You dont have javascript enabled! Please enable it! বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অকুতোভয় রাজনৈতিক সংগ্রামী এম এ আজিজ - সংগ্রামের নোটবুক

এম এ আজিজ

এম এ আজিজ (১৯২১-১৯৭১) রাজনীতিক। ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মহব্বত আলী সরকার এবং মায়ের নাম রহিমা খাতুন। তিনি আগ্রাবাদের ছোবহানিয়া
প্রাইমারি স্কুল ও সাউথ কাট্টলি এম ই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে পাহাড়তলি রেলওয়ে হাইস্কুল থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। কলেজে বিএ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামে দুর্ভিক্ষ- পীড়িত মানুষের সেবার মাধ্যমে এম এ আজিজ সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এর পূর্বে ১৯৪২ সালে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগে যোগদান করেন এবং ১৯৪৩ সালে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। একই বছর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নেয়ার কারণে আজিজকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। ফলে তাঁর ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে। ঐ বছর তিনি কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৩ সালে এম এ আজিজ হালিশহরে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড গঠন করেন এবং মুসলিম লীগ-এ যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে এম এ আজিজ আওয়ামী মুসলিম লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর তৎকালীন পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫১ সালে এম এ আজিজ একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলন-এ তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
এম এ আজিজ ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের পর তাঁকে ৯২ক ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৬ সালের পর থেকেই এম এ আজিজ যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে চট্টগ্রামে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তৎপর হন। ১৯৫৭ সালে তিনি কাগমারি সম্মেলনে যোগ দেন এবং আওয়ামী লীগ-এর কাউন্সিল অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের শুরুতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে তিনি ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঐ বছরের ৬ই মার্চ অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব-বিরোধী Combined Opposition Party (COP)-র প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে এম এ আজিজ প্রচারণায় অংশ নেন।
১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা দাবি উত্থাপন ছিল একটি মাইল ফলক। ১৩ই ফেব্রুয়ারি এম এ আজিজ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬-দফাকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেন। একই বছরের ৮ই মে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিরাপত্তা আইনে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৭ সালে তিনি আইয়ুব-বিরোধী প্রচারণা জোরদার করেন এবং মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা বর্জনের আহ্বান জানান। ১৯৬৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলায় গ্রেফতারকৃত শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে তাঁর আহ্বানে চট্টগ্রামে ‘মুজিব দিবস’ পালিত হয়। আগরতলা মামলার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি ১৩ই মে ‘মুজিব ফান্ড’ গঠন করেন। ১৯৭০ সালের ১৮ই জুলাই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ৯ই আগস্ট চট্টগ্রামের প্যারেড মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এম এ আজিজের মুক্তি দাবি করেন এবং ১৫ই আগস্ট তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এম এ আজিজ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কোতোয়ালি-ডবলমুরিং নির্বাচনি এলাকা থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ১১ই জানুয়ারি বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এ অকুতোভয় রাজনৈতিক সংগ্রামী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামানুসারে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। [গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড