You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক ওয়াকার হাসান - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক ওয়াকার হাসান

ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৩) সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, পরবর্তীতে মেজর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৩ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এইচ এম হাবিবুল ইসলাম এবং মাতার নাম শামসুন নাহার ইসলাম (ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইংরেজি বিষয়ের অধ্যাপক)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ওয়াকার হাসান দ্বিতীয়। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
ওয়াকার হাসান ১৯৭১ সালে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মার্চ মাসে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। ২৬শে মার্চ কারফিউ জারি করা হয়। ২৭শে মার্চ দুঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে ওয়াকার হাসান তাঁর মায়ের সঙ্গে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি দেখতে বের হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও নিউ মার্কেট এলাকার গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র দেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মায়ের অনুমতি নিয়ে ৯ই এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া গিয়ে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে থেকে তিনি তেলিয়াপাড়া, মনতলা, শাহাবাজপুর, আজমপুর প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিছুদিন পর তিনি উচ্চতর ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে ভারতে চলে যান এবং ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’-এ মনোনীত হন। অতঃপর ওয়াকার হাসান ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ির মূর্তি ট্রেনিং সেন্টার থেকে সাড়ে তিন মাসের ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেন। তাঁর সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালসহ মোট ৬১ জন এ কোর্সে অংশ নেন। ৯ই অক্টোবর তাঁদের পাসিং আউট অনুষ্ঠান হয়। এ অনুষ্ঠানে -মুজিবনগর সরকার-এর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ জি ওসমানী- প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এদিনই ওয়াকার হাসান সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। এরপর তিনি
মুক্তিযুদ্ধ ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কানাইঘাট-গৌরিপুর, এম সি কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। কানাইঘাট-গৌরিপুরের যুদ্ধটি ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এর আশেপাশে গৌরিপুর, বড়চাতাল ও ডালিয়ার চর গ্রাম। উত্তর-পূর্বে আনন্দ বিল। মাঝখান দিয়ে বহমান সুরমা নদী। সিলেট দখলের উদ্দেশ্যে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা ২৫শে নভেম্বর ওয়াকার হাসানের নেতৃত্বে কানাইঘাটে নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেন। তাঁর ডানে সুবেদার মুসার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা (১১নং প্লাটুন) ও বামে আরেক সুবেদারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্স পজিশনে থাকেন। ২৬শে নভেম্বর ভোরে পাকবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স পজিশনের ডান দিকে (গৌরিপুরে) আক্রমণ শুরু করে। এ আক্রমণে মুসার নেতৃত্বে থাকা ১১নং প্লাটুনের ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা চরম বিপদের সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় ওয়াকার হাসান ওয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁদের পজিশনে থাকতে নির্দেশ দেন এবং ফায়ারিং সাপোর্ট দিয়ে তাঁদের উদ্ধার করবেন বলে জানান। তিনি দ্রুতগতিতে তাঁর সঙ্গে থাকা ৩০-৩৫ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাসহ ১১নং প্লাটুনের অবস্থানে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর বিরামহীনভাবে গুলি চালান এবং পাকবাহিনীর নাকের ডগায় ঢুকে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে একই ধরনের খাকি পোশাক থাকায় এবং মাথার হেলমেটে কোনো পার্থক্য না থাকায় কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা যায়। আশপাশে পাকবাহিনীর অনেকগুলো লাশ পড়ে থাকে। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ গুলি চালানো বন্ধ রেখে তারা হাতাহাতি লড়াই শুরু করে। শুরু হয় বেয়নেট চার্জ, বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত, লাথি, ঘুষি ইত্যাদি। হঠাৎ একজন পাকিস্তানি হাবিলদার ডানদিক থেকে ওয়াকার হাসানের ওপর বেয়নেট চার্জ করতে এগিয়ে আসে। সেদিকে ওয়াকার হাসানের দৃষ্টি না পড়লেও একজন মুক্তিযোদ্ধা (ওয়ারলেস অপারেটর)-র দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি ঐ শত্রুর হাত থেকে তাঁকে বাঁচানোর জন্য ধাক্কা দিলে ওয়াকার হাসান মাটিতে বসে পড়েন এবং ঐ অবস্থায়ই পাকিস্তানি হাবিলদারকে পাল্টা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেন। মুহূর্তেই এসব ঘটে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পাকিস্তানি অফিসার বটগাছের আড়াল থেকে বের হয়ে তাঁকে গুলি করতে উদ্ধত হলে ওয়াকার হাসানের হাতের স্টেনগান গর্জে ওঠে এবং সেখানেই ঐ অফিসারের মৃত্যু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালাতে থাকে। পলায়নরত অবস্থায় ২৬ জন পাকসেনাকে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এ-যুদ্ধে ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরদিকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৬-৭ জন আহত হন। কানাইঘাট-গৌরিপুর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৭৫ সালে মেজর পদে পদোন্নতি পান এবং ১৯৮১ সালের ১১ই নভেম্বর এরশাদ সরকারের আমলে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মাহমুদা আক্তার। এ দম্পতির ২ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)-এর অন্যতম সদস্য। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড