You dont have javascript enabled! Please enable it! গােলাম আযমের মানবতাবিরােধী অপরাধ - সংগ্রামের নোটবুক

গােলাম আযমের মানবতাবিরােধী অপরাধ

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গােলাম আযমকে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘােষণা করেন। গােলাম আযমের জন্ম ১৯২২ সালে ৭ নভেম্বর। ১৯৫৪ সালে গােলাম আযম মওদুদীর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ২২ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীতে যােগ দেয়। ও তাবলিগ-ই-জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত হয়। একাত্তরের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে গােলাম আযম পাকিস্তানে চলে যায়। স্বাধীনতার পর তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানি পাসপাের্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসে। ১৯৯৪ সালের জুনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তার নাগরিকত্বও পুনর্বহাল হয় । ১৯৯১২০০০ সাল পর্যন্ত গােলাম আযম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ছিলাে।

একাত্তরের ৪ এপ্রিল গােলাম আযমের নেতৃত্বে ঢাকায় গভর্নর হাউজে (বর্তমানে বঙ্গভবন) পিডিপির প্রধান নূরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়ের উদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, জামিয়েত উলামায়ে ইসলাম সভাপতি মােহসিউদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভােকেট এ.টি. সাদীসহ ১২ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল দখলকৃত বাংলাদেশের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানের সাথে এক ষড়যন্ত্র বৈঠকে অংশগ্রহণ। করে। এই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য আলােচনা, পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আলােচনার। বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল বিভিন্ন সহযােগী বাহিনী সৃষ্টি এবং বাহিনীসমূহের কার্যক্রম নির্ধারণ করা। এ প্রেক্ষিতে গঠিত হয় ‘নাগরিক কমিটি’ পরবর্তীতে যা প্রথমে। ‘নাগরিক শান্তিকমিটি’ এবং অতঃপর শান্তি কমিটি’ নামে পরিচিত হয়। ২৬ জুন ১৯৭১ গােলাম আযম সর্ব-পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রধান সৈয়দ আবুল আল মওদুদীর সাথে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এক বৈঠকে বসে। বৈঠকে তারা জামায়াতে ইসলামের কার্যক্রম, নীতিনির্ধারণ পর্যালােচনা করে ও দলের। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কর্মপদ্ধতি এবং দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আলােচনা। করে। (দৈনিক পাকিস্তান, জুন ২১, ১৯৭১) পাকিস্তানের তত্ত্বালীন রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। খানের সাথে আবারও একটি ৭০ মিনিটকাল স্থায়ী দীর্ঘ ষড়যন্ত্র বৈঠকে বসে যেখানে সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে একান্ত আলােচনা হয়, এবং রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য দাবি জানায় এবং সাধারণ জনগণ, যাদেরকে সে ‘দুষ্কৃতিকারী’ আখ্যায়িত করতাে, তাদেরকে মােকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সংহতিতে পাকিস্তানের বিশ্বাসী লােকদের হাতে অন্ত্র সরবরাহ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
দখলকৃত বাংলাদেশে সহযােগী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কমে আসা এবং নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে ‘final solution’ এর পরিকল্পনা হিসাবে ব্যাপক আকারে ও নির্বিচারে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, যা উক্ত বৈঠকে থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এর সদস্যদের দ্বারা বাস্তবায়িত হয় । (দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ০২, ১৯৭১) ৪ এপ্রিল ১৯৭১ গােলাম আযম এবং অন্যান্যরা নাগরিক কমিটি’ নামের একটি criminal organisation’ গঠনের পরিকল্পনা করে এবং সে মতে একই দিনে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে প্রস্তাবটি লে. জে. টিক্কা খানের সমীপে পেশ করে। উল্লেখ্য যে, নাগরিক কমিটি পরবর্তী সময়ে শান্তিকমিটি নামের একটি কুখ্যাত ‘criminal organization’ এ পরিণত হয়। (দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ০৬, ১৯৭১)। জামায়াতে ইসলামীর প্রধান হিসাবে গােলাম আযম ১০,৪,৭১ পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক উস্কানিমূলক ভাষণ দেয়। উক্ত ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ভারতের অতি উৎসাহী নেতাদের হীনখেলার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে যে, ভারত সব সময় পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
ভাষণ দানকালে আরাে বলে যে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী’ প্রেরণ করার মাধ্যমে ভারত পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। গােলাম আযম বলে, এই সব ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতে মূলত বােঝানাে হয়েছে হিন্দুদের, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ নেয়া সকল বাঙালিকে, যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চায়। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের’ বলতে বােঝানাে হয়েছে জামায়াতে ইসলামী, শান্তিকমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস এবং আল-মুজাহিদ ইত্যাদি সংগঠনকে, যারা সাংগঠনিকভাবে কোনাে না কোনােভাবে অধীনস্থ অথবা অন্য কোনােভাবে তার প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবের আওতাভুক্ত ছিল। সুতরাং ভারতের সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী’ পাঠিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গােলাম। আযমের উস্কানিমূলক হুঁশিয়ারি কার্যত হিন্দু জনগােষ্ঠী, আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ নেয়া সকল নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্মূল করারই প্ররােচনা, যা উল্লেখিত অপরাধসমূহের উস্কানিকেই (incitement) নির্দেশে করে। (দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ১১, ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান, এপ্রিল ১১,১৯৭১) ১৮ জুলাই ১৯৭১ তারিখে রিপাবলিক স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত ব্রাক্ষণবাড়িয়া শান্তিকমিটির সভায় পাকিস্তানের সংহতি সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গােলাম আযম ভাষণ দেয়। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার আহ্বান মূলত তার মত অনুযায়ী পাকিস্তানের সংহতিতে বিশ্বাস করে না এমনসব ব্যক্তির উপর আক্রমণের উস্কানি (incitement) দেয়। (East Pakistan Police Abstract of Intelligence, Para 820) ২ আগস্ট ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামে পাকিস্তান জামায়াত-ইতলাবা-আরবিয়ার আয়ােজিত এক সম্মেলনে ভাষণ দানকালে তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর তখনকার পরিস্থিতিকে যুদ্ধ পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করে বলেন এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের সম্মুখ যুদ্ধই নয়, আদর্শিক যুদ্ধ।
পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে একে ইসলামের জন্য আদর্শিক যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। যা ইসলামী পরিভাষায় “জিহাদ’-এর নামান্তর, যা মূলত বিধর্মীদের বিরুদ্ধে প্রযােজ্য। খুলনা মিউনিসিপ্যাল হলে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর জেলা শাখার কর্মী সভায় তথাকথিক ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ নিধনের আহ্বান জানায় গােলাম আযম। গােলাম আযম কুষ্টিয়ার পাবলিক লাইব্রেরী ময়দানে স্থানীয় শান্তি কমিটি আয়ােজিত জনসভায় বলে যে শেখ মুজিব ও বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগ। ভারতের সঙ্গে আঁতাত করে এ অঞ্চলের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার মতে এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে জনগণের উপর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নেমে এসেছে এবং ভাবী বংশধরগণ তাদের ক্ষমা করবে না। এ প্রসঙ্গে সে হিন্দুদের আধিপত্য থেকে আজাদীর সংগ্রামে মুসলমানদের বিপুল কোরবানির কথা উল্লেখ করে। গােলাম আযম তথাকথিত ‘দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং তথাকথিত রাষ্ট্রবিরােধীদের প্রতিহত করার জন্য শান্তিকমিটির প্রতি আহ্বান জানায়। (দৈনিক সংগ্রাম, আগস্ট ০৮, ১৯৭১, দৈনিক পাকিস্তান, আগস্ট ০৮, ১৯৭১, দৈনিক আজাদ, আগস্ট ০৯, ১৯৭১) পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে দেশের ঐক্য ও সংহতি সংকটাপন্ন এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের দ্বারা হুমকির সম্মুখিন হওয়ার কথা জানায়। উদ্ভূত পরিস্থিতির ডাকে। সাড়া দিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা। চালানাের জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানায় গােলাম আযম। লাহাের বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলােচনাকালে বলে যে ভারতীয় “দুষ্কৃতিকারীদের’ অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহ করার এবং পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্যে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠানাের কারণে পাকিস্তানের জন্য একটি মাত্র পথই খােলা আছে এবং তা হচ্ছে অস্ত্রের মাধ্যমে এর জবাব দেয়া ।

সে রাজাকারদের একটি প্রধান প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে। মােহাম্মদপুরের এই ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টার কেবলমাত্র রাজাকারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রই ছিল না, এটা ১৯৭১-এ ছিল এক ভয়ঙ্কর ভীতির নাম। অগণিত ভিকটিমকে এখানে হত্যা আর নির্যাতন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রে রাজাকারদের হাতে-কলমে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ শিক্ষা দেয়া হতাে। সেই কেন্দ্রে গিয়ে সে রাজাকার ও অন্যদের প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করে, তাদেরকে উজ্জীবিত করার জন্য উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়। তার ভাষণে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে ‘পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য জীবন দানে প্ররােচিত করা হয়। এতে জামাতের

সদস্য ছাড়াও ‘আলেম ও ইসলামী কর্মীদের’ সশস্ত্র বাহিনীতে ভর্তি হতে আহ্বান জানানাে হয় । (দৈনিক সংগ্রাম, সেপ্টেম্বর ১৮, ১৯৭১) ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ লাহােরের স্থানীয় একটি হােটেলে লাহাের জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সম্মানে আয়ােজিত এক সম্বর্ধনা সভায় ভাষণ দানকালে ভারতের সর্বাত্মক হামলার জবাব দেয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানা ও সাথে সাথে এও বলে যে পাল্টা আক্রমণ করতে ব্যর্থ হলে শত্রুপক্ষ ধীরে ধীরে এবং সুষ্ঠ পন্থায় পাকিস্তানকে খণ্ড বিখণ্ড করার ব্যাপারে তাদের আসল উদ্দেশ্য হাসিলের প্রয়াস পাবে। (দৈনিক সংগ্রাম, নভেম্বর ২৬, ১৯৭১)। ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে ৭০ মিনিটকাল স্থায়ী এক বৈঠকে বসে। রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির দাবি ইয়াহিয়া খানের নিকট পুনর্ব্যক্ত করে। সে আরাে বলে যে, ‘জনগণ’ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযােগিতা করবে এবং ‘শত্রুবাহিনী’কে রাজাকার বাহিনী মােকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট।
একই ধারাবাহিকতায় (criminal organization) নাগরিক শান্তিকমিটির অপরাধ কর্মকাণ্ড সুচারু রুপে পরিচালনার উদ্দেশে ১৫.০৪.১৯৭১ কমিটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটি’ ধারণ করে। উদ্দেশ্য, পুরাে দেশব্যাপী। সংগঠনের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়া। একই সাথে ২১ সদস্য বিশিষ্ট এক কার্যনির্বাহক পরিষদও গঠন করা হয়। কমিটির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গােলাম আযম ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা। ছিলাে ১। এস কে খয়ের ২। একিউএম শফিকুল ইসলাম ৩। মাহমুদ আলী ৪। আব্দুল জবক্ষার খদ্দর ৫। মওলানা সিদ্দিক আহম্মদ ৬। আবুল কাসেম ৭। মওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম ৮। আব্দুল মতিন ৯। অধ্যাপক গােলাম সরােয়ার ১০। ব্যরিষ্টার আখতার উদ্দিন, ১১। এ.এস.এম সােলায়মান ১২। এ.কে রফিকুল ইসলাম ১৩ নুরুজ্জামান ১৪। আতাউল হক খান ১৫। তােয়াহ বিন হাবিব ১৬। ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহন মিয়া) ১৭। মেজর আফসার উদ্দিন ১৮। দেওয়ান বারাসাত আলী, ১৯। পীর মােহসেন উদ্দিন ও ২০। হাকিম ইরতেজুর রহমান। গােলাম আযম অবস্থানগগভাবে উক্ত কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটির কার্যনির্বাহক থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করে এবং নিজে একই নীল নকশার বাস্তবায়নে অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলে যে, অবস্থার চাপে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিরা বাধ্য হয়ে গৃহত্যাগ করে ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সাধারণ পরিষদের প্রতি সেই বিবৃতিতে সে আরও দাবি জানায়। জাতিসংঘের উদ্যোগে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরানাের ব্যাপারে ভারতকে যেন বাধ্য করা হয়। তার এহেন বক্তব্যে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গৃহত্যাগকারীরা ঠিক কোন অবস্থার চাপে পড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল সে সত্য গােলাম আযমের বক্তব্যে গােপন করা হয়েছে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করবার লক্ষ্য থেকে। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন auxliary force সমূহের দেশব্যাপী অপরাধমূলক কার্যক্রম, সুনির্দিষ্ট গােষ্ঠীসমূহের নিমূলকরণ কর্মসূচি, অন্যান্য দমন এবং নিপীড়নের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থেই ভীত সন্ত্রস্ত জনসাধারণ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবনকেও তাদের কাছে নিজ দেশে থাকার চেয়ে অধিক নিরাপদ মনে হয়েছিল সেই সময়, যা তার বক্তব্যে অনুপস্থিত। এটাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে সব auxliary force এর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এই দেশত্যাগের ব্যাপ্তি এবং মাত্রাকে বৃদ্ধি এবং ত্বরান্বিত করেছিল, নিজে সেই সব criminal organization সমূহের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল। এই বক্তব্যে আরও গভীর আরেক অপরাধমূলক দুরভিসন্ধির আভাস নিহিত রয়েছে। শরণার্থী শিবিরের আপাত নিরাপত্তায় আশ্রয় নেয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করার এই উদ্যোগ আসলে ছিল দেশত্যাগের ভিকটিমদের পুনরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং auxliary force-এর নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার পাঁয়তারা, যাতে তাদের বিরুদ্ধে নির্মূলকরণ, অসমাপ্ত হত্যাযজ্ঞ এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নতুন উদ্যমে চালানাে সম্ভবপর হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে উদ্দেশ্য করে এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ সরাসরি অপরাধ এবং তার সংগঠনের সম্পৃক্তি (complicity) প্রমাণ বহন করে ।
দৈনিক সংগ্রাম, সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তান, সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৭১) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মােহাম্মদপুর থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখে এসএসআই সিরু মিয়া তার বাসা চামেলিবাগে চলে যান। ২ মার্চ তিনি স্ত্রী আনােয়ারা বেগম, কিশােরপুত্র আনােয়ার কামাল ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ কখনাে পায়ে হেঁটে, কখনাে নৌকাযােগে নিজের বাড়ি রামকৃষ্ণপুর, থানাহােমনা, জেলা-কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে নিজ বাড়িতে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযােগী বাহিনীদের আক্রমণের কারণে দেশত্যাগে বাধ্য শরণার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা ও ভারতে পৌছাতে সাহায্য করেন। ৭/৮ দিন পর সিরু মিয়া নিজেও ভারতে চলে যান। সপ্তাহখানেক পর তিনি পুনরায় বাড়িতে ফেরত আসেন। ২৫ অক্টবর ১৯৭১ সিরু মিয়া দারােগা তার কিশাের পুত্র আনােয়ার কামাল, নজরুল, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর সেলিম ও শফিউদ্দিন ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় এস আই সিরু মিয়া ও নজরুল ইসলামের কাছে একটি করে রিভলবার ছিল। ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ সকাল ১০টার সময় ভারতে প্রবেশের প্রাক্কালে কুমিল্লা জেলার কসবা থানাধীন তন্তর চেকপােস্টে পেীছামাত্র রাজাকাররা তাদের আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঐ সময় একটি আর্মি জীপযােগে ৫/৬ জন পাকিস্তানি সেনা সেখানে আসে। তারা এস আই সিরু মিয়া দারােগা ও নজরুল ইসলামের কাছ থেকে রিভলবার দুটি নিয়ে যায় । সিরু মিয়া, তার ছেলে আনােয়ার কামাল, কাসেম, শফিউদ্দিনকে একটি চালের ট্রাকে তুলে দেয়া হয়। বেলা অনুমান ১২টার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একপ্রান্তে চালের ট্রাক থেকে তাদেরকে নামিয়ে সেখানে শান্তিকমিটি ও জামায়াত নেতা পেয়ারা মিয়া আসে ও গালিগালাজ করে।
তার সাথে আরাে ৪/৫ জন যুবক ছিল। তারা আটককৃতদের হাতে থাকা হাতঘড়ি, আংটি ইত্যাদি ছিনিয়ে নেয় এবং পায়ে হাঁটিয়ে বিকেল অনুমানিক ৪/৫টার সময় রাজাকার মঞ্জিল (অন্নদা স্কুলের সামনে কালিবাড়ী)-এ নিয়ে যায়। পথে তাদেরকে দেখিয়ে মাইক দিয়ে তারা প্রচার করতে থাকে যে, স্পেশাল বাহিনী অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে।’ সেখানে এক রাত থাকার পর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের সামনে দানা মিয়ার বাড়িতে পেয়ারা মিয়া ও তার সাথের লােকজন আটককৃতদের নিয়ে যায়। দিনের বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দানা মিয়ার বাড়ির নিচতলায় একটি কক্ষে নির্যাতন করতাে। শান্তিকমিটি ও জামায়াত নেতা পেয়ারা মিয়া এই নির্যাতনের তদারকি এবং নিজেও নির্যাতন করতাে । দানা মিয়ার বাড়ির অন্যান্য কক্ষেও নির্যাতন করা হতাে। সারাদিন নির্যাতনের পর রাতের বেলা আটককৃতদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা হাজতে রাখা হতাে এবং সকালবেলা থানা থেকে দানা মিয়ার বাড়িতে এনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লােকজন, পেয়ারা মিয়া ও তার সাথের লােকজন অমানসিক নির্যাতন করত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আলী। রেজা, ব্রিগেডিয়ার সাদাতউল্লাহ, মেজর আব্দুল্লাহ, হাবিলদার বশিরউদ্দিন এই নির্যাতন কেন্দ্রে এই নির্যাতন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করত। এভাবে দু-তিন দিন নির্যাতনের পর এস আই সিরু মিয়া ও তার ছেলে আনােয়ার কামাল নজরুল ইসলাম, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর সেলিম ও শফিউদ্দিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এস আই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনােয়ারা বেগমের ভাই ফজলুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানায় তাদের দেখতে গেলে এস আই সিরু মিয়ার ছেলে আনােয়ার কামাল তার মাকে উদ্দেশ্য করে ০১,১১.৭১ তারিখে হাতে। লেখা একখানা চিঠি দেয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং শান্তিকমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার কারণে সে ইচ্ছে করলে আটককৃত সিরু মিয়া দারােগা, তার পুত্র আনােয়ার কামালসহ সকলকে মুক্ত করতে পারবে, এই বিশ্বাস রেখে ১৫ রােজার দিন এস আই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনােয়ারা বেগম তার পিতা আয়েত আলী সরকারসহ ঢাকায় আনােয়ার বেগমের মেজ বােন মনােয়ারার স্বামী মােহসিন আলী খানের খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার বাসায় আসেন। মােহসিন আলী খান তখন খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলাে। গােলাম আযমের দুই ছেলে আযমী ও আমীন তার ছাত্র ছিল। আনােয়ারা বেগমের অনুরােধে তার ভগ্নিপতি মােহসিন আলী খান আসামীর কাছে তার মগবাজারের বাসায় গেলে সে বলে যে, সিরু মিয়া দারােগা ও তার পুত্র মুক্তিবাহিনী। তারা অস্ত্রসহ বর্ডারে ধরা পড়েছে তা সে জানে। একথা বলার পর মােহাম্মদ মুহসীন আলী খানকে দুই দিন পর পুনরায় তার সাথে দেখা করতে বলে। কথামতাে দুদিন পর মহসিন আলী খান গােলাম আযমের মগবাজারের বাসায় গেলে সে একটি গাড়িযােগে মহসিন আলী খানকে নিয়ে তৎকালীন পুরাতন সংসদ। ভবনের নিকটবর্তী নাখালপাড়ায় জামায়াতের অফিসে যায়। তার গাড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গার্ড ছিল। কিছুক্ষণ পর গােলাম আযম একটি খামবদ্ধ চিঠি। মহসিন আলীর হাতে দেয় এবং কাউকে ঐ চিঠি দেখাতে নিষেধ করেন এবং চিঠিটি তার দলের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তিকমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে দিতে বলে। চিঠিটি দিয়ে গােলাম আযম যা বলেছে তা তাকে বিস্তারিত বলেন।
আনােয়ারা। বেগম চিঠিটি নিয়ে নিজ বাড়িতে আসেন এবং তার ভাই ফজলুর রহমানকে গােলাম আযমের কথামতাে চিঠি কাউকে দেখাতে নিষেধ করে তা তার হাতে দেন। ফজলুর রহমান চিঠি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তিকমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে গেলে সে চিঠিটি পড়ে গােলাম আযমের লিখিত আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি ফজলুর রহমানকে দেখায়। এতে সিরু মিয়া দারােগা ও তার ছেলে আনােয়ার কামালকে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করার নির্দেশ ছিল। পেয়ারা মিয়া ফজলুর রহমানকে আরাে বলে যে, ‘যে চিঠি এনেছ তাতে নতুন কিছু নেই বাড়িতে গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর।’ পরে ফজলুর রহমান বাড়িতে এসে আনােয়ারা বেগমকে জানালে বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করে। ২১ নভেম্বর ৭১ রােজার ঈদের দিন দিবাগত রাত ১টার দিকে পত্রের নির্দেশানুযায়ী সিরু মিয়া দারােগা, আনােয়ার। কামাল, নজরুল, শফিউদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেমসহ ৪০ জনকে স্থানীয় জেলখানা থেকে বের করে লরিতে ওঠায়। ওঠাবার পর শফিউদ্দিন পাকিস্তানে লেখাপড়ার করার কারণে উর্দুতে কথা বলতে পারায় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লার নির্দেশে তাকে ছেড়ে দিয়ে বাদবাকি ৩৯ জনকে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগী বাহিনী রাজাকার ও আল-বদররা পৈরতলা নামক স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে রাজাকার ও আল-বদরদের সহযােগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আটককৃতদের গুলি করে এবং একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ছাড়া বাদবাকি ৩৮ জন নিহত হয় । ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জখমী একজন প্রাণে রক্ষা পায়। গুলিতে নিহতদের লাশ পরে রাজাকার, আল-বদররা মাটিতে পুঁতে ফেলে ।
ট্রাইব্যুনালের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তার রায়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গােলাম আযমের মুক্তিযুদ্ধকালের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যােগ্য। কিন্তু বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, গােলাম আযমের বিরুদ্ধে এমন কোনাে অভিযােগ আনা হয়নি যে সে অপরাধস্থলে উপস্থিত ছিলাে। দ্বিতীয়ত, গােলাম আযমের প্রত্যক্ষ নির্দেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এমন কোনাে অভিযােগও তার বিরুদ্ধে নেই। মূলত তার বিরুদ্ধে অভিযােগগুলাে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির। একাত্তরে জামায়াতের সদস্যদের নিয়ে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, আল-মুজাহিদ প্রভৃতি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠিত হয়, সে এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলাে। এসব বাহিনী একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ করেছে। কর্তৃত্ব থাকার পরও সে কোনাে অপরাধীকে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখেনি, শাস্তিও দেয়নি। ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, যেসব অপরাধ রাজাকার, আলবদররা করেছে, তার দায়দায়িত্ব গােলাম আযমের ওপর পড়ে। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর আরও বলেন, ট্রাইব্যুনালের অন্য মামলাগুলাের সঙ্গে এটাই এ মামলার পার্থক্য। অন্যগুলােতে সরাসরি অভিযােগ আছে, এটাতে নেই । এ মামলায় মৌখিক সাক্ষ্যের তেমন কোনাে গুরুত্ব নেই, সবই দালিলিক সাক্ষ্য। বিভিন্ন পত্রিকার ক্লিপিংস থেকে দেখা গেছে, একাত্তরে গােলাম আযম বিভিন্ন বক্তৃতা করেছেন, আলােচনা করেছেন, বিবৃতি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য চেয়েছেন।
ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা
গােলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা প্রথম অভিযােগে ছয়টি ঘটনা এবং দ্বিতীয় অভিযােগে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গােলাম আযম মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনের ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করেছেন। এ দুটি অভিযােগ মূল্যায়নের জন্য ট্রাইব্যুনাল মূলত দালিলিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করেছে। 
রায়ে বলা হয়, আসামির লেখা আত্মজীবনী জীবনে যা দেখলাম’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডের ১৩৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ গাড়িতে করে শহরে ঘুরতে বের হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নবাবপুর রােড, গুলিস্তান এলাকায় যায় । সেখানে গিয়ে সে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস ও নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করে। গােলাম আযমের নিজের ভাষায়, “যে নৃশংস দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলাে সেনাবাহিনী কোনাে শত্রুদৈশ জয় করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে। এতে বােঝা যায়, পাকিস্তানি সেনারা কোন ধরনের নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সে বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। এ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তার সমমনা নেতাদের নিয়ে একাত্তরের ৪ এপ্রিল সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের সহযােগিতার আশ্বাস দেয়। ওই সময়ের আজাদ, পূর্বদেশ ও পয়গম পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, গােলাম আযম ও তাঁর সহযােগীরা মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করার জন্য টিক্কা খানের সঙ্গে সভা করেছিলাে। যার ফল হিসেবে সহযােগী বাহিনীগুলাের সহযােগিতায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধকালের নয় মাস দেশজুড়ে ভয়াবহ নশংসতা চালিয়েছে। ষড়যন্ত্র একটি প্রাথমিক অপরাধ, এটা প্রমাণ করা জরুরি নয় যে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার ফলে মানবতাবিরােধী অপরাধ বা গণহত্যা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, দালিলিক প্রমাণ থেকে দেখা যায়, টিক্কা খান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে গােলাম আযম ও তার সহযােগীরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযােগী আধা সামরিক বাহিনী গঠনে যৌথভাবে ভূমিকা রেখেছে। শান্তি কমিটিকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়েছে; রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস প্রভৃতি বাহিনী গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন প্রতিরােধ করার চেষ্টা করেছে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে গােলাম আযম আহ্বান জানিয়েছিলাে, “প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহের জন্য, মুক্তিকামী বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতে রাজাকারের সংখ্যা বাড়ানাের জন্য। তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, গােলাম আযম ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলাে, যার ফলে তার অধীনস্থ আধা সামরিক বাহিনীগুলাে দেশজুড়ে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটন করেছে।
উসকানি
মামলার তৃতীয় অভিযােগে মুক্তিযুদ্ধকালের ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করে অভিযােগ আনা হয়েছে, একাত্তরে গােলাম আযম বক্তব্য ও বিবৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার অনুসারীদের মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনে উসকানি দিয়েছে। এ অভিযােগও মূল্যায়ন করা হয়েছে মূলত দালিলিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। রায়ে বলা হয়, একাত্তরের ১৯ জুলাই সংগ্রাম-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, একাত্তরের ১৬ জুলাই রাজশাহীতে দেয়া শান্তি কমিটির এক সভায় গােলাম আযম বলে, হিন্দুরা সব সময় মুসলমানের শত্রু, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বন্ধুত্বের কোনাে প্রমাণ নেই। এ ধরনের হিংসাত্মক বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে হিন্দুদের প্রতি গােলাম আযম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতি প্রকাশ করে, যাতে একই সঙ্গে রয়েছে এই ধর্মীয় গােষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়ন বা ধ্বংসের গৃঢ় ইচ্ছা। অথচ উপমহাদেশের ইতিহাস বলে, গত এক হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে বসবাস করছে। ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, একাত্তরের ১৬ আগস্ট আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদন। অনুসারে, পাকিস্তানের আজাদী দিবস উপলক্ষে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সভায় গােলাম আযম বলে, পাকিস্তান না থাকলে বাঙালি মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না। এ কথা যারা বুঝতে চায় না, তাদের পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।’ এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে সে তার অনুসারীদের প্রত্যক্ষ নির্দেশ দিয়েছে মুক্তিকামী বাঙালিকে নির্মূল করার। এ কথা যারা বুঝতে চায় না’ বলতে দেশের মুক্তিকামী মানুষকে বােঝানাে হয়েছে। রায়ে বলা হয়, একাত্তরের ২৩ নভেম্বর লাহােরে গােলাম আযম সাংবাদিকদের কাছে বলে, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি স্থাপনের জন্য সরকারের উচিত হবে শান্তিকমিটির সদস্য ও রাজাকারদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সরবরাহ করা। সাংবাদিকদের কাছে এ ধরনের মন্তব্য বাঙালিদের নির্মূল করতে তার অনুসারীদের প্রতি প্রত্যক্ষ ও উন্মুক্ত নির্দেশ।
১ ডিসেম্বর গােলাম আযম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন, যা পরদিন ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়। মুক্তিবাহিনীকে ‘শত্রবাহিনী’ আখ্যায়িত করে সে বলে, ‘তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করতে রাজাকাররাই যথেষ্ট। এ জন্য সে রাজাকারদের সংখ্যা বাড়ানাের ওপর জোর দেয়। রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করা স্পষ্টভাবে গােলাম আযমের উর্ধ্বতন অবস্থান নির্দেশ করে এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনে রাজাকারদের উসকানি দেওয়ার। স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। উসকানি কোনাে অপরাধের প্রাথমিক পর্ব এবং গােলাম আযম। তার অধীনস্থ আধা সামরিক বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে স্পষ্ট উসকানি দেয়।
সহযােগিতা
গােলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযােগ, সে মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনে সহযােগিতা করেছে। এ অভিযােগে রাষ্ট্রপক্ষ মুক্তিযুদ্ধকালের ২৩টি ঘটনা। উল্লেখ করেছে। এ অভিযােগের মূল্যায়ন করতে ট্রাইব্যুনাল দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করেছেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা। ঢাকায় কী ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে, তা গােলাম আযম আত্মজীবনীমূলক বই জীবনে যা দেখলাম-এ লিখেছে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালানাে নৃশংসতার বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সে সমমনা রাজনীতিকদের নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেনাদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। রায়ে আরও বলা হয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় সহযােগীরা নিরস্ত্র বাঙালিদের বৃহৎ পরিসরে ধ্বংস করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে। গােলাম আযম জানতাে, কিন্তু জানা সত্ত্বেও সে বারবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের প্রশংসা করেছে। একাত্তরের ২৯ এপ্রিল ও ১ সেপ্টেম্বরের দৈনিক পাকিস্তানে তা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। দুনিয়ার কোনাে বিবেকবান মানুষ হত্যাকারী বাহিনীর প্রশংসা করতে পারে না। কিন্তু গােলাম আযম উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগীদের প্রশংসা করেছে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, পাকিস্তানি সেনা ও অন্য আধা সামরিক বাহিনী যেমন শান্তিকমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস প্রভৃতি গােটা বাংলাদেশে যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেছে। এসব আধা সামরিক বাহিনী পূর্ণ ছিল মূলত জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে। জামায়াতের আমির হিসেবে এসব বাহিনীর ওপর গােলাম আযমের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। নেতা ও সংগঠনের মধ্যে উধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক থাকলে এবং অধস্তন বাহিনী সরাসরি গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটন করলে, অধীনস্থ বাহিনীর অপরাধের দায় উর্ধ্বতনের ওপর বর্তায়। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, সে পূর্ণ জ্ঞানে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা উপায়ে অধস্তন বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে সহযােগিতা করেছে।
সিরু মিয়া হত্যাকাণ্ড : গােলাম আযমের বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনে নির্দেশ দানের একমাত্র অভিযােগের মূল্যায়ন করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সিরু মিয়া দারােগা ও তার ছেলে আনােয়ার কামাল, নজরুল ইসলাম ও আবুল কাসেমসহ ৩৮ জনকে হত্যা ও নির্যাতনের এ অভিযােগে রাষ্ট্রপক্ষ আটজন সাক্ষীর (৭, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর সাক্ষী) সাক্ষ্য নিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তিনি নিজেও সিরু মিয়া, আনােয়ার কামালসহ অন্যদের সঙ্গে রাজাকারের হাতে ধরা পড়েন এবং হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তারা একসঙ্গে ছিলেন। রায়ে আরও বলা হয়, একাত্তরের ১ নভেম্বর মাকে লেখা আনােয়ার কামালের চিঠি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। ওই চিঠিতে লেখা, ‘আম্মা, সালাম নিবেন। আমরা জেলে আছি । জানি না কবে ছুটব । ভয় করবেন না। আমাদের ওপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের জেলে অনেক দিন থাকতে হবে । ঈদ মােবারক। -কামাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে গােলাম আযমের বিচারের বিষয়টি আলােচিত হতে থাকে । তদন্ত শেষে প্রায় দুই বছর পর ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠায়। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক চলে। ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলার রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ২০১১ সালের ১ নভেম্বর মানবতাবিরােধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গােলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলির কাছে দাখিল করে।
১২ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১এ প্রথমবারের মতাে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, তাকে গ্রেপ্তারের আবেদনও জানানাে হয়। কিন্তু অভিযােগ ‘অগােছালাে ও অবিন্যস্ত হওয়ায় ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তা রাষ্ট্রপক্ষকে ফেরত দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ দ্বিতীয় দফায় অভিযােগ দাখিল করলে ৯ জানুয়ারি তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করে গােলাম আযম, ট্রাইব্যুনাল তা খারিজ করে তাকে কারাগারে পাঠান। ১৩ মে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের পাঁচটি অভিযােগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সাক্ষ্য গ্রহণ গােলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৬ জন, আসামিপক্ষে দিয়েছেন একজন। ২০১২ সালের ১ জুলাই ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের অপর উল্লেখযােগ্য সাক্ষীরা হলেন মুক্তিযােদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম (এসপি মাহবুব); আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল; সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পক্ষান্তরে গােলাম আযমের পক্ষে একমাত্র সাক্ষী ছিলাে তার ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহহিল আমান আযমী।
প্রমাণিত হলাে গােলাম আযম সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যােগ্য
মানবতাবিরােধী অপরাধে জামায়াতের সাবেক আমির গােলাম আযমের বিচার যে বাংলাদেশের মাটিতে হতে পারল, এটি বড় কথা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য সে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যােগ্য এ কথা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। গােলাম আযমের বিরুদ্ধে নেতৃত্বের দায় প্রমাণিত হওয়ায় দেশের বিচারশাস্ত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হলাে। মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় গােলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডের রায় ঘােষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্টজনেরা এ কথা বলেন।
আনিসুজ্জামান
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করে এসেছি। কারও কোনাে নির্দিষ্ট শাস্তি দাবি করিনি। আদালতে উপস্থাপিত তথ্য ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বিচারকেরা যে রায় দিয়েছেন, তা আমি সুবিচার বলে গণ্য করি। গােলাম আযমের বিচার যে বাংলাদেশের মাটি হতে পারল, এটি বড় কথা। আদালত বলেছেন, তার কৃত অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযােগ্য। ১৯৯২ সালে জাহানারা। ইমাম যে গণ-আদালত গঠন করেছিলেন, আমি তার একজন বাদী ছিলাম। সেই প্রতীকী আদালতেও বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে গােলাম আযমের কর্মকাণ্ড মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অপরাধ। এত দিন পরে এটাও প্রমাণিত হলাে, ২১ বছর আগে আমরা যে প্রতীকী বিচারের আয়ােজন করেছিলাম, তা বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল।
সুলতানা কামাল
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও এই মামলার সাক্ষী সুলতানা কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বয়স বিবেচনায় গােলাম আযমকে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তার অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তিযােগ্য। গণ-আদালতের রায়েও গােলাম আযমকে মানবতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অপরাধে অপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের বিবেচনায় নব্বই বছরের যে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে গােলাম আযমের অপরাধের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র কমে যায় না। গােলাম আযম একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অপরাধের দায়ে অপরাধী, এর জন্য সে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যােগ্য এ কথা আজ প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
এম আমীর-উল ইসলাম
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, সভ্যতার অবমাননা ও মানবতাবিরােধী যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিচার হয়েছে। একাত্তরের বিজয় আরও সুসংহত হলাে। একাত্তরের মানবতাবিরােধী অপরাধ ছিল একটি নতুন ফ্যাসিবাদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা পবিত্র ধর্মের নামে অধর্ম করেছিল। ১৯৪৪ সালে হিটলারের পতনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সভ্যতার বিজয় সূচিত হয়। সেই বিজয় আরও সুসংহত হয়েছিল ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের মাধ্যমে। বিশ্বজনমত এরপর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ৭০ বছর ধরে কাজ করে চলছে। মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচারের রায়ের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। প্রকৃত অর্থে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মেরও জয় হয়েছে।
মুনতাসীর মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং এ মামলার সাক্ষী মুনতাসীর মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, জাতি এ রায়ের জন্য দীর্ঘ চার দশক অপেক্ষা করেছে। দেশবাসী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এত দিন ধরে যে রায় শােনার অপেক্ষায় ছিল, আদালত রায়টি দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, প্রতিটি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যােগ্য। তবে বয়স ও অসুস্থতার কারণে ৯০ বছর শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অন্যদের মতাে আমিও রায়ে হতাশ । আমি বিচারকদের কাছে অনুরােধ জানাব, ১৯৭১ সালে গােলাম আযমেরা বয়স, শিশু, নারী, পুরুষ কোনাে কিছুই বিবেচনায় নেয়নি। বিষয়টি আদালতের ভেবে দেখা উচিত। তবে সামগ্রিকভাবে বিচারে যেসব অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে, এটা বড় পাওয়া। গােলাম আযমের বিরুদ্ধে নেতৃত্বের দায় প্রমাণিত হওয়ায় আমাদের। বিচারশাস্ত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হলাে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(সি) ধারায় গণহত্যা বা জেনােসাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট গােষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত দেওয়া, জীবনযাপন পদ্ধতি বিনষ্ট করে তাদের আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের চেষ্টা, বংশবিস্তার রােধ করে গােষ্ঠীকে ধ্বংস করার চেষ্টা এবং এক গােষ্ঠীর শিশুদের আরেক গােষ্ঠীতে রূপান্তরের চেষ্টা গণহত্যা। বা জেনােসাইড হিসেবে গণ্য হবে। আযাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযােগ মুক্তিযুদ্ধকালে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তার সহযােগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরে হবি মাতব্বরের দোকানের কাছ থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরাইশি ও আলী আহসান। মােহাম্মাদ মুজাহিদের সঙ্গে আলােচনার পর রণজিৎকে অন্য একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে আযাদ। পরে রণজিৎ সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পান। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলে, পাকিস্তানি সেনাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী আযাদ শুধু রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষীকে (রণজিৎ নাথ) আটকে রেখে নির্যাতন ও অমানবিক যন্ত্রণাদানে উৎসাহিতই করেনি, বরং নিজেও নির্যাতন করেছে। কেন রণজিৎ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন? এর জবাব মেলে সাক্ষীর বর্ণনায় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলে রণজিৎকে দেখে মুজাহিদ (আলী আহসান মােহাম্মাদ মুজাহিদ, জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি) বলে, “সে একজন মুক্তিযােদ্ধা ও হিন্দু।’ এরপর রণজিৎকে আযাদের কাছে হস্তান্তর করা। হয়। এ জন্য রণজিৎকে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণের দায় আযাদের ওপর পড়ে। তৃতীয় অভিযােগ একাত্তরের ১৪ মে আযাদ ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকারসহ বােয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মােহন রায়কে গুলি করে হত্যা করে।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী (নেপাল চন্দ্র পাঠক) ও তৃতীয় সাক্ষী। (মােজাহের সিকদার) সাক্ষ্য পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, অপরাধ সংঘটনের সময় আযাদ ১০-১২ জন সঙ্গীসহ সশস্ত্র অবস্থায় ছিলে। আযাদ পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগী রাজনৈতিক দলের (জামায়াত) কাছ থেকে রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাে। এই দুই সাক্ষীই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। চতুর্থ অভিযােগ একাত্তরের ১৬ মে বেলা তিনটার দিকে আযাদ ১০-১২ জন রাজাকার নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধব চন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে।
সাধারণ সম্পাদক ছিলাে। ১৯৮৮ সালে সে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়। মতিউর। রহমান নিজামী বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমীর। ২২ এপ্রিল ১৯৭১ নিজামীর নেতৃত্বে গঠিত হয় কুখ্যাত আল-বদর বাহিনী। গঠনের পর ২৩ এপ্রিল দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় নিজামী বিবৃতি দিয়েছিল যে, আল-বদর একটি নাম একটি বিস্ময়। আল-বদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আল-বদর। যেখানে দুষ্কৃতিকারী সেখানেই আল-বদর। ভারতীয় চরদের কাছে আল-বদর সাক্ষাৎ আজরাইল।
আল-বদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিল মতিউর রহমান নিজামী। সে আল-বদর বাহিনীর নেতা হিসাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের ডাক দেয় । ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জামাতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে নিজামী বলে –
‘It is our conviction that the day is not far off when, standing side by side with our armed forces, our youth will raise the victorious flag of Islam the word over by defeating the Hindu Army and finishing off Hidustan.’ নিজামীর নেতৃত্বে আল-বদর বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সারা দেশে শত শত চিকিৎসক, শিক্ষক, লেখক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, গীতিকার, গায়ক এবং আরাে অনেক বুদ্ধিজীবীর তালিকা করে করে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৬ নভেম্বর সাত্তার রাজাকারের সহযােগিতায় ধুলাউড়ি গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩০জন মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করে। মতিউর রহমান নিজামীর পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী সাত্তার রাজাকার তার কার্যক্রম পরিকল্পনা করত। সঁথিয়া থানার মিয়াপুর গ্রামের মােহাম্মদ শাজাহান আলী যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে আটক মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে তার গলায় ছুরি চালানাে হয়েছিল। অন্যদের হত্যা করলেও শাজাহান আলী ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। গলায় কাটা দাগ নিয়ে তিনি এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। তার সহযােদ্ধারা, চাদ, মুসলেম, আখতার, শাহাজাহান-এদের বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে গরু জবাই করার লম্বা ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। সেদিন প্রায় ১০/১২ মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করেছিল জানােয়ার’ নিজামী। মুক্তিযােদ্ধা কবিরের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা মতিউর রহমান নিজামীর বলে শাজাহান আলী জানিয়েছেন।
রায় পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয় অপরাধের ধরন, আসামির অংশগ্রহণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আলবদর বাহিনীতে তাঁর অবস্থান বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালানাে, গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তার শাস্তি প্রাপ্য। অভিমতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিষয়ে নিজামীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে যে অভিযােগ আনা হয় তার মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ডেমরা, রূপসী ও বাউশগাড়ি গ্রামের সাড়ে চারশ মানুষকে গুলি করে হত্যা, ৩০-৪০ নারীকে ধর্ষণ, ৮ মে করমজা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট, ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়ি গ্রামে। নারী, পুরুষ, শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং বাঙালির স্বাধীনতার উষালগ্নে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় নিজামীর সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও পেশাজীবীদের হত্যাযজ্ঞে মূল নকশাকারী ও তা বাস্তবায়নকারী হিসেবে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামীর পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল। একাত্তরে হত্যা, স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর বর্বর হত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহ ও লােমহর্ষক ঘটনার অন্যতম নায়ক ছিলাে আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী। ফাসির আদেশ দিয়ে বিচারক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামী যেভাবে অপরাধ করেছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে তা হবে বিচারের ব্যর্থতা। তার নেতৃত্বে ও প্ররােচনায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, স্বাধীনতাকামীদের দমনপীড়ন, গণহত্যা, দেশের মেধাবী নাগরিক বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ আনীত অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর নির্মম হত্যা ও নির্যাতনে অংশ নেওয়ার দায়ে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে।
আলবদর বাহিনী সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলাে না, এটি গঠনের ক্ষেত্রে মূল হােতা ছিলাে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নিজামীকে বাংলাদেশের মন্ত্রী করা ছিল শহীদ ও নির্যাতিতদের মুখে চপেটাঘাত। নিজামী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছিলাে। কর্মকর্তা হিসেবে আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি, এতেই আনন্দ। রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির মাধ্যমে আযাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণ করতে পেরেছে। তার প্রতিফলনই রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মামলা ও বিচার কার্যক্রম
আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের অভিযােগের তদন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল২-এ আনে এবং সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন করে। ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করেন। কিন্তু সেদিন রাজধানীর উত্তরখানে আযাদের বাসভবন ‘আযাদ ভিলা’য় গিয়ে পুলিশ তাকে পায়নি। সে এর আগেই পালিয়ে যায়। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। সে হাজির হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পলাতক ঘােষণা করে তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ। শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল ৭ অক্টোবর তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাে. আবদুস শুকুর খানকে নিয়ােগ দেন। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধের আটটি অভিযােগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, চলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কোনাে সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। ২৩ ডিসেম্বর দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ২৬ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ঘােষিত হয় এ মামলার রায়।
ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় আট ধরনের অভিযােগ গঠন করেন। প্রথম অভিযােগ অনুসারে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তার সহযােগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে। তবে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তিনি পালাতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় অভিযােগ, ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে আৰু ইউসুফ পাখিকে ধরে এনে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রাখা হয়। আযাদ পাকিস্তানি মেজর আকরামের সঙ্গে আলােচনা করে পাখিকে আটক রাখে এবং অমানবিক নির্যাতন করে । তৃতীয় অভিযােগ অনুসারে, ১৪ মে আযাদ ফরিদপুরের বােয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মােহন রায় ও তার বড় ছেলে মণিময় রায়কে বাড়ির পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি ফিরতে বলে। তারা বাড়ির দিকে রওনা হলে আযাদ পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। এতে সুধাংশু নিহত ও মণিময় গুরুতর আহত হন। চতুর্থ অভিযােগ, ১৬ মে আযাদ রাজাকারদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামে মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করে । মাধবকে বাড়ি থেকে টেনেহিচড়ে নিয়ে আযাদ গুলি করে হত্যা করে। পঞ্চম অভিযােগ অনুসারে, ৮ জুন আযাদ ও তার চার-পাঁচজন সহযােগী বােয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করে। ষষ্ঠ অভিযােগে বলা হয়, ৩ জুন আযাদ ও তার সহযােগীরা সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করে। সপ্তম অভিযােগ অনুসারে, ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে বােয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরৎচন্দ্র পােদ্দার, সুরেশ পােদ্দার, শ্যামাপদ পােদ্দার, জতীন্দ্র মােহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল এবং মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করে। সেখান থেকে হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইটাকে অপহরণ করে ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। অষ্টম অভিযােগ অনুসারে, ১৮ মে আযাদ সাত-আটজন রাজাকারকে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক তরুণীকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে। সাত-আট দিন পর ওই তরুণী মুক্তি পান। বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন।
সেদিনই নতুন করে যুক্তিতর্ক শােনার সিদ্ধান্ত নিয়ে। ১০ মার্চ প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। ১০ থেকে ১২ মার্চ এবং ২৩ ও ২৪ মার্চ নিজামীর বিরুদ্ধে ৫ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরােজ, মােহাম্মদ আলী ও সৈয়দ হায়দার আলী। অন্যদিকে ১৩ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫ কার্যদিবসে নিজামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাডভােকেট তাজুল ইসলাম ও মিজানুল ইসলাম।
সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার