You dont have javascript enabled! Please enable it!

ওলিমদ্দি ব্রিজ যুদ্ধ

ওলিমদ্দি ব্রিজ যুদ্ধ (মোল্লাহাট, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২৬শে অক্টোবর। মোল্লাহাট থানা সদর থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চরকুলিয়া বাজারের পরে খুলনা- মোল্লাহাট প্রধান সড়কে অবস্থিত ওলিমদ্দি খালের ব্রিজের গোড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর এ-যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনো যুদ্ধে এক সঙ্গে এত অধিক সংখ্যক পাকসেনা বাগেরহাটের আর কোথাও নিহত হয়নি। এ-যুদ্ধে কমান্ডার শরীফ আবু তালেব (নরসিংহপুর), সামছুর রহমান মোল্লা (কাচনা), নুরুল হক মোল্লা (কাটেঙ্গা), সেকেল উদ্দিন গাজী, আশরাফুল ইসলাম আশা ও তেরখাদা পাতলা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন ফহম উদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ওলিমদ্দি ব্রিজের এক পাশে কোদালিয়া বিল এবং অন্য পাশে ধবলিয়া বিল ও চিত্রা নদী। সামরিক দিক থেকে এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৮ই অক্টোবর হাড়িদহ ব্রিজ যুদ্ধ-এ ক্যাপ্টেন সেলিমসহ পাকসেনাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে এবং মোল্লাহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে খুলনা থেকে ২০০ পাকসেনা, এক কোম্পানি আলবদর- এবং বিপুল সংখ্যক -রাজাকার-কে মোল্লাহাটে পাঠানো হয়। তারা ৪-৫টি গানবোট নিয়ে খুলনা থেকে মানিকদিয়া হয়ে মোল্লাহাট ও বাশুড়িয়া ঘাটে এসে পৌঁছে। পাকবাহিনীর প্রতিশোধমূলক আক্রমণের আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা চরকুলিয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান নেন। হানাদার বাহিনী মোল্লাহাট থেকে সড়কপথে এসে চরকুলিয়ায় আক্রমণ করতে পারে এ আশঙ্কায় মোল্লাহাট-ফকিরহাট সড়কের সব ব্রিজ মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে ফেলেন। অন্যদিকে মোল্লাহাট থেকে চরকুলিয়া বাজার পর্যন্ত যেসব ব্রিজ ছিল, সেগুলো চলাচলের যোগ্য থাকলেও চরকুলিয়া বাজারের দক্ষিণে ওলিমদ্দি খালের ব্রিজটি মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে ফেলেন। এখানে একটি অস্থায়ী সাঁকো বসানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ওলিমদ্দি ব্রিজের দক্ষিণে খালের সমান্তরালে ১০টি বাংকার খনন করে প্রতিটিতে ৪ জন করে পালাক্রমে দিনরাত পাহারা দেন। ওলিমদ্দি ব্রিজ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী, মো. হাসান, হানিফ, মৃধা আলী রেজা, মোস্তাক আহমেদ, মাস্টার জাফর, প্রফুল্ল ঢালী, নবীর হোসেন, আবুল বাসার, আব্দুস সালাম, ফজলুর রহমান, আব্দুস সবুর, ফহম বাহিনীর নিরঞ্জন সেন, আব্দুল ওহাব, নুরুল হক মোল্লা, বোরহান উদ্দিন মাস্টার, হাছান, আনোয়ার হোসেন, বজলুর রহমান, খোকা, একরাম, ওদুদ, আবুল কালাম আজাদ, আবুল বাশার মোল্লা, রফিক কাজী, মারুফ, সিরাজ, আব্দুল মান্নান, শাহীনুর আলম ছানা, আশরাফুল ইসলাম, কাওছার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
২৬শে অক্টোবর দুপুরের দিকে পাকসেনারা মোল্লাহাট থেকে চরকুলিয়া বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। সেদিন ছিল চরকুলিয়া হাটবার। হানাদার পাকসেনাদের আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনী বিনা বাধায় চরকুলিয়া বাজার অতিক্রম করে ওলিমদ্দি ব্রিজের কাছে পৌঁছায়। ব্রিজের সাঁকো মুক্তিযোদ্ধারা পূর্বে সরিয়ে ফেলায় খাল পার হতে না পেরে পাকসেনারা এখানে অবস্থান নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম লক্ষ করে মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ১০টি বাংকারে পজিশন নিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নীরব পাহারায় ছিলেন। দীর্ঘ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে কোনো গুলির শব্দ শুনতে না পাওয়ায় পাকসেনাদের ধারণা হয় যে, মুক্তিযোদ্ধারা এখানে নেই। তারা এক ধরনের বিজয়ের আনন্দে বিভিন্ন স্লোগানের সঙ্গে গুলি ছুড়তে থাকে। সুযোগ বুঝে এ-সময় প্রথমে ৫ নম্বর বাংকারের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য সব বাংকার থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে এখানে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা হতাহত হয়। রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী গরুর গাড়ি ভরে লাশ সরিয়ে নেয়। তারপরও পরদিন ভোরবেলা যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন স্থানে কিছু পাকসেনার লাশ পাওয়া যায়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রাণহানি ও বিপর্যয় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!