You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার সদর উপজেলা

কক্সবাজার সদর উপজেলা ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যত আন্দোলন- সংগ্রাম হয়েছে, তার প্রত্যেকটির ঢেউ কক্সবাজারে এসে লেগেছে। সেসব আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের আহ্বানে এখানকার জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয় এবং জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে এসব আন্দোলন- সংগ্রাম আরো জোরদার হয়ে ওঠে। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরপ্রেক্ষিতে সারা দেশের মতো কক্সবাজার সদর উপজেলায়ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পৃথকভাবে কক্সবাজার স্টেডিয়াম, পৌর- প্রিপারেটরি স্কুল ও পিটিআই মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন মেজর মীর শওকত আলী। ২৫শে মার্চের পর চকরিয়ার হারবাং থেকে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পাঠানো হয় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য। পাকবাহিনী তখনো চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থান করছিল। এক পর্যায়ে তাদের কক্সবাজার অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে নেতৃবৃন্দ প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারীদের সরে আসার নির্দেশ দেন। কারণ, প্রশিক্ষিত পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সামনে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের টিকতে পারার কথা নয়।
কক্সবাজার সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আবছার কামাল চৌধুরী, এডভোকেট জ্যোতিস্বর চক্রবর্তী, কমরেড সুরেশচন্দ্র সেন, এডভোকেট নূর আহমদ, এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, এ কে এম মোজাম্মেল হক, কামাল হোছাইন চৌধুরী, এডভোকেট মওদুদ আহমদ, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ন্যাপ), সিরাজুল হক সওদাগর (বড়বাজার), মাস্টার ছৈয়দ আলম চৌধুরী (ঈদগাঁও), নুরুল ইসলাম (সাংবাদিক), ফয়েজ আহমদ চৌধুরী, আমির মুহাম্মদ সওদাগর এবং মাস্টার গোলাম কাদের।
২৫শে মার্চের পর পাকবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথে প্রথমে কালুরঘাটে অবস্থান নেয়। ৫ই মে তারা জল ও স্থল পথে বিরাট বহর নিয়ে কক্সবাজারে প্রবেশ করে এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন রেস্ট হাউজে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী কক্সবাজারে প্রবেশ করার পর এডভোকেট মায়দুর রহমান, এডভোকেট ছালামত উল্লাহ, আবুল কাশেম মাস্টার, নজির আহমদ, মোস্তাক আহমদ, আবু বক্কর ছিদ্দিক, বদিউল আলম মাস্টার, আমির হামজা মাঝি, মকবুল আহমদ, আব্দুস ছালাম, আব্দুর রহিম মাস্টার, মাওলানা আবু ছাবের, মাওলানা মুক্তার আহমদ, সিরাজুল ইসলাম, অলি উল্লাহ্, আজিজুল হক, দানেশ প্রমুখ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরা সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে পাকবাহিনীকে সাহায্য করে। এদের নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটির সদস্যরা ছিল— এডভোকেট মায়দুর রহমান, এডভোকেট ছালামত উল্লাহ, মাওলানা আবু ছাবের, আবুল কাশেম মাস্টার, নজির আহমদ, আবু বক্কর ছিদ্দিক, বদিউল আলম মাস্টার, আমিরহামজা মাঝি, মকবুল আহমদ, আব্দুস ছালাম, আব্দুর রহিম মাস্টার প্রমুখ। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বহু লোক শহীদ হন। তাঁদের কয়েকজন হলেন- এডভোকেট জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী (পিতা এডভোকেট মণীন্দ্র লাল চৌধুরী, আনন্দ ভবন, কক্সবাজার শহর), সতীশ মহাজন (পিতা সদারাম মহাজন, খুরুশকুল, কক্সবাজার সদর), শামসুল আলম (পিতা আবদুল মোনাফ, পেতাসওদাগর পাড়া, কক্সবাজার পৌরসভা), শশী বড়ুয়া (পিতা মীননাথ বড়ুয়া, কক্সবাজার পৌরসভা), মন্টু দাস (পিতা যোগেন্দ্ৰ দাশ, গোলদিঘির পাড়, কক্সবাজার পৌরসভা), রনজিত পাল (পিতা হরিপদ পাল, ঐ), সুবাস দে (কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পাড়া; ছাত্র ইউনিয়ন নেতা), মাস্টার শাহ্ আলম, ফরহাদ প্রমুখ। ফরহাদ কক্সবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। তিনি এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করেন। এক পর্যায়ে স্থানীয় দালালরা তাঁকে আটক করে এবং পরে পাকবাহিনী তাঁকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী কক্সবাজারে আসার পরপরই হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতন শুরু করে। তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল সৈকত সংলগ্ন রেস্ট হাউজ ক্যাম্প। পাকসেনাদের সবচেয়ে বৃহৎ ক্যাম্প ছিল কক্সবাজার সী-বীচ রেস্ট হাউজ। এখানে কক্সবাজার জেলা ও অন্যান্য এলাকার বহু মুক্তিসংগ্রামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনপূর্বক হত্যা করা হতো। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন ক্যাম্পের সম্মুখস্থ বালিয়াটিতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নর-নারীকে হত্যা করা হয়, যা কক্সবাজার সী-বীচ রেস্ট হাউজ গণহত্যা নামে পরিচিত। তাদের ক্যাম্প ও অন্যান্য এলাকায় পাকহানাদাররা যাদের হত্যা করে, তাদের লাশও এখানে কবর দেয়া হতো। এছাড়া কক্সবাজার ৬নং জেটি নতুন বাহারছড়া মসজিদ গণহত্যা, নারুবাপের প্যারাবন গণহত্যা ও চৌফলদণ্ডী প্যারাবন গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
নতুন বাহারছড়ায় একটি বধ্যভূমি ও গণকবর ছিল। সেখানে অনেক লোককে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। অন্যান্য গণকবরের মধ্যে কক্সবাজার সী-বীচ বধ্যভূমি ও গণকবর , উত্তর নুনিয়ারছড়া মসজিদ গণকবর, দক্ষিণ বাহারছড়া রাডার স্টেশন সংলগ্ন বধ্যভূমি এবং বাংলাদেশ স্কাউট ভবন বধ্যভূমি ও গণকবর বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
কক্সবাজার সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশিষ্ট নেতা কামাল হোছাইন চৌধুরীর নেতৃত্বে জয়বাংলা বাহিনী
গঠিত হয়। ১২ই ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা শত্রুমুক্ত হয়। তার আগে ১০ই ডিসেম্বর থেকে পাকবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা কক্সবাজার ছাড়তে শুরু করে এবং ১১ই ডিসেম্বরের মধ্যে সকলে কক্সবাজার ছেড়ে চলে যায়। ফলে ১২ই ডিসেম্বর কক্সবাজার সদর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। এদিন বিকেলে স্থানীয় জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান কামাল হোছাইন চৌধুরী কক্সবাজারের ঐতিহাসিক পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে (বর্তমান শহীদ দৌলত ময়দান) আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল হুদা, বীর প্রতীক ও এস এম নূরুল হক, বীর প্রতীক।
কক্সবাজার সদর উপজেলার কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়নি। তবে এখানে চাকরিসূত্রে পাঁচজন ইপিআর সদস্য শহীদ হন। তাঁরা হলেন- সিপাহি আবুল হোসেন (উত্তর নুনিয়ারছড়া, কক্সবাজার পৌরসভা), নায়েব আব্দুল লতিফ (নতুন বাহারছড়া, কক্সবাজার পৌরসভা), সিপাহি জোনাব আলী (নতুন বাহারছড়া, কক্সবাজার পৌরসভা; ওয়ারলেস অপারেটর), সিপাহি মেছের আহমদ (নুনিয়ারছড়া, কক্সবাজার পৌরসভা) এবং সিপাহি নুরুল আলম (কক্সবাজার পৌরসভা)। আব্দুল লতিফ, জোনাব আলী, মেছের আহমদ ও নুরুল আলমকে নুনিয়ারছড়ায় গণকবর দেয়া হয়। আর আবুল হোসেনকে একই এলাকায় পৃথকভাবে কবর দেয়া হয়। কক্সবাজার সদর উপজেলায় জেলার বীর শহীদদের তালিকাসহ একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। সেনাবাহিনী কক্সবাজারের প্রধান বধ্যভূমির পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন ব্যক্তির স্মরণে কক্সবাজার শহরের কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সার্কিট হাউজ সড়কের নাম ‘শহীদ সরণী’, বাহারছড়া সায়মান সড়কের নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা সরণী’, মোটেল সড়কের নাম ‘বিজয় সরণী’, সিনেমা সড়কের নাম ‘বঙ্গবন্ধু সড়ক’ এবং বিমান বন্দর সড়কের নাম ‘এ কে এম মোজাম্মেল হক সড়ক’ রাখা হয়েছে। এছাড়া মো. রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ-এর নামে কক্সবাজার স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। [প্রিয়তোষ পাল পিন্টু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!