ওয়াপদা ও ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমি
ওয়াপদা ও ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমি (বরিশাল সদর) বরিশাল সদর উপজেলায় অবস্থিত। এটি ছিল দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনা এবং গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে ৩ হাজারের মতো লোককে হত্যা করা হয়।
কীর্তনখোলা নদীর তীর সংলগ্ন ওয়াপদা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে ত্রিশ গোডাউনের পূর্বপাশ থেকে কীর্তনখোলা নদী পর্যন্ত মাঝখানের স্থানটি ছিল নদী থেকে উত্থিত একটি চরভূমি। এর পাশেই ওয়াপদা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের অবস্থান। ত্রিশ গোডাউন ও ওয়াপদা পাশাপাশি অবস্থিত। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা স্থানটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে সাগরদি খাল বরিশাল শহরের মধ্য দিয়ে প্রবহমান। খালেরপাড় ঘেঁষে ছিল ডোবা-নালা ও জরাজীর্ণ জলাভূমি। এ স্থানের আশেপাশে তেমন কোনো বসতি ছিল না। ওয়াপদা বধ্যভূমির পশ্চিম পাশে সাগরদি বাজার এবং বাজার সংলগ্ন রূপাতলী বাস টার্মিনাল।
২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী জল, স্থল ও আকাশ পথে বরিশাল শহরে আক্রমণ করে এবং সমস্ত শহর দখলে নেয়। বরিশাল শহর দখলে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে অশ্বিনী কুমার টাউন হল এবং পরবর্তীতে বরিশাল জেলা স্কুলে সাময়িক অবস্থান করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা অফিসে তাদের স্থায়ী হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করে। এখানে শতশত পাকিস্তানি সেনা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। ওয়াপদা হেডকোয়ার্টার্স রক্ষার জন্য প্ৰায় ৩০০ -রাজাকার- সশস্ত্র প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। ওয়াপদায় পাকিস্তানি বাহিনী অফিস, বাসস্থান, ব্যারাক ছাড়াও টর্চার সেল স্থাপন করে। কোনো স্থানে সামরিক অপারেশনে যাওয়ার আগে এখানে বৈঠক হতো। পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সংলগ্ন খালে স্পিডবোট এবং পাশে কীর্তনখোলার তীরে সর্বক্ষণ গানবোট থাকত। স্থানটিকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা এখানে দেয়াল উঁচু করে চারদিকে অন্তত এক ডজনেরও বেশি সুরক্ষিত বাঙ্কার তৈরি করে। সেসব বাঙ্কারের কয়েকটি এখনো অবশিষ্ট আছে (ছবি দ্রষ্টব্য)। ফলে ওয়াপদা বরিশালবাসীর নিকট ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর-দের সহায়তায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে সাগরদি খালের পরিত্যক্ত ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করত। ৮ই ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হানাদার বাহিনী ওয়াপদাকে বধ্যভূমি হিসাবে ব্যবহার করে। এখানে ৩ হাজারের মতো নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ বর্বর গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল আতিক মালিক, মেজর ইয়াহিয়া হামিদ, মেজর জামিল, ক্যাপ্টেন কাহার, ক্যাপ্টেন এজাজ প্রমুখ। মে মাস থেকে শুরু হওয়া গণহত্যা মে-জুন, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মারাত্মক রূপ ধারণ করে। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা স্টিমার ও লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে এখানে প্রতিদিন ২০-২৫ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুটি লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডে অবস্থানকারী সৈন্য ও সশস্ত্র রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেনি। ১৯শে ডিসেম্বর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস পাকিস্তানি বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনাই শুধু ছিল না, এটি ছিল গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মূল অফিস ছিল সামরিক কর্মকর্তাদের অফিস। তারা এখানকার তিনটি আবাসিক কোয়ার্টার্সে বন্দিদের ধরে এনে নির্যাতন করত। বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের ধরে এনে সামরিক অফিসারা রাতভর নির্যাতন চালাত। ওয়াপদা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ত্রিশ গোডাউন সংলগ্ন এলাকায় নিরীহ মানুষকে ধরে এনে তারা নির্যাতন চালাত। এলাকার মানুষ অনেকদিন খাদ্য গুদামের আশেপাশে বিশেষ করে পুকুরের চারপাশে লাশ ও মানব অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রত্যক্ষ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুকুরের মধ্যে মানুষের অস্থি, মাথার খুলি ইত্যাদি পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বা হানাদারদের হত্যার শিকার অধিকাংশের ঠাঁই হতো সাগরদি খাল হয়ে কীর্তনখোলা তীরের এই স্থানে। বধ্যভূমি হওয়ার কারণে ওয়াপদার সামনে মানুষ এবং যানবাহন চলাচল করত না। বরিশাল শহর এবং দূরবর্তী এলাকা থেকে এখানে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ ধরে আনা হতো, যাদের একটি বড় অংশকে হত্যা করা হয় খালপাড়ের বধ্যভূমিতে। রাতে বন্দিদের আর্তচিৎকারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত।
ওয়াপদা মুক্ত হবার পর যেসব মুক্তিযোদ্ধা প্রথমে ওয়াপদার ভেতরে প্রবেশ করেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ। তাঁরা বাঙ্কারের মধ্যে প্রবেশ করে কয়েকজন নারীর মৃতদেহ দেখতে পান। কয়েকজন তখনো জীবিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেন। এলাকার সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়িয়েছিল। তাঁরা পাশ্ববর্তী ত্রিশ গোডাউন ও কীর্তনখোলার তীরে মানুষের হাড়গোড় শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করছে এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে পান।
ওয়াপদা ক্যান্টেনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা যে নারকীয় গণহত্যা চালায়, তা প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য থেকে জানা যায়। তারা গ্রেনেড ছুড়ে, বেয়নেট চার্জ করে, দা বা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে, শরীরে কাঠ বা লোহার শলা ঢুকিয়ে, গলায় রশি দ্বারা ফাঁস দিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, আছাড় দিয়ে, পায়ের তলায় পিষ্ট করে, চামড়া কেটে লবণ দিয়ে, সিগারেটের আগুন দিয়ে সারা শরীরে ছ্যাকা দিয়ে, হাত ও পায়ের নখ উপরে ফেলে, মাথার ভেতর মোটা সুচ ঢুকিয়ে বন্দিদের নির্যাতন করত। সঙ্গে চলত শারীরিক প্রহর ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালি।
ওয়াপদা গণহত্যায় শহীদ কতিপয় এলাকাবাসী হলেন— মুজিবুর রহমান কাঞ্চন (৬৬) (পিতা আহসান উদ্দীন আহমেদ, বি এম স্কুল রোড, বরিশাল), কাজী আজিজুল ইসলাম (৪১) (পিতা কাজী আমিনুল ইসলাম, এডিসি, বরিশাল; চিওড়া, কুমিল্লা), এস এম আলমগীর (২৩) (পিতা এস এম এস্কান্দার আলী, ছাত্র; আলেকান্দা, বরিশাল), এডভোকেট জিতেন্দ্রলাল দত্ত (৬৪) (পিতা প্রসন্ন কুমার দত্ত, নলছিটি, ঝালকাঠী), এ কে এম শাহজাহান (ছাত্র; গাভা, রামচন্দ্রপুর, বানারীপাড়া, বরিশাল), আবদুল মালেক (ছাত্র; গাভা, রামচন্দ্রপুর, বানারীপাড়া, বরিশাল), সেনাসদস্য আনোয়ার হোসেন মল্লিক (২৬) (পিতা এন্তাজ উদ্দীন মল্লিক, হোসনাবাদ গৌরনদী, বরিশাল), চিন্তাহরণ রায় (৬৬) (ব্যবসায়ী, পিতা জিতেন্দ্রলাল রায়, বাজার রোড, বরিশাল), গণপতি চক্রবর্তী (২৭) (পিতা প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, শিক্ষক; বাকেরগঞ্জ, বরিশাল), সাহাবুদ্দিন আহমেদ তপন (২১) (পিতা আজহার উদ্দিন আহমেদ, ছাত্র; আলেকান্দা, বরিশাল), নিরেন চন্দ্র ঘোষ (৩৫) (পিতা রাখাল ঘোষ, নাজির মহল্লা, বরিশাল), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (২৩) (পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী, ছাত্র; আলেকান্দা, বরিশাল) এবং আবদুস শুক্কুর বেপারী (২৩) (পিতা মৌলভী আবদুর রহমান বেপারী, ছাত্র; আমানতগঞ্জ, বরিশাল)।
ওয়াপদা গণহত্যা ও নির্যাতনে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিল সরদার গোলাম কুদ্দুস (কালিবাড়ি রোড, বরিশাল), মো. আমজাদ হোসেন (কাশীপুর, বরিশাল), খলিলুর রহমান (ফকির বাড়ি রোড, বরিশাল), আব্দুর রব (বি এম স্কুল রোড, বরিশাল), শাহজাহান চৌধুরী (পিতা ইসমাইল চৌধুরী, সদর রোড, বরিশাল), নুরুল ইসলাম শিকদার (বগুড়া রোড, বরিশাল), মওলানা শাহ আবু জাফর (বানারীপাড়া, বরিশাল), বশির উল্লাহ আতাহারী (গির্জা মহল্লা, বরিশাল), আব্দুল মজিদ (নাজিরের পুল, বরিশাল), মতি তালুকদার (নতুন বাজার, বরিশাল), হাদিস (ব্রাউন্ড কম্পাউন্ড, বরিশাল), ফজলু সিকদার (চেয়ারম্যান, গাভা, রামচন্দ্রপুর, বানারীপাড়া, বরিশাল) প্রমুখ। ওয়াপদা গণহত্যা ও বধ্যভূমির কথা দীর্ঘদিন অনেকের কাছে অজানা ছিল। [মো. মাসুদুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড