মুক্তিযুদ্ধে ওসমানীনগর উপজেলা
ওসমানীনগর উপজেলা (সিলেট) ১৯৭১ সালে বালাগঞ্জ থানার অন্তর্গত ছিল। এ থানার দয়ামীরে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী-র পৈতৃক নিবাস। জেনারেল ওসমানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ১৯৯৬ সালে বালাগঞ্জকে দ্বিখণ্ডিত করে ওসমানীনগর থানা গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০১ সালে বালাগঞ্জের উমরপুর, সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা, গোয়ালাবাজার, তাজপুর, দয়ামীর ও উছমানপুর এ ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে ওসমানীনগর থানা গঠিত হয়। ২০১৪ সালে ওসমানীনগর উপজেলায় উন্নীত হয়। উত্তরে সিলেট সদর, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে বালাগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা এবং পশ্চিমে বিশ্বনাথ ও জগন্নাথপুর উপজেলাবেষ্টিত ওসমানীনগর মুক্তিযুদ্ধকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান ছিল।
৬৯-এর তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। সিলেটবাসী দেওয়ান ফরিদ গাজী- (সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা; বর্তমানে প্রয়াত), মো. লুৎফুর রহমান (বর্তমানে সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান) প্রমুখের নেতৃত্বে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ- ফেঞ্চুগঞ্জ-গোলাপগঞ্জ আসন থেকে এম এ জি ওসমানী এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদের বালাগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ আসনে মো. লুৎফুর রহমান এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর সিলেটের আন্দোলন-সংগ্রামে এ দুজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করায় সমগ্র জাতি ফুঁসে ওঠে। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে সারা দেশের মতো সিলেটের সর্বস্তরের মানুষও প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সমগ্ৰ সিলেট মিছিল-সমাবেশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এম এ জি ওসমানী ও মো. লুৎফুর রহমান বালাগঞ্জ থানা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের নির্দেশে সিলেটের প্রতিটি থানাসহ বর্তমান ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার, তাজপুর, সাদীপুর, দয়ামীর প্রভৃতি ইউনিয়নে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওসমানীর নির্দেশে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মো. লুৎফুর রহমান, মো. আব্দুল গণি, ডা. মকদ্দস আলী, জহুর আহমদ, মঈনুল ইসলাম (প্রাক্তন চেয়ারম্যান) প্রমুখ।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকহানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার পর এ অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। তারা লাঠিসোঁটা ও বিভিন্ন দেশী অস্ত্র নিয়ে গোয়ালাবাজার, তাজপুর, সাদিপুর, দয়ামীর প্রভৃতি ইউনিয়ন এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সব শ্রেণির মানুষ এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩টি ইউনিট ২৯শে মার্চ সিলেট থেকে সাদিপুর-শেরপুর হয়ে প্রথমে মৌলভীবাজার ও পরে শ্রীমঙ্গলে গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। উল্লেখ্য, শেরপুর এলাকাটি মৌলভীবাজার ও সিলেট এ দুই জেলাতে বিভক্ত। তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শেরপুর ও সাদিপুরে দুটি ফেরির মাধ্যমে যানবাহন চলাচল করত। সেখানে কোনো সেতু ছিল না। শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ তীর মৌলভীবাজার মহকুমায় এবং উত্তর তীর সিলেট সদর মহকুমায় অবস্থিত। উত্তর তীরস্থ অংশ থেকে বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলার শুরু। ২৭শে মার্চ কর্নেল আবদুর রব এমএনএ, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ ও মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে হবিগঞ্জের ছাত্র-জনতা সিলেট অভিযানের উদ্দেশ্যে হবিগঞ্জ থেকে রনা হয়ে রশিদপুর চা বাগানে গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। হবিগঞ্জের এ গণবাহিনী ৩১শে মার্চ শ্রীমঙ্গল আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে পাকবাহিনী সেখান থেকে মৌলভীবাজারের দিকে ফিরে যায়। কর্নেল আবদুর রব, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর সি আর দত্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হলে পাকসেনারা সেখান থেকে পশ্চাদপসরণ করে শেরপুরে ২ প্লাটুন ও সাদিপুরে ১ প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ অবস্থায় সি আর দত্ত ৪ঠা এপ্রিল শেরপুর আক্রমণ করেন। তীব্র এ আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ফেরি পার হয়ে সাদিপুর চলে যেতে বাধ্য হয়। শেরপুর যুদ্ধ জয়ের পর গণবাহিনী সাদিপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। ৬ই এপ্রিল সাদিপুরে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেরপুর যুদ্ধ ও সাদিপুর যুদ্ধ – বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শেরপুর যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১২ জন সৈন্য নিহত হয়। সাদিপুর যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। গণবাহিনী সিলেট অভিযানের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সৈন্যরা শহরে পাকবাহিনীর মোকাবেলায় যুদ্ধ করছিলেন এবং তাঁরা সে যুদ্ধে যোগ দেন। ৬ই এপ্রিল সিলেট শহর দখলের চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকহানাদার বাহিনী সিলেট শহর থেকে ১৪ কিমি দূরে সালুটিকর বিমান বন্দর ও ১০ কিলোমিটারের মতো দূরে লোক্কাতুরা চা বাগানে আশ্রয় নেয়। ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট শহরসহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়।
২২শে এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী সিলেট থেকে এসে সাদিপুরে প্রবল আক্রমণ করে। তারা জঙ্গি বিমান থেকে তাজপুর, গোয়ালাবাজার, সাদিপুর প্রভৃতি এলাকায় বোমা হামলা করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ এবং স্বয়ংক্রিয় ও ভারী অস্ত্র নিয়ে পরিচালিত এ আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা ২৪ ঘণ্টা প্রতিরোধ করে শেষ পর্যন্ত শেরপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। এ প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হন ৷ ফলে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ নিজে তখন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এতে তাঁদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতাও দেখা দেয়। ফলে পাকসেনারা নদী অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী-র অবস্থান প্রায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। মানিক চৌধুরী শেষ পর্যন্ত পরিখায় আশ্রয় নিয়ে মাত্র ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনেকক্ষণ প্রতিরোধ বজায় রাখেন। ততক্ষণে তাঁদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে যায়। অবশেষে সকলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এভাবে শেরপুরের পতন ঘটে।
ওসমানীনগর উপজেলার শেরপুর ও সাদিপুরের পতন ঘটলে পাকহানাদার বাহিনী শেরপুরে এবং সাদিপুর হাইস্কুল ও ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় হত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে এলাকায় ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চালায়। সে সময় সাদিপুর গণহত্যা, ইলাশপুর গণহত্যা, শেরপুর গণহত্যা, গোয়ালাবাজার গণহত্যা এবং বুরুঙ্গা গণহত্যায় এ অঞ্চলের বহু লোক প্রাণ হারায়।
ওসমানীনগরের স্বাধীনতাবিরোধীরা হলো- মৌলানা ফজলুর রহমান, আব্দুল আহাদ চৌধুরী (চাদ মিয়া), কালা মৌলভী, আশক আলী, গেদু মোল্লা, গৌছ মিয়া প্রমুখ।
ওসমানীনগরের বুরুঙ্গায় একটি গণকবর রয়েছে, যা বুরুঙ্গা গণকবর- নামে পরিচিত। এ গণকরবে ৭২ জন শহীদকে সমাহিত করা হয়। ২৬শে মে সংঘটিত বুরুঙ্গা গণহত্যায় ৭৮ জন শহীদের স্মরণে বুরুঙ্গা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও তা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বুরুঙ্গা গণকবরে একটি তোরণ নির্মিত হয়েছে।
৭ই ডিসেম্বর ওসমানীনগর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। ওসমানীনগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন নিম্বর আলী। তিনি দয়ামীর ইউনিয়নের রোকনপুর গ্রামের অধিবাসী। সিলেট সদরের সুতারকান্দী যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড