You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.26 | কড়ই-কাদিপুর গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

কড়ই-কাদিপুর গণহত্যা

কড়ই-কাদিপুর গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর) সংঘটিত হয় ২৬শে এপ্রিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ নৃশংস গণহত্যায় ৩৭১ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী জয়পুরহাটে অনুপ্রবেশের পর তাদের একটি দল সদর উপজেলার বন্ধু ইউনিয়নে প্রবেশ করে। এটি জয়পুরহাট শহর থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র কর্মীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ২৫শে মার্চ রাতে পার্শ্ববর্তী হানাইল-বন্ধু গ্রামে -রাজাকার- কমান্ডার মওলানা মোসলেম উদ্দিনের বাড়িতে একটি সভায় কড়ই-কাদিপুর গ্রামে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কড়ই পালপাড়া, কড়ই সোনাপাড়া, কড়ই যোগীপাড়া ও কাদিপুর সমন্বয়ে কড়ই-কাদিপুর দুটি গ্রাম। ২৬শে এপ্রিল সকালে হানাদার সদস্যরা তাদের সহযোগী রাজাকার বাঙালি ও বিহারিদের নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে-দিতে কড়ই-কাদিপুর গ্রামদুটি ঘেরাও করে এবং ফাঁকা গুলি ছোড়ে। হিন্দু অধ্যুষিত দুটি গ্রামকে সেদিন তারা মানবশূন্য করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে লাঠির মাথায় পাকিস্তানি পতাকা বেঁধে বেশকিছু দালাল গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে। ভয়ে-আতঙ্কে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং অসহায়ের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাকে সামনে পায়, তাকেই হত্যা করতে-করতে এগুতে থাকে। আর তাদের সহযোগী দালালরা মৃত-অর্ধমৃতদের গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে কড়ই-কাদিপুর গ্রামের মাঠ রক্তাক্ত হয়ে যায়।
এ-সময় যারা পালানোর চেষ্টা করছিল, রাজাকার কমান্ডার মওলানা জসিমউদ্দিন তাদের নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে স্থানীয় ডোম পুকুরপাড় সংলগ্ন মাঠের মধ্যে জড়ো হতে বলে। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩টি লাইনে তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। হানাদারদের সহযোগীরা ডোম পুকুরপাড়ের পানি তোলা গর্ত ও আখের গুড় তৈরির চুলায় মৃত-অর্ধমৃতদের ফেলে রাখে। গণহত্যার পর গ্রামদুটির ৩৬৬টি পরিবারের যে সামান্য কয়েকজন সদস্য বেঁচে ছিল, তারা প্রাণভয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাদের জায়গা-জমি স্বাধীনতাবিরোধীরা দখল করে।
কড়ই-কাদিপুর গণহত্যায় ৩৭১ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- কড়ই-কাদিপুর গ্রামের রাধাকান্ত বর্মণ, কৃষ্ণকান্ত বর্মণ, গুপিনাথ পাল, গিরেন চন্দ্র বর্মণ, নরেন পাল, গোলাপ পাল, খগেন পাল, যতন পাল, রতন পাল, ভোলা পাল, ছেদরা পাল, রবিন পাল, সুদেব পাল, উজ্জ্বল পাল, গঙ্গাধর পাল, সাধন পাল, অনিল পাল, অখিল পাল, সুপান পাল, বাসুদেব পাল, দেবী পাল, সুকুমার পাল, সুখু পাল, সখি বালা, শ্যামল বাবু, অমল বাবু, অধির বাবু, বগা পাল, নিবারণ পাল, হাবুলা পাল, রমনি পাল, হরেম পাল, হরেন পাল, তরণী পাল, অভিলাস, গোপেন, ক্ষিতীশ, আজিনা পাল, আমনা পাল, বেনু পাল, পরি পাল, পরেশ পাল, নলীকান্ত পাল, জয় বুন্ধ, প্রাণ বুন্ধ, শ্রীচরণ, অধির পাল, মহেন্দ্র পাল, সনদ পাল, গোলাপ পাল, ভাদু পাল, ভূপেন পাল, রাম পাল, দনীবুন্ধ, সাধনা পাল, বিমল পাল, সুবল পাল, কমল পাল, বিধা পাল, রঞ্জন পাল, নিখিল পাল, অজিৎ, অমল, দুঃখা বর্মণ, হবেন শিবিন, ছেদরা, শিবেন, সন্তোষ বর্মণ, প্রাণ বল্লব, দোদা, বুলি, অতিশ, যোগেশ, শিরিশ, পাঁচ কুড়ি, সুরেন, বদনা, তরমুজা, মুন্টু, গুটি, কমলা, কমল, অচানা, রাই চরণ, সিচরণ, হরেন পাল, হলধর, পঞ্চ ডাক্তার, গানা বুড়া, বাটু, লকিন, তেলি বুড়া, হরা, চান্দা, সভলা, শ্যামল ডাক্তার, অমল মাস্টার, সুধির, সুদেব, বানি কান্ত, মুঞ্জিলা কান্ত, ময়রি বুড়া, প্রিয়, কৃষ্ণ ডাক্তার, যোগেন পাল, খোকা, মহাভারত, সুবল পাল, বিনা দা, রাম প্রসাদ পাল, গোবিন্দ, সুরমা, আতার বুড়ি, ঘোনা বুড়া, আঢ়ার বর্মণ, কাচা বর্মণ, বিনোদ বর্মণ, বানু সোনার, খুতি, ফুত, অমূল্য সোনার, রনদা সোনার, সুধির মোহন্ত, বাসুদেব সোনার নারায়ণ, শ্যামল শাহা ও বানী সোনার।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে কাদিপুর গ্রামের ডোম পুকুরপাড়ে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [রেহানা পারভীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড