এম আর আখতার মুকুল
এম আর আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর চরমপত্র – খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, শব্দসৈনিক ও বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক। তিনি ১৯২৯ সালের ৯ই আগস্ট পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের চিংগাসপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সা’দত আলি আখন্দ। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। ইংরেজ আমলে তিনি পুলিশ অফিসার ছিলেন। তাঁর মাতার নাম রাবেয়া খাতুন। তিনি ছিলেন গৃহিণী। তাঁরা ছিলেন ১৪ ভাইবোন। তাঁর অগ্রজ ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এম আর আখতার মুকুলের স্ত্রীর নাম ড. মাহমুদা খাতুন রেবা (মৃত্যু ১৯৯২)। এ দম্পতির দুই কন্যা কবিতা ও সঙ্গীতা এবং দুই পুত্র কবি ও সাগর।
পিতার চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এম আর আখতার মুকুলের লেখাপড়া শুরু। এরপর বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা শেষে ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে দিনাজপুর কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে একই কলেজ থেকে দিনাজপুর জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বিএ পাস করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ-এর জন্ম হলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঠাকুরগাঁ এলাকার তেভাগা আন্দোলনের চাষিরা দিনাজপুর- রুহিয়া সেকশনে প্রায় অর্ধ মাইল রেললাইন তুলে ফেললে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আরো কয়েকজন ছাত্রসহ এম আর আখতার মুকুল গ্রেফতার হন। ১৯৫০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন পর কলকাতা ও জলপাইগুড়িতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও বরিশালে দাঙ্গা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর পরিবার তখন বরিশালে থাকত। তিনি বরিশালে চলে যান।
ফলে তাঁর পড়াশুনা আর এগোয়নি। এসময় কিছু দিন তিনি বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি করেন। কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের ক্লিয়ারেন্স না থাকায় চাকরি থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। এরপর তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দিয়ে সাপ্তাহিক নও বেলাল ও পাকিস্তান পোস্ট এবং দৈনিক আমার দেশ, সংবাদ, ইত্তেফাক, আজাদ ইত্যাদি পত্রিকায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউপিআই-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ছিলেন। কিছুদিন তিনি ‘পুথিপত্র’ নামে একটি বইয়ের দোকান পরিচালনা করেন। ৫২-র ভাষা- আন্দোলন-এ তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় এবং তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এম আর আখতার মুকুল ছিলেন -মুজিবনগর সরকার-এর তথ্য ও প্রচার অধিকর্তা। ২৫শে মে কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণ অবয়বে প্রচারকার্য শুরু করলে প্রথমদিন থেকেই তিনি চরমপত্র শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা শুরু করেন এবং তা চলে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। তিনি ছিলেন এর রচয়িতা এবং তাঁর কণ্ঠেই এটি প্রচারিত হতো। ঢাকাইয়াসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ও বিচিত্র ভঙ্গিতে তা পরিবেশিত হওয়ায় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলা ভাষাভাষী জনগণকে অনুষ্ঠানটি বিপুলভাবে উজ্জীবিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২২শে জুলাই তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৭৪ সালের ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত ঐ পদে বহাল ছিলেন। এরপর তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনে প্রেস মিনিস্টার নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এ পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়। লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ১৯৮৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সাগর পাবলিশার্স নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। সেসবের মধ্যে চরমপত্র (অনন্যা ২০০০), চল্লিশ থেকে একাত্তর (অনন্যা ১৯৮৫), ভাষা-আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা (শিখা ১৯৯৯), আমি বিজয় দেখেছি (সাগর ১৯৮৫), কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী (অনন্যা ১৯৮৭), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা (আগামী ১৯৯৭) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। দেশমাতৃকার এ বীর সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক এম আর আখতার মুকুল ২০০৪ সালের ২৬শে জুন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবর স্থানে সমাহিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ ও দুলাল ভৌমিক]
তথ্যসূত্র: এম আর আখতার মুকুল, চরমপত্র, অনন্যা, ঢাকা ২০১০ (তৃতীয় মুদ্রণ)
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড