বীর প্রতীক ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল
ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৪) ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার মেজর (পরবর্তীতে কর্নেল) আবু তাহেরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত এবং ২০০৮ সাল থেকে ৩ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জুলাই বর্তমান নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মহিউদ্দীন আহমেদ এবং মাতার নাম আশরাফুন্নেসা। তাঁরা ৭ ভাই ও ৩ বোন। ভাইদের মধ্যে বেলাল কনিষ্ঠতম। তাঁদের পরিবারটি একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, অর্থাৎ পরিবারের সকল ভাই-বোন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা সকলে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ পরিবারের ৪ জন সদস্য রাষ্ট্রীয় খেতাব লাভ করেন, যা বিরল। খেতাবপ্রাপ্তরা হলেন— মেজর আবু তাহের, বীর উত্তম, আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম-, সাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীর প্রতীক- ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীর প্রতীকI
ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের পিতা মহিউদ্দিন আহম্মেদ পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বদলিজনিত চাকরির কারণে পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতে হয়। বেলালের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে। ১৯৬৭ সালে তিনি মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র ঢাকা কলেজের ছাত্র শেখ কামালের সান্নিধ্যে আসেন। পারিবারিকভাবেই বেলাল ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। ১৯৬৮ সালে তিনি মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৮ সালে তিনি কয়েকদিনের জন্য কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সময় তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার্থী। স্বাধীনতার পর তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবু ইউসুফ, আবু তাহের প্রমুখের আলোচনা থেকে পূর্বেই বুঝতে পারেন যে, পাকিস্তান বেশি দিন টিকে থাকবে না এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- ও ৭১-এ মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দেন ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা? বাংলা বাংলা’ ইত্যাদি। তিনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনেন এবং ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হন। এদিকে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মেজর আবু তাহের, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন চৌকস অফিসার ছিলেন, পূর্ব থেকে সুযোগ পেলেই বাড়িতে এসে বাহারসহ ভাইদের খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে ফেলে দিয়ে প্যারা পিটি শেখাতেন। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণ ও মার্শাল ল জারির সময়ে কিছুদিনের জন্য মেজর তাহের চট্টগ্রামে এসিস্ট্যান্ট জোনাল মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তখন সময়- সুযোগমতো তিনি ঢাকায় আসতেন এবং কলাবাগানের একটি বাসায় গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেন। তাতে অন্যান্যের মধ্যে বেলালসহ তাদের আরো কয়েক ভাই অংশ নেন।
৭১-এর ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। চতুর্দিকে হানাদারদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে বাঙালিদের প্রতিরোধ। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল তখন নারায়ণগঞ্জে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে রেলওয়ের ওয়াগন দিয়ে চাষাড়া রেললাইনের ওপর ব্যারিকেড তৈরিতে অংশ নেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের পতন হলে এক পর্যায়ে তিনি টাঙ্গাইলের মধুপুরে হানাদারদের বিরুদ্ধে ইপিআর সদস্যদের ডিফেন্সে যোগ দেন। সেখানে তাঁর অপর ভ্রাতা সাখাওয়াত হোসেন বাহারও যুদ্ধ করেন। শত্রুবাহিনীর হাতে ময়মনসিংহ শহরের পতন হলে বেলাল ও বাহার তাঁদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে অন্যান্য ভাইরাও এসে মিলিত হন। তখন রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে একরাতে বেলাল ও বাহার দুই ভাই হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের শিববাড়ি পৌঁছেন এবং সেখান থেকে মেঘালয়ের তুরাতে যান। তুরাতে তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়েছিল। বাহাররা ছিলেন সেখানকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচ। দুই থেকে আড়াই মাসের মতো তাঁদের ট্রেনিং দেয়া হয়। বাহার এক্সপ্লোসিভ বিষয়ে ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। বেলালের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাহার ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার আর বেলাল ছিলেন টুআইসি। তাঁদের এ কোম্পানি হালুয়াঘাট এলাকায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ করে। এর মধ্যে তেলিখালী যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় বিএসএফ- এর আর্টিলারি ফায়ারের সাহায্য নিয়ে কয়েকবার আক্রমণ শেষে সেখানকার শক্ত ডিফেন্স থেকে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীকে হটাতে সক্ষম হন। জুলাই মাসে একটি দুঃসাহসিক অভিযান ছিল হালুয়াঘাটের পাকিস্তান বিওপি-র সন্নিকটস্থ ব্রিজ ধ্বংস। এ ব্রিজের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের রসদ সরবরাহ করত। পূর্বেও ভারতীয় সেনাদের পক্ষ থেকে ব্রিজটি ধ্বংসের একাধিক প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা সফলকাম হয়নি। তাই একজন এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট হিসেবে এবার বেলালের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তিনি লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশে রওনা দেন। যথানিয়মে রেকি করা হয়। এরপর সাঁতার কেটে ব্রিজের নির্দিষ্ট পিলারে ডিনামাইট ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি বসিয়ে তিনি নিরাপদে ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ পর এক্সপ্লোসিভ বার্স্ট হয়ে ব্রিজটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এটি ছিল তাঁর অন্যতম সাফল্য, যা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল জামালপুর সীমান্তবর্তী কামালপুর যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের শত্রুর গোলার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তাঁর একটি পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মেজর তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে জুলাই মাসের শেষের দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সিলেট ও রংপুরের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের কামালপুর ঘাঁটির পতন অত্যাবশ্যকীয় ছিল। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী কংক্রিটের ঢালাইসহ গভীর ট্রেন্স খনন এবং বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়েন করে একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নির্মাণ করে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর এ ঘাঁটি দখলে পূর্বের দুবারের অভিযান ব্যর্থ হয়। ঐ অভিযানে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন মমতাজসহ আরো অনেকে। ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৃতীয় অভিযান পরিচালিত হয় ১৪ই নভেম্বর। মূল নেতৃত্বে ছিলেন মেজর তাহের। এখানকার যুদ্ধে ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রুঘাঁটি দখল করা সম্ভব হলেও কমান্ডার মেজর তাহের আহত হওয়ার পর কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে রিট্রিট করেন। অতঃপর রুট পরিবর্তন করে মুক্তিবাহিনী ও <মিত্রবাহিনীর একটি দল হালুয়াঘাট হয়ে নেত্রকোনা দখলে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হন। বাহার ও বেলাল দুই ভাই এ দলের সঙ্গে ছিলেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার কেয়ার-এর নেতৃত্বে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড কামালপুর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন এবং টাঙ্গাইলের পথ ধরে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। অপরদিকে ময়মনসিংহ শহরের পতনের পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ দল ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে যান। ১৫ই ডিসেম্বর সাভার হয়ে মিরপুর বেইলি ব্রিজের কাছে এবং ১৬ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর নিকট পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ কালে তাঁরা ঢাকা শহরে পৌছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ করে হালুয়াঘাটের পাকিস্তান বিওপি সংলগ্ন ব্রিজ ধ্বংস এবং কামালপুর যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলালকে দুবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধা বেলালের মা আশরাফুন্নেসা বেলালসহ ৪ পুত্রের বীরত্বের পদক গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পরে ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নির্বাচিত হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যোগদান করেননি। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তাঁদের পরিবারের ওপর নেমে আসে মহাদুর্যোগ। কর্নেল তাহেরসহ অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই গ্রেপ্তার হন। ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল —জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম- ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই এক প্রহসনমূলক বিচারে পঙ্গু বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়। একই বিচারে ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের ৫ বছর কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডভোগ শেষে ১৯৮০ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। পরের বছর প্যালেস্টাইনের পক্ষে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তিনি একদল তরুণকে নিয়ে সেখানে যান। তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক। ১৯৯৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এ পর্যন্ত ৩ বার (২০০৮, ২০১৪, ২০১৮) জাতীয় সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: শাহরিয়ার শহীদ (সম্পাদিত), ৭১ বীরগাথা, বসুন্ধরা পাবলিকেশন্স ২০১৫; ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীর প্রতীক-এর সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার, ২৯শে মে ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড