মুক্তিযুদ্ধে কচুয়া উপজেলা (চাঁদপুর)
কচুয়া উপজেলা (চাঁদপুর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-র ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ- বাংলার মানুষের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করে। সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ নেতা বরিউল আউয়াল খান কিরন, মনির আহম্মেদ, আবদুল মমিন খাঁন মাখন, ওয়াহিদুর রহমান, হানিফ পাটওয়ারী, মো. ইয়াকুব আলী প্রমুখ। এরপর তাঁরা চাঁদপুরে এসে মহকুমা আওয়ামী লীগ-এর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চাঁদপুরের প্রত্যেক থানায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আওয়াল এমএনএ, সেকান্দর আলী এমপিএ, কাজী আবদুর রশিদ, নছর উদ্দিন মোল্লা, চাঁন মিয়া ও আবদুর রশিদ পাঠানের নেতৃত্বে কচুয়া থানা সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুর রহমান (মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে উপজেলা চেয়ারম্যান), জহিরুল হক, মো. তরিকুল ইসলাম মুন্সি, জাবের মিয়া, ইয়াকুব আলী প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কচুয়াবাসী ৭ই মার্চ থেকে ২৬শে মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সকল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করে। পরবর্তীতে কচুয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশ নেন।
কচুয়া থানা সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দই এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মূল নেতৃত্বে ছিলেন এডভোকেট আবদুল আউয়াল এমএনএ, সেকান্দর আলী এমপিএ ও আবদুর রশিদ পাঠান।
চাঁদপুরে মুক্তিবাহিনীকে কৌশলগত কারণে দুভাগে ভাগ করা হয়। একাংশ চাঁদপুর, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও লাকসামের কিছু অংশ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ও কচুয়ার দক্ষিণাঞ্চলের নেতৃত্বে ছিল। এ অংশের নেতৃত্ব দেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠান। অন্যদিকে মতলব থানা, চাঁদপুরের উত্তরাঞ্চল, হাজীগঞ্জের কিছু অংশ, দাউদকান্দি থানা, গজারিয়া থানা এবং চান্দিনার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় অপর অংশ। এ অংশের নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট এম এ ওয়াদুদ।
কচুয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এফএফ ও বিএলএফ বাহিনীর যৌথ কমান্ডে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াহিদুর রহমান। এফএফ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন আবদুর রশিদ পাঠান ও ডেপুটি কমান্ডার শাহ আলম এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আবুল বাশার, আলী আহম্মেদ, আবদুর রব মোল্লা ও খোরশেদ আলম। বিএলএফ বাহিনীর থানা কমান্ডার ছিলেন ওয়াহিদুর রহমান এবং ডেপুটি কমান্ডার মো. জাবের মিয়া। মে মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী কচুয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং কচুয়া ডাকবাংলোয় একটি স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
কচুয়া উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মাওলানা সামছুল হক এবং সদস্য ছিল মজিবুল হক মেম্বার (করুইশ), ওহাব আলী (কড়াইয়া) প্রমুখ।
পাকহানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার ও -আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় সাচার বাজার, রঘুনাথপুর বাজার ও জগতপুর গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। জুলাই মাসে উল্টো রথের দিন পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় দাউদকান্দি থানার ইলিয়টগঞ্জ থেকে নৌকাযোগে সাচারের রথযাত্রা ও রথের মেলায় আক্রমণ চালায়। তারা ঐতিহ্যবাহী রথটি পুড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী প্রাণবল্লভ পোদ্দারের বাড়ি আক্রমণ করে তাকে হত্যা করে। ঐ সময় কান্দিরপাড় গ্রামের সোনা মিয়ার নেতৃত্বে টেটা, বল্লম ও দেশী অস্ত্র নিয়ে হানাদার বাহনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হলে সোনা মিয়াকেও হত্যা করা হয়। হানাদার বাহিনী চৈতন্য
পোদ্দারের ৭-৮ বছরের শিশুকে হত্যা করে। ৪ঠা জুলাই তারা রহিমানগর বাজারে হত্যাকাণ্ড চালায়। রহিমানগর বাজার হত্যাকাণ্ড-এ ৮-১০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক হাটবারের দিন রঘুনাথপুর বাজারে রাজাকার বাহিনী গুলি চালিয়ে অর্ধ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এটি রঘুনাথপুর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
৮ই সেপ্টেম্বর হাজীগঞ্জ-কচুয়া থানার মিলনস্থল রঘুনাথপুর বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। রঘুনাথপুর যুদ্ধ-এ নেতৃত্ব দেন কমান্ডার এম এ মতিন। তিনিসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে শহীদ হন। এছাড়া ১৪ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে কচুয়া-বরুড়া থানার সীমানায় অবস্থিত বটতলী বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। কচুয়া ও বরুড়া থানার অনেক মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশগ্রহণ করেন। এ- যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছু হটে এবং ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটি বটতলীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে পিপলকরায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পিপলকরা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ওয়াহিদুর রহমান। নভেম্বর মাসে সাদিপুরার পোদ্দার বাড়িতে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। সাদিপুরা পোদ্দার বাড়ি যুদ্ধ-এ নেতৃত্ব দেন ওয়াহিদুর রহমান ও ওসমান। এ-যুদ্ধে ৩জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পাকবাহিনীর ২০ জনের অধিক একটি দল নাওড়া হাইস্কুল ও তৎসংলগ্ন মাঠে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে নাওড়ার দিকে অগ্রসর হন। তারা নাওড়ার কাছাকাছি পৌছলে হানাদার বাহিনী অতর্কিতে গুলি চালায়। এতে মিত্রবাহিনীর ৬ জনের অধিক সদস্য শহীদ হন। অন্যদিকে পাকবাহিনীর ১০ জনের অধিক সদস্য নিহত হয়। এটি নাওড়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৬ই ডিসেম্বর কচুয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কচুয়া উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— সিরাজুল মাওলা, বীর বিক্রম-, মহিব উল্ল্যাহ, বীর বিক্রম, সিপাহি নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক- এবং সিপাহি নুরুল হক, বীর প্রতীক। উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন মোক্তার হোসেন এবং মহিব উল্ল্যাহ, বীর বিক্রম।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে রঘুনাথপুর বাজারে নির্মাণ করা হয়েছে রঘুনাথপুর স্মৃতিসৌধ-। [মো. ইয়াকুব আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড