You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কটিয়াদী উপজেলা

কটিয়াদী উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) কিশোরগঞ্জ জেলা সদর ও ভৈরব উপজেলার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তেইশ বছর ধরে বাঙালিদের ওপর যে শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সারাদেশের মতো কটিয়াদীর মানুষের মনেও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। এ নির্বাচনে কটিয়াদী থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে এলাকায় সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেন। যুদ্ধ শুরু হলে কটিয়াদীর সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশ জুড়ে বেপরোয়া বাঙালি নিধনযজ্ঞে মত্ত হলে কটিয়াদীর সচেতন ছাত্র-জনতাও সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এখানকার শতাধিক তরুণ নিজেরা সংগঠিত হয়ে কটিয়াদী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। থানা সদরের পার্শ্ববর্তী জালালপুর গ্রামের অধিবাসী এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কর্মরত ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ভূঁইয়া তখন ছুটিতে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তিনি যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহের কথা জানতে পেরে তাদের প্রশিক্ষণ দান করেন। বাঁশের লাঠি ও কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে তিনি তাদের নিয়মিত পিটি-প্যারেড করান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আরেক সেনাসদস্য মো. বশিরউদ্দিনও এ-সময় ছুটি নিয়ে কটিয়াদী থানার চান্দপুরে তাঁর শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছিলেন। তিনি চান্দপুর গ্রামের ১৫-২০ জন তরুণকে সংগঠিত করে তাদের চাতল গ্রামের নিশিকান্ত রায় ও সুধীরচন্দ্র দত্তের বাড়ির আঙিনায় নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। কটিয়াদী থানার আরো অনেক যুবককে প্রশিক্ষণ দেন বাগরাইটের আনসার কমান্ডার মতিউর রহমান, আনসার কমান্ডার আবদুল আজিজ, কটিয়াদী পূর্বপাড়ার আনসার কমান্ডার আবদুল খালেক এবং মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার মো. বজলুর রহমান। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত এসব যুবকদের অনেকে পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
এপ্রিল মাসের শেষদিক থেকে বিভিন্ন সময়ে কটিয়াদী থানার বিভিন্ন গ্রামের যুবকরা ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যায়। লোহাজুড়ির সাত্তার কমান্ডার, ফুলদীর মতিউর রহমান খানসহ অনেকে আগরতলার হাঁপানিয়া ব্রহ্মপুত্র ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে আবদুস সাত্তার, তুলসীকান্ত রাউত ও মতিউর রহমান খানসহ ৩৬জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সর্বপ্রথম কটিয়াদীতে ফিরে আসে। তাঁরা হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের মোকাবেলা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কটিয়াদীতে সংগঠক হিসেবে কাজ করেন কটিয়াদী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক মাস্টার (বাগরাইট), মুমুরদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাস্টার, বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও মসুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান (বৈরাগীরচর), সুনামউদ্দিন মাস্টার (বেতাল), বিপ্লবী নেতা আবদুল জব্বার (চাতল-বাগহাটা), আব্দুল মান্নান (বালিয়া), অধ্যাপক অজয় রায় (বনগ্রাম), বামপন্থী নেতা দেবেন্দ্র সাহা (কটিয়াদী), শাহ শামসুদ্দিন মাস্টার ওরফে শান্তু মাস্টার (চাতল), আবদুল আলী মাস্টার (বেতাল), আবদুল খালেক মাস্টার (বনগ্রাম), জজ মিয়া (পাইকসা), জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানসহ আরো অনেকে। এপ্রিলের শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে গোপন সভাগুলো অনুষ্ঠিত হতো বেতাল গ্রামের সুনামউদ্দিন মাস্টারের বাড়িতে।
২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না-করেই গচিহাটা ও বনগ্রাম হয়ে কটিয়াদী থানা সদরে প্রবেশ করে। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী দালাল ও রাজাকাররা তাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। হানাদাররা থানা সদরের সরকারি পাটগুদাম ও গচিহাটা রেলস্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প দুটি রাজাকার ও আলবদর রিক্রুটিং ও তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। রাজাকারদের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল থানার লাগোয়া দানাপাটুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটি র নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রাজাকার আলবদর বাহিনীর নেতা ছিল।
কটিয়াদী উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় দালালদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিল বাগরাইটের মেন্দি মিয়া ও মুমুরদিয়ারর মুক্তার উদ্দিন। মেন্দি মিয়া ছিল কটিয়াদী থানা মুসলিম লীগের সভাপতি, শান্তি কমিটির স্থানীয় প্রধান ও কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার ভাইস চেয়ারম্যান এবং রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার। এ থানার রাজাকারদের মধ্যে মানিকখালির আনসার কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক, লোহাজুড়ির আনসার এডজুট্যান্ট আবদুল কাদির, চান্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল হক শিপলু, ফেকামারা গ্রামের মওলানা মুসলেহ উদ্দিন, সিরাজউদ্দিন, মনসুর আলী, হোসেনউদ্দিন আহমদ, হাফেজ মমিজউদ্দিন, নূরু মিয়া, ঝিকরজোড়ার শামসু, সিমুহার নূরচান, করগাঁওয়ের শামসুদ্দিন, মহিশবাড়ির জামিরউদ্দিন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে এ উপজেলায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। হানাদাররা ২৪শে এপ্রিল থানা সদরে প্রবেশের দিন পথিমধ্যে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। থানা সদরে প্রবেশের পর তারা ৯জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। তারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় সদরের বিভিন্ন হিন্দুবাড়ি ও দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকারদের সহায়তায় তারা পশ্চিমপাড়ার হাফিজুর রহমান খানের বসতভিটা ও দোকান এবং রাধানাথ সরকারের পাইকারি দোকানে আগুন দেয়। রাজাকার মুক্তার উদ্দিনের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মসুয়া ইউনিয়নের ফুলদী গ্রামে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান খানের বাড়ি, একই গ্রামের অপর এক মতিউর রহমানের বাড়ি, করেহা গ্রামের আব্দুল মালেকের বাড়ি, বাগরাইট গ্রামের হেলু মিয়া ও জায়েদুল হাজীর বাড়ি এবং শিমুলকান্দি গ্রামের ডাক্তার জমাতউল্লাহর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
করগাঁও গ্রামের রাজাকার শামসুদ্দিন ও অন্য দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল কিশোরগঞ্জ থেকে এসে ২৪শে আগস্ট কটিয়াদী উপজেলার পুরুরা গ্রামে হামলা করে। এখানে তারা অন্তত ৫০ জন মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড পুরুরা গণহত্যা- নামে পরিচিত। কটিয়াদী থানা সংলগ্ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বিভিন্ন সময়ে ধরে আনা ৬০-৬৫ জন নিরীহ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। হত্যার এ স্থানটি কটিয়াদী থানা সদর বালিকা বিদ্যালয় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।
২৫শে আগস্ট স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় বাগরাইট ও চারিপাড়া গ্রাম থেকে আটক হওয়া ১৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীর ৬জন কটিয়াদী উপজেলা সদরে পাকবাহিনীর বুলেটে নিহত হয়। এটি কটিয়াদী উপজেলা সদর গণহত্যা হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
চান্দপুর ইউনিয়নের মানিকখালি রেলস্টেশন ও মণ্ডলভোগ রেলসেতু এলাকায় হানাদার বাহিনী অনেককে হত্যা করে এবং রাজাকাররা বিভিন্ন সময়ে লাশ এনে স্টেশন ও সেতুর আশেপাশে ফেলে যায়। স্বাধীনতার পর এ মানিকখালি- মণ্ডলভোগ গণকবর টি শনাক্ত করা হয়।
২৬শে আগস্ট পাকসেনা ও রাজাকাররা বনগ্রাম ইউনিয়নের কাঁঠালতলী গ্রামে হামলা চালিয়ে কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা কাঁঠালতলী গণহত্যা- নামে পরিচিত। তারা এ গ্রামের আরো ১২জন লোককে ধরে নিয়ে গচিহাটা-ধূলদিয়া রেলসেতু বধ্যভূমি-তে হত্যা করে। গচিহাটা রেলসেতুর দুপাশে বিভিন্ন সময়ে তারা আরো দুশতাধিক মানুষকে হত্যা করে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা বেড়াটি ও দেওজান গ্রামের বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
কটিয়াদী থানায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো- ঢোলদিয়া-গচিহাটা রেলসেতু বধ্যভূমি, কটিয়াদী থানা সদর বালিকা বিদ্যালয় বধ্যভূমি, মণ্ডলভোগ রেলসেতুর পার্শ্বস্থ বধ্যভূমি, মানিকখালি রেলস্টেশন সংলগ্ন বধ্যভূমি, বনগ্রামের কাঁঠালতলী বধ্যভূমি এবং মানিকখালি রেলস্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ গণকবর।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কটিয়াদী উপজেলাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং এ অঞ্চলকে মুক্তিবাহিনীর প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পাকিস্তানি হানাদাররা মরিয়া হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারাও এ অঞ্চলকে হানাদারমুক্ত রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। কটিয়াদী থানা এলাকা ছিল হানাদার বাহিনীর ৭০নং উইং রেঞ্জার্স-এর অপারেশন এলাকাভুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টরভুক্ত। থানার বাঙালি ওসি ছিল পাকিস্তানের অনুগত এবং পাকসেনাদের অন্তরঙ্গ দোসর। ৬ই মে তার নেতৃত্বে কটিয়াদী বাজারের মিষ্টিপট্টির বিভিন্ন দোকান লুট করা হয়। এ কারণে পরদিন ৭ই মে ইপিআর- এর সিপাহি ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে ১৫জন মুক্তিযোদ্ধা থানা আক্রমণ করেন। এতে ওসি নিহত হয় এবং থানার পুলিশ সদস্যরা ভয়ে পালিয়ে যায়। থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ১৭টি বন্দুক ও বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।
১০ই জুলাই গচিহাটা রেলস্টেশনের অনতিদূরে নিমকপুরুরায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপারেশন পরিচালিত হয়। পাকবাহিনীর একটি ট্রেন ময়মনসিংহ থেকে ভৈরবে আসার খবরে আব্দুল মান্নান ও শেখ হারুনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা নিমকপুরুরা রেললাইনের নিচে মাইন পুঁতে রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হানাদারদের ট্রেনের পরিবর্তে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন এলে মাইন বিস্ফোরণে ট্রেনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন যাত্রী হতাহত হয়। ট্রেনটির পাহারায় কয়েকজন দারোগা ও ২৫জন পুলিশ ছিল। তাদের প্রায় সকলেই বেঁচে যায় এবং তারা গচিহাটা স্টেশনে গিয়ে নিকটস্থ পাকসেনা ক্যাম্পে এ খবর জানিয়ে দেয়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে গচিহাটা স্টেশন ঘেরাও করেন। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ বাহিনী তাঁদের লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। তাঁরাও পাল্টা জবাব দেন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে করে একদল পাকসেনা গচিহাটা স্টেশনে এসে মেশিনগানের গুলি ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এর সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার্থে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। তবে তাঁদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে রেললাইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় পাকবাহিনীর ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়।
১৬ই জুলাই কাজিরচর ও পার্শ্ববর্তী মনোহরদী থানার রামপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি বড় যুদ্ধ হয়। কাজিরচর-রামপুর যুদ্ধ-এ মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে এবং আতঙ্কিত হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়ায় শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। এ মাসেই চাতলের আগধাইর বিলপাড়ে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দলের এক অসম যুদ্ধ হয়। এ-সময় চাতলের নিরীহ কৃষক মোগল ভূঁইয়া ও তার পুত্র রমজান ভূঁইয়া, মতিউর রহমান ভূঁইয়া, শাহনেওয়াজ এবং আবদুল মালেককে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে পাকবাহিনী হত্যা করে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চাতল হাইস্কুলের কাছে সুধীর দত্তের বাড়িতে বিশ্রামরত অবস্থায় তুলসী কান্তি রাউতসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার ওপর পাকবাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে হানাদাররা কিশোরগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে কোনো পক্ষের কেউ হতাহত হয়নি। এ মাসেরই শেষদিকে বালিউড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও ন্যাপ- নেতা আব্দুল মান্নানের বাড়িতে একদল মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামরত ছিলেন। পার্শ্ববর্তী নাগেরগাঁওয়ের এক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থানের কথা পাকিস্তানি সেনাদের জানিয়ে দিলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে, হানাদাররা এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়।
গচিহাটা রেলস্টেশনে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এটি রাজাকার-আলবদরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ খান কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে অপ্রস্তুত পাকসেনা ও রাজাকারদের অনেকে হতাহত হয়। এ ঘটনার পর পঞ্চাশজন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এর কয়েকদিন পর ১২ই অক্টোবর আব্দুর রহিম (কবি আবিদ আনোয়ার) ও কমান্ডার আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ধূলদিয়া রেলসেতু অপারেশন – পরিচালনা করেন। এতে সেতুটি বিধ্বস্ত হয়। ফলে, এ এলাকায় পাকসেনাদের চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর সপ্তাহতিনেক পর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকখালি রেলসেতু অপারেশন পরিচালনা করেন। ২৯শে অক্টোবর পরিচালিত এ অপারেশনে আব্দুর রহিম, তুলসী কান্ত রাউত, নিবেদন কান্তি রাউত, মানিক, শাহজাহান, হানিফ, সুনীল ঘোষ, শামস সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন। এ সেতুটি বিধ্বস্ত হওয়ায় ভৈরব থেকে পাকবাহিনীর কটিয়াদীতে আসার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
৮ই নভেম্বর সকাল ৮টায় রাজাকার নূরচানের সহযোগিতায় পাকসেনাদের একটি দল নদনা ভিটিপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁদের সীমিত অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। দুপক্ষের তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর নিক্ষিপ্ত বুলেটে ভিটিপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মো. মনজিল মিয়া ও তাঁর বড় ভাই রুছমত আলী শহীদ হন। যুদ্ধ শুরু হলে রুছমত আলী তাঁর ৪ বছরের শিশুকন্যা হাওয়া বেগমকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছিলেন। তখন হানাদারদের ছোড়া বুলেটে তিনি শহীদ হন। একই বুলেটে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরা শিশুকন্যাটিও আহত হয়। সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে হাওয়া বেগম এখনো বেঁচে আছেন।
গচিহাটা-ধূলদিয়া রেলসেতু মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুদিন পর আগের চেয়ে কমসংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার অকুস্থলের কাছে পুনরায় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু মেরামতের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ-কথা জানতে পেরে ১৪ই নভেম্বর কমান্ডার আবদুস সাত্তার ও কমান্ডার হাবিবুল্লাহ খানের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গচিহাটায় পৌছায়। হানাদার বাহিনী তখন মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। সুযোগ বুঝে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ওপর হামলা চালান। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি গুলিবর্ষণে দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। পলায়নে ব্যর্থ ১৪ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তারা ভবিষ্যতে দেশ ও জাতিবিরোধী কোনো তৎপরতায় যুক্ত হবে না এই মর্মে মুচলেকা দিলে তাদের অস্ত্র রেখে ছেড়ে দেয়া হয়।
গচিহাটা রেলস্টেশন ক্যাম্পে দখলদার বাহিনী বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়েও শেষবারের মতো তাদের দখল অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও হানাদারদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য চূড়ান্ত হামলার পরিকল্পনা করেন। ২২শে নভেম্বর সকালে কমান্ডার আবদুস সাত্তার, কমান্ডার হাবিবুল্লাহ খান ও কমান্ডার আনিসুজ্জামান খোকনের নেতৃত্বে প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের গচিহাটা ক্যাম্পে একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। গচিহাটা রেলস্টেশন ক্যাম্প অপারেশনে পাকহানাদারদের সামরিক কর্মকর্তাসহ পাঁচজন সৈন্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বাকি পাকসেনা ও রাজাকাররা কিশোরগঞ্জে পালিয়ে যায়। এদিন চরম মার খাওয়ার পর গচিহাটা-ধূলদিয়া এলাকায় পাকসেনারা আর আসতে সাহস করেনি। ফলে এ এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয় এবং এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর কটিয়াদী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম।
কটিয়াদী উপজেলার যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন, তাঁরা হলেন- মো. আবদুল কুদ্দুস মিয়া (পিতা আবু তাহের মিয়া, চান্দপুর মীরেরপাড়া; ১৩ই এপ্রিল সারদা পুলিশ একাডেমিতে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন এবং শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন, তাঁকে সারদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশে সমাহিত করা হয়), আনোয়ার হোসেন (পিতা আব্দুল মজিদ, কাজিরচর প্রেমারচর; ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় আসার পথে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানাধীন হাকালুকি হাওরে তাঁদের দল পাকবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি ৬জন পাকসেনাকে হত্যা করেন এবং এক পর্যায়ে শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন), এস এম তাজুল ইসলাম (পিতা আব্দুল আজিজ, মসুয়া; ভারত থেকে বিস্ফোরক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন, জুলাই মাসে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন কাওরাইদ রেলসেতু ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে গেলে পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হন এবং হানাদাররা তাঁর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়), চান্দ মিয়া (পিতা ওয়াজ হোসেন, কুড়িখাই; ১০ই অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. আবদুর রহিম (পিতা রইছউদ্দিন, কড়িখাই নওবাড়িয়া; অক্টোবর মাসে সিলেটের জাফলং-এ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. মনজিল মিয়া (পিতা মো. সিফাত আলী, নদনা নয়াপাড়া; ৮ই নভেম্বর নদনা-ভিটিপাড়া যুদ্ধে শহীদ), আবদুল মতিন ভূঁইয়া পাশা (পিতা আব্দুস সাহিদ ভূঁইয়া, সহশ্রাম পশ্চিমপাড়া; কামাল পাশা (পিতা মো. নূরুল হক ভূঁইয়া, জালালপুর; ১৬ই নভেম্বর কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটা এলাকায় পাকসেনাদের আক্রমণে শহীদ), মো. কামরুজ্জামান কামু (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, ঝিরারপাড়; ১৭ই নভেম্বর গচিহাটা রেললাইনে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), গৌরাঙ্গচন্দ্র সরকার (পিতা প্রভাতচন্দ্র সরকার, বনগ্রাম; ২২শে নভেম্বর গচিহাটা এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. গিয়াসউদ্দিন (পিতা নিজামউদ্দিন, মুগদিয়া; ২৮শে নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরতলীর মারিয়া ও করমূলি এলাকায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ২৯শে নভেম্বর ধূলদিয়া বাজার যুদ্ধের সময় আহতাবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে আটক, পরে নির্যাতিত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ) এবং নজরুল আলম গেন্দু (পিতা মো. আব্দুল কাইয়ুম, করগাঁও; ১১ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের যশোদল এলাকায় রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)
কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে একটি চত্বর রয়েছে। উপজেলা সদরের সাবেক গো-হাটায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে কটিয়াদী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম তোরণ সংলগ্ন স্থানে নির্মিত একটি স্মৃতিফলকে কটিয়াদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে। কটিয়াদী গার্লস স্কুলের সামনে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী বধ্যভূমিতে, বনগ্রামের কাঁঠালতলী বধ্যভূমিতে এবং মানিকখালি রেলস্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ গণকবরে তিনটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। এছাড়া নজরুল আলম গেন্দু স্মরণে তাঁর নিজগ্রাম করগাঁওয়ে শহীদ নজরুল আলম গেন্দু স্মৃতি পরিষদ’ এবং আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার স্মরণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ‘শহীদ আব্দুল কুদ্দুস ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়েছে। [মো. রফিকুল হক আখন্দ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!