কক্সবাজার সী-বীচ রেস্ট হাউস গণহত্যা
কক্সবাজার সী-বীচ রেস্ট হাউস গণহত্যা (কক্সবাজার সদর) ২৭শে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখানে ২ হাজারের অধিক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্যাতন শেষে হত্যা করে।
৭১-এর ৩০শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ফুলতলীর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ৫ই মে স্থলপথে শতাধিক গাড়ি নিয়ে এবং জলপথে একযোগে কক্সবাজার শহরে অনুপ্রবেশ করে। তারা শহরের সী-বীচ রেস্ট হাউসে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। বিশেষ অবস্থানগত কারণে এ এলাকার প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি ছিল খুবই সন্দেহজনক। পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা এবং বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ শহরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে কৌশলে পাহাড়ে ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার)-য় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ-সময় কক্সবাজারের সর্বত্র পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে শান্তি কমিটি-র নেতৃত্বে রাজাকার- বাহিনী গড়ে ওঠে। এ ক্যাম্পে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শতশত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা প্রথমে টার্গেট করে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ এবং প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। তারা এসব লুণ্ঠন শেষে অগ্নিসংযোগ করে। এ কাজে সহায়তা করে মুসলিম লীগ জামায়াতে ইসলামী, নেজমে ইসলামী – ও ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা।
কক্সবাজার জেলা সদরের সী-বীচ রেস্ট হাউসে গণহত্যার ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী ও পুরুষদের ধরে এনে সী-বীচ রেস্ট হাউসের দুটি কক্ষে বেঁধে রাখা হতো। তাদের ওপর চলত অমানুষিক অত্যাচার। বন্দিদের দিয়ে কবর খুঁড়িয়ে তার সামনে তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। প্রতিরাতে রুটিন মাফিক কাজের মতো এখানে গণহত্যা হতো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ স্থানে ৯ মাসে প্রায় ৫০ বার গণহত্যা সংঘটিত করে। এখানে একদিন তারা এক সঙ্গে ১১ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে সী-বীচ রেস্ট হাউসটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। রেস্ট হাউসের পূর্ব পাশের দুটি কক্ষকে তারা নির্যাতন সেল হিসেবে ব্যবহার করত (যা বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ব্যবহারাধীন)। রেস্ট হাউসের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে ও বাইরে নির্জন বালুচর এবং পশ্চিমে সমুদ্র সৈকতের বিরাট বালিয়াড়ি অংশ ছিল তাদের বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জেলার বিভিন্ন এলাকা ও জেলার বাইরে থেকে বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে এনে প্রতিরাতে নির্যাতন, ধর্ষণ ও ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে বালুচরে লাশ ফেলে দিত। মূল ভবনের পেছনে ছিল রান্নাঘর। কক্সবাজার হানাদারমুক্ত হওয়ার পর রান্না ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে প্রচুর রক্তের দাগ দেখা গেছে। রান্নাঘরের উত্তর পাশের কক্ষটিতে হানাদার বাহিনী নারীদের ওপর বিভিন্ন কায়দায় পাশবিক নির্যাতন চালাত। উক্ত রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তি ফিরে এসেছে খুবই কম। মাঝে-মধ্যে বন্দিদের হত্যার জন্য টেকনাফসহ অন্যান্য স্থানেও পাঠিয়ে দেয়া হতো।
বিভিন্ন তথ্য উদ্ধারের নামে মুক্তিকামী বাঙালিদের ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করে রেস্ট হাউসের পেছনের পাতকুয়ায় লাশ ফেলে দেয়া হতো। পাতকুয়ার পানি মানুষের রক্তের ধারায় লাল হতে-হতে নিকষ কালো বর্ণ ধারণ করেছিল। এ পাতকুয়া মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পর এ পাতকুয়ায় অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়, কংকালসহ নারীর শাড়ি, ব্লাউজ, মাথার চুল, পুরুষের শার্ট ও প্যান্ট পাওয়া গেছে। হত্যার পর মৃতদেহগুলো রেস্ট হাউসের পশ্চিমে বালিচাপা দিয়ে রাখা হতো। রাত পোহালেই দেখা যেত ঐসব মৃতদেহ শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ১৬ ইসিবি অফিস স্থাপনের আগেও এখানে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়ের সন্ধান মিলেছে।
এ বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন বর্তমানে নেই। জেলার এ বৃহৎ বধ্যভূমির স্থানে বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবি অফিস, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বেইস ক্যাম্প, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, কক্সবাজার ইসলামিয়া মহিলা কামিল (মাস্টার্স) মাদ্রাসা ও বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয় নির্মিত হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে ধরে এনে হত্যা করায় সকল শহীদের পরিচয় জানা যায়নি। যে কয়েকজনের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- শহরের প্রধান সড়কের এডভোকেট জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, আলী আহমদ, মাস্টার মোহাম্মদ ইলিয়াছ, সতীশ মহাজন, নায়েক জোনাব আলী (যার মাধ্যমে কক্সবাজারবাসী সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে অবগত হয়), সিপাহি নুরুল আলম, নায়েব সুবেদার আব্দুল লতিফ, সিপাহি মেছের আহমদ, সামসুল আলম, শশীকুমার বড়ুয়া, মাস্টার শাহ আলম, মন্টু দাস ও রঞ্জিত পাল। গণহত্যার পর শহীদদের অনেককে এখানে গণকবরে সমাহিত করা হয়। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড