মুক্তিযুদ্ধে কবিরহাট উপজেলা (নোয়াখালী)
কবিরহাট উপজেলা (নোয়াখালী) ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি আন্দোলনেই নোয়াখালী জেলার কবিরহাটবাসী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এ বিজয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক চক্র দিশেহারা হয়ে পড়ে। নির্বাচনের ফলাফলকে বানচাল করার জন্য শুরু হয় চক্রান্ত। গোপনে ভুট্টোকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ এক ঘোষণায় ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণার পরপরই সমগ্র দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের ন্যায় কবিরহাটের জনগণও প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র ক্ষোভ ও চরম অসন্তোষ। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে ৩রা মার্চ দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। কবিরহাটের জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে৷ ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। একের পর এক ঘটনায় বাঙালি তার মূল লক্ষ্য স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। কবিরহাটের সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর নোয়াখালীতে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। ২৬শে মার্চ রাতে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে পেয়ে নোয়াখালী সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আব্দুল মালেক উকিল এমএনএ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের অবহিত করেন। এর ভিত্তিতে আব্দুল মালেক উকিল এমএনএ ঐদিন সকাল ১০টায় উপজেলার সার্কিট হাউজে সমবেত সর্বস্তরের জনগণকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এরপরই শুরু হয় নোয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধের জোরদার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। এ প্রস্তুতির ঢেউ কবিরহাট উপজেলাতেও এসে পড়ে। এখানকার মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইদ্রিছ মিয়া উপবিভাগীয় মহকুমা সভাপতি এম এ আজিজ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল হাই, আওয়ামী লীগ নেতা কাজী সফি, মোস্তফা ভূঁইয়া, দাউদ মাস্টার ও সৈয়দ মো. চৌধুরীর নেতৃত্বে কবিরহাট অঞ্চলের ছাত্রনেতারা সংগঠিত হন। কবিরহাট কলেজের ছাত্রলীগ- নেতা আবুল হোসেন, আবুল কালাম, শরাফত আলী, কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি কাজী আনোয়ার, জিএস নিজামউদ্দিন ফারুক ও আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে ছাত্র ও যুবসম্প্রদায় সংগঠিত হয়। হাজি মো. ইদ্রিছ মিয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতে গমন করে কবিরহাট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ ও অর্থ যোগানে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এডভোকেট মমিনউল্যা বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। তিনি এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যেতেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি নিজেও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালী ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ। নোয়াখালী রাজনগর সাব-সেক্টরের অধীন সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। রাজনৈতিক সংগঠক ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন নুরুল হক এমএনএ। অপরদিকে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)। কবিরহাট থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক ওহিদুর রহমান ওদুদ। ১৫ই নভেম্বর তাল মোহাম্মদের হাট যুদ্ধে তিনি শহীদ হওয়ার পর ডেপুটি কমান্ডার মো. আবুল কাশেম কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যান্য কমান্ডারগণ হচ্ছেন- জসীম উদ্দিন, মোশাররফ হোসেন, সুবেদার সামছুল হক ও রফিক।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবিরহাটের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রতিরোধ-সংগ্রামের পথে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে থাকে। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ছাত্র- যুবক ও সর্বস্তরের মানুষ দেশকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নেয়। স্থানীয় কবিরহাট কলেজ মাঠ, হাইস্কুল মাঠ, বানদব হাইস্কুল মাঠ, ভূঁইয়ার হাট ও ওটারহাট স্কুল মাঠ, নরোত্তমপুর এবং মিয়ার হাট স্কুল মাঠে ইউওটিসি (The University Officers Training Corps)-এর ডামি রাইফেল দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছুটিতে থাকা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশ সদস্যগণ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকহানাদার বাহিনীর হামলার পর স্থানীয় ছাত্রজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয় ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্থানীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পুরো মার্চ মাস জুড়েই কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে।
২৭শে মে এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। কবিরহাট হাইস্কুল ও চাপরাশিরহাট গোডাউনে রাজাকার- ও পাক মিলিশিয়ারা ক্যাম্প স্থাপন করে।
কবিরহাট উপজেলায় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তাদের সহায়তায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয় এবং তারা পাকবাহিনীদের নিয়ে হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড চালায়। উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো— ফয়েজ আহম্মদ ননু মিয়া (নেয়াজপুর), মফিজ মিয়া, এনামুল হক মিয়া (ঘোষবাগ), আব্দুল জলিল (মালিপাড়া, সুন্দরপুর), আব্দুল কুদ্দুছ (ইসলামি ছাত্র সংঘ-এর নেতা), ফজল হক (নুর সোনাপুর, নরোত্তমপুর), মাওলানা আব্দুল কালাম (যাদবপুর), মো. আলাম (চাপরাশির হাট) প্রমুখ।
২৭শে মে কবিরহাটে অনুপ্রবেশের পর পাকসেনারা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীসহ স্থানীয় অন্যান্য পাকিস্তানি দালালের সহযোগিতায় গ্রামবাসীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ঘোষবাগ, সাহাগ্রাম, ফজলু মিয়ার বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি, নায়েবের বাড়ি, আশ্মীনি বাড়ি, ফজলু মুন্সী বাড়ি, তেলাবাড়ি (রামদেবপুর), আব্দুল হাই মিয়ার বাড়ি (তাকিয়া বাজার), পরিমল সাহার বাড়িতে (নরোত্তমপুর) লুণ্ঠন চালায় এবং একে-একে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তারা ঘোষবাগের হিন্দু নারী কুঞ্জ কামিনী চৌধুরী, নরোত্তমপুর গ্রামের কবিরহাট কলেজের ছাত্র আমিনউল্যা, চাপরাশিহাটের নগেন্দ কেরানী, সফিউল্যাহ, ডা. নরেশ এবং বাটাইয়া গ্রামের মুন্সি বদিউজ্জামানকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যৌথভাবে কবিরহাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষকে কবিরহাট হাইস্কুল ও চাপরাশিরহাট খাদ্যগুদামে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালাত, বেদম প্রহারের পর এসব মানুষকে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করত। হত্যার পর লাশ স্কুল ও গুদাম ঘরের পেছনে ফেলে দিত।
কবিরহাট উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৫টি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো- ৪ঠা সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বাঞ্চারামপুর যুদ্ধ, ১৫ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত তাল মোহাম্মদের হাট যুদ্ধ, ১৬ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত চাপরাশিরহাট যুদ্ধ, ১৮ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত কবিরহাট স্কুল রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন- ১৮ই নভেম্বরের কোয়ারিয়ার টেক যুদ্ধ ও কালামুন্সী বাজার যুদ্ধ। ১৮ই নভেম্বর কবিরহাট উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। কবিরহাট উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আমিন উল্লাহ, বীর প্রতীক ও আবুল হাসেম, বীর প্রতীক।
কবিরহাট উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— ওহিদুর রহমান ওদুদ (পিতা মুজিবুর রহমান মোক্তার, তাকিয়াবাড়ি, ধানশালিক), ছালেহ আহমদ মজুমদার (বাঞ্চারামপুর), আবুল কালাম মাস্টার (ঘোষবাগ), আব্দুর রব (সোনাদিয়া), ছিদ্দিকউল্যা, আব্দুর রব বাবু, আমানউল্যাহ ফারুক, আক্তারুজ্জামান লাতু, মামুনুর রশীদ চৌধুরী জীবন (পুলিশ সদস্য, উত্তর ঘোষবাগ), আব্দুর রশিদ (ইন্দ্রপুর, ঘোষবাগ), আব্দুল হালিম (চাপরাশিরহাট), সৈয়দ আহম্মদ (সেনা সদস্য, সুন্দলপুর), হাসান (পুলিশ সদস্য, চাপরাশিরহাট), আলম (ঘোষবাগ), ধনু মিয়া (ঘোষবাগ), আব্দুল হালিম (চাপরাশিরহাট), আব্দুল মান্নান (নরোত্তমপুর), আবুল হাশেম (নরোত্তমপুর), আশ্রাফ উল্যাহ (নরোত্তমপুর), খলিলুর রহমান এবং নেয়ামতউল্লা।
কবিরহাট উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান ওদুদের স্মরণে কবিরহাট পৌর মার্কেটের নামকরণ করা হয়েছে ওদুদ পৌরমার্কেট। মুক্তিযোদ্ধা হাজি ইদ্রিছের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে হাজি ইদ্রিছ সড়ক। মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক দুলালের নামে অন্য একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সামছুল হক দুলাল সড়ক। [আলাবক্স তাহের টিটু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড