You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজনীতিবিদ, জননেতা, এডভোকেট, ভাষা-সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম - সংগ্রামের নোটবুক

এম আবদুর রহিম

এম আবদুর রহিম (১৯২৭-২০১৬) রাজনীতিবিদ, জননেতা, এডভোকেট, ভাষা-সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, স্বাধীনতোত্তর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত। দিনাজপুর সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের
জালালপুর গ্রামে ১৯২৭ সালের ২১শে নভেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মো. ইসমাইল সরকার ও মাতার নাম দরজ বিবি। পিতার আগ্রহে মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। রাজনীতি ও অন্যান্য কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। পরে কলেজ পরিবর্তন করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পুনরায় তিনি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৫৬ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি আইন পেশায় দিনাজপুর বারে যোগ দেন।
কলেজে ছাত্র থাকাকালে এম আবদুর রহিম রাজনীতিতে যুক্ত হন। ৫২-র ভাষা-আন্দোলন -এ তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারাভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে ১ নম্বর আসামি করে ১৯৬৮ সালে আইয়ুব সরকার আগরতলা মামলা- দায়ের করলে তিনি ঐ মামলায় লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর অঞ্চলের প্রধান সংগঠক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সংগ্রামী জনতার সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও বিহারিরা ২৯শে মার্চ দিনাজপুর শহর থেকে বিতাড়িত হয়। এতে অন্যদের সঙ্গে তিনি নেতৃত্ব দেন। এরপর গঠিত দিনাজপুর মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের তিনি আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। ১৩ই এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত দিনাজপুর শহর হানাদারমুক্ত ছিল। এ-সময় অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি সীমান্তবর্তী ভারতীয় বিএসএফ ক্যাম্পে যোগাযোগ করেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও তিনি সাক্ষাৎ করেন। ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তিন দিক দিয়ে দিনাজপুরে আক্রমণ চালায়। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দিনাজপুর অভিমুখী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে চেহেলগাজী নামক স্থানে বাঙালি সৈনিক-জনতার প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। যুবশিবির পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১১টি জোনাল কাউন্সিল গঠিত হলে তিনি পশ্চিম জোন-১ (বৃহত্তর দিনাজপুর ও বগুড়া)-এর চেয়ারম্যান বা প্রশাসক নিযুক্ত হন। ভারতের গঙ্গারামপুরে এর প্রধান কার্যালয় ছিল। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর ২০শে ডিসেম্বর তিনি দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় মিত্রবাহিনী র এ অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিং-এর নেতৃত্বে একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে ইয়াহিয়া সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁর অনুপস্থিতিতে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারে তাঁকে দীর্ঘ কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
স্বাধীনতার পর আবদুর রহিম বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে গঠিত ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালে তিনি গ্রেপ্তার বরণ করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি দিনাজপুর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এলাকায় অনেক শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। ২০১৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নাজমা বেগম। এ দম্পতি ২ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র: স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮ : পুরস্কারপ্রাপ্ত সুধীবৃন্দের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রয়াত জননেতা এম আব্দুর রহিম, নাগরিক শোকসভা কমিটি, দিনাজপুর, ৭ই অক্টোবর ২০১৬; মোহাম্মদ সেলিম (সম্পাদক), দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ, সুবর্ণ ২০১১

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড