এলেন কনেট
এলেন কনেট আমেরিকার নাগরিক, স্বামী পল কনেটের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী, Action Bangladesh ও Operation Omega-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার ও কারাবরণ, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর। তিনি তখন ব্রিটিশ নাগরিক পল কনেট- (৩০)-এর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। পল কনেটের অনুরূপ তিনিও ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের অধিকারী উচ্চ মানবতাবাদী একজন তরুণী। নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করে ঘরবাড়ি ধ্বংস, এক কোটি বাঙালিকে দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করা, শরণার্থী শিবির-এ তাদের দুর্বিষহ জীবন-যাপন, অনেকের খোলা আকাশের নিচে বসবাস, শরণার্থীদের মধ্যে কলেরা, পুষ্টিহীনতা ও অন্যান্য কারণে অসংখ্য নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যু ইত্যাদি তাঁকে খুবই ব্যথিত করে। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে স্বামী পল কনেটের সঙ্গে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। প্রতিষ্ঠা লাভ করে ব্রিটিশ তরুণ-তরুণীদের নিয়ে একশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগা নামে দুটি সংগঠন। বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারপত্র বিতরণ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, পাকিস্তান ও সেদেশের সমর্থক রাষ্ট্রের দূতাবাসের সম্মুখে অবস্থান কর্মসূচি, সভা- সমাবেশ ও র্যালিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি তৎপরতায় তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিপন্ন মানুষের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে অপারেশন ওমেগা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে আসেন। পাকিস্তান সরকারের কোনোরূপ পূর্বানুমতি না নিয়ে ৩রা অক্টোবর তিনি গর্ডন স্ল্যাভেন (২১) নামে অপর এক পুরুষ ওমেগা ত্রাণকর্মীসহ যশোর সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানিদের দখলকৃত বাংলাদেশের এলাকায় প্রবেশ করেন। পরের দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁরা গ্রেপ্তার হন। বিনা অনুমতিতে প্রবেশের অভিযোগে তাঁদের উভয়কে যশোহর ক্যান্টনমেন্টে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে যশোর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। তখন তিনি অনুভব করেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সে অবস্থায় কারাগারে তাঁর বিভীষিকাময় দিন কাটে। পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তাঁর ওজন দ্রুত কমতে থাকে। কারাগারের একটি বড় কক্ষে অনেক নারী বন্দির সঙ্গে তাঁকে রাখা হয়। তিনি অনেক কিশোরী মেয়েকে গর্ভবতী অবস্থায় দেখতে পান। শরীরে তাদের অসহ্য যন্ত্রণা। তিনি বুঝতে পারেন তাদের ওপর পাকিস্তানি হানাদাররা কী পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু কারো মুখ খুলে কিছু বলার সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবশত ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় -মিত্রবাহিনীর হাতে যশোর শহরের পতন ঘটলে তিনি ও তাঁর সহবন্দি মুক্তি লাভ করেন। বন্দি অন্যান্য নারীরাও মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা মুক্ত হন। মুক্তি লাভের পরপরই তিনি দেশে ফিরে না গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ান। অতঃপর ভারতীয় এক মেজর তাঁকে কলকাতা পৌছে দেন এবং সেখান থেকে তিনি নিউ ইয়র্কে পৌছেন। তখন স্বামী পল কনেট জানতে পারেন যে, তাঁর স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। যথাসময়ে তাঁদের একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। পল কনেট ও এলেন কনেট দম্পতি বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতি খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তাই ভালোবেসে সন্তানের নাম রাখেন পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট। স্বামী পল কনেটের মতো তিনিও রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগ ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালের ১লা অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এলেন কনেটকে Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4(2), 139-149; https://www.thedailystar.net/news/accidental-activists; www.bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1597263.bdnews; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড