কটপাড়া-আঠারবাগ গণহত্যা
কটপাড়া-আঠারবাগ গণহত্যা (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসে। এতে ৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
কটপাড়া ও আঠারবাগ চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে গ্রামদুটি অবস্থিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম থানা অংশ থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে কটপাড়া এবং কটপাড়ার দক্ষিণ পাশেই আঠারবাগ গ্রাম। ঘটনার দিন পাকবাহিনী পুরো কটপাড়া গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয় এবং ঐ এলাকার বেশ কয়েকজন নারীকে পাশবিক নির্যাতন করে। হানাদাররা আঠারবাগের এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে অজ্ঞান অবস্থায় ধানক্ষেতে ফেলে যায় এবং ঐ গৃহবধূর কোলের শিশুকন্যাকে হত্যা করে তার পাশে ফেলে রাখে।
কটপাড়া গ্রাম হয়ে আঠারবাগ গ্রামের ওপর দিয়ে একটি পাকা সড়ক দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ১৯৭১ সালে এটি ছিল কাঁচা সড়ক। কটপাড়ার দক্ষিণ সীমান্তে ছিল একটি বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর দক্ষিণ পাশে আঠারবাগ আর উত্তর পাশে কটপাড়া। ঘটনার দিন স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গোপন সূত্রে খবর পান যে, জুম্মার নামাজের আগে পাকসেনাদের একটি দল এই সাঁকো পার হয়ে ফরিকোট ক্যাম্পে (ফরিকোটে পাকিস্তানি আর্মিদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল, যা বর্তমানে লাঙ্গলকোট উপজেলার অধীন) যাবে। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোটো একটি দল সাঁকোর এক পাশে এম্বুশ পেতে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়ারবাজারেও (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষা) পাকিস্তানি আর্মিদের একটি ক্যাম্প ছিল। সেখানে অনেক যুদ্ধ হয়। মিয়ারবাজার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কটপাড়া-আঠারবাগ বাঁশের সাঁকোটির অবস্থান। ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে পাকসেনাদের একটি দল সাঁকোটি পার হতে গেলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর গুলি চালান। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা গুলি ছোড়ে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেননি যে, হানাদারদের প্রথম দলটির পেছনে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত আরেকটি বড় দল অগ্রসরমাণ। ঐ দলটি দ্রুত এগিয়ে এসে একযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। এর ফলে তাদের সঙ্গে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এরপর পাকসেনারা কটপাড়া ও আঠারবাগে গণহত্যা চালায় এবং বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল কটপাড়ার হাজি বাড়িতে প্রবেশ করে ঐ বাড়ির ৩ জন নিরীহ লোককে ধরে ফেলে এবং বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন দেয়। একই সময়ে হানাদারদের অপর একটি দল আঠারবাগ গ্রামে হানা দেয় এবং কোলে থাকা ৩ বছরের শিশুকন্যাসহ এক গৃহধবৃকে ধরে পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে নিয়ে যায়। তারা শিশুকন্যাটিকে হত্যা করে এবং গৃহবধূকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ এক সময় অচেতন হয়ে পড়েন। হানাদাররা মৃত ভেবে তাকে ধানক্ষেতেই ফেলে রেখে যায়। পরে গৃহবধূর দেবর তাকে এবং শিশুটির লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায়। এছাড়া সেদিন কটপাড়া ও আঠারবাগ গ্রামের আরো অনেক নারী পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
কটপাড়া গ্রামের শহীদরা হলেন- মো. সেরাজুল হক মজুমদার (পিতা সফর আলী মজুমদার), মো. অলিউল্লাহ (পিতা নোয়াব আলী), মো. ছোয়াব মিয়া (পিতা যৌবন আলী) এবং আইয়ুব আলী (পিতা বাদশা মিয়া)। এদের মধ্যে ৩ জনকে হাজীবাড়ির ডোবার কাছে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার করা হয়। হত্যার পর লাশগুলো ডোবায় ফেলা দেয়া হয়৷
আঠারবাগ গ্রামের শহীদরা হলেন- মো. হাসান (পিতা কালা মিয়া), মো. মন্তু মিয়া, আনা মিয়া ও মনোয়ারা খাতুন (৩ বছরের শিশুকন্যা)।
এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর দেয়া আগুনে কটপাড়া গ্রামে যাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা হলেন- বাদশা মিয়া (পিতা বশরত আলী), আলী আশ্বব (পিতা আরব আলী), আছলাম (পিতা আশ্বব আলী), হাবিবুর রহমান (পিতা আছলাম মিয়া), রজ্জব আলী (পিতা তমিজ উদ্দিন), তাজুল ইসলাম (পিতা নছর উদ্দিন), তাজুল ইসলাম (পিতা তরাব আলী), হামিদ আলী (পিতা বদর উদ্দিন), আবু ছায়েদ মজুমদার (পিতা মুন্সী আরব আলী), ছেরাজ মিয়া (পিতা আলী আছন মজুমদার), আম্বর আলী (পিতা আমজাদ আলী), আবু তাহের মজুমদার (পিতা আলী আছন মজুমদার), ছালে আহম্মদ (পিতা চান মিয়া), জুলফে আলী (পিতা আরবান মিয়াজী), ফটিক মিয়া (পিতা তরাব আলী), সিরাজ মিয়া (পিতা তরাব আলী), কদম আলী (পিতা দাতিব মিয়া), মজিদ মিয়া (পিতা জমির উদ্দিন), আলী আজন (পিতা রহিম উদ্দিন), আপাজ মিয়া (পিতা আছলাম মিয়া), মনির আহম্মদ (পিতা আছলাম মিয়া), আলী আজন (পিতা আছর উদ্দিন), লাল মিয়া (পিতা আছর উদ্দিন), জব্বর আলী (পিতা কালা কাজী), জাবেদ আলী (পিতা রমা গাজী), জব্বার আলী (পিতা যৌবন আলী), রক্কন আলী (পিতা কমর আলী), চান মিয়া (পিতা আশ্বব আলী), আবু তাহের মজুমদার (পিতা আলী আজম মজুমদার), শামছুল হক (পিতা বাদশা মিয়া), শহীদ সেরাজ মিয়া, শহীদ অলি উল্লাহ (পিতা নোয়াব আলী), শহীদ আইয়ুব আলী (পিতা বাদশা মিয়া) এবং ছোয়াব মিয়া (পিতা যৌবন আলী)। [বাশার খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড