নিজামীর বিরুদ্ধে যতাে অভিযােগ
নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২) (এ), ৩(২) (সি), ৩(২) (জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মােট ১৬টি ঘটনায় অভিযােগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় আনা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অভিযােগ। প্রথম অভিযােগে বলা হয়, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানাে হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায়। নিজামী বলে, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা। তৃতীয় অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মােহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল ।
রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরােধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতাে। চতুর্থ অভিযােগে বলা হয়, পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করা হয়। ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৯ জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে। পঞ্চম অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে নিজামীর সহযােগিতায় পাকিস্তানি সেনারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। এ সময় বাড়ি-ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করা হয়। ষষ্ঠ অভিযােগে বলা হয়, নিজামীর নির্দেশে ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা। গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে। সপ্তম অভিযােগে বলা হয়, ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে স্নেহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করে।
অষ্টম অভিযােগে বলা হয়, ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরােনাে এমপি হােস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররােচনা দেয়। নবম অভিযােগে বলা হয়, নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৭০ জনকে হত্যা ও ৭২টি ঘরে অগ্নিসংযােগ করে। দশম অভিযােগে বলা হয়, পাবনার সােনাতলা গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। একাদশতম অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়ােজিত সভায় নিজামী বলে, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সে প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনাে ৩ মার্চ কাদের মােল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন আপিল করেন কাদের মােল্লা। শুনানি শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে। আসামি ও সরকার উভয় পক্ষের দুটি আপিলের ওপর ৩৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে ২৩ জুন ২০১৩ আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। শুনানি শেষে হওয়ার ৫৫ দিনের মাথায় ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ঘােষণা করা হয় আপিল বিভাগের রায়। রায়ে কাদের মােল্লার ষষ্ঠ অভিযােগে অর্থাৎ সপরিবারে হযরত আলী লস্কর হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির ৪ জনই এ রায়ের পক্ষে মত দেন। রায় ঘােষণার ২ মাস ১৮ দিন পরে উচ্চ আদালত ৭৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। ৮ ডিসেম্বর রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পাঠানাের পর ট্রাব্যুনাল তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পৌছে দেন এবং ১২ ডিসেম্বর জেল কর্তৃপক্ষ যথাযথ আইন অনুযায়ী তাঁর ফাঁসি কার্যকর করেন।
সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার