়েছে সুপার গ্রুপের বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎকার, যাতে কনসার্টের নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। এ সকল ভিডিও ও অডিও অ্যালবাম বিক্রির অর্থ জমা হয় ‘জর্জ হ্যারিসন ফাউন্ডেশন ফর ইউনিসেফ-এ এবং এখান থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের জরুরি স্বাস্থসেবা দেয়া হচ্ছে। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড