জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলে যে, অবস্থার চাপে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিরা বাধ্য হয়ে গৃহত্যাগ করে ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সাধারণ পরিষদের প্রতি সেই বিবৃতিতে সে আরও দাবি জানায়। জাতিসংঘের উদ্যোগে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরানাের ব্যাপারে ভারতকে যেন বাধ্য করা হয়। তার এহেন বক্তব্যে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গৃহত্যাগকারীরা ঠিক কোন অবস্থার চাপে পড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল সে সত্য গােলাম আযমের বক্তব্যে গােপন করা হয়েছে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করবার লক্ষ্য থেকে। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন auxliary force সমূহের দেশব্যাপী অপরাধমূলক কার্যক্রম, সুনির্দিষ্ট গােষ্ঠীসমূহের নিমূলকরণ কর্মসূচি, অন্যান্য দমন এবং নিপীড়নের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থেই ভীত সন্ত্রস্ত জনসাধারণ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবনকেও তাদের কাছে নিজ দেশে থাকার চেয়ে অধিক নিরাপদ মনে হয়েছিল সেই সময়, যা তার বক্তব্যে অনুপস্থিত। এটাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে সব auxliary force এর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এই দেশত্যাগের ব্যাপ্তি এবং মাত্রাকে বৃদ্ধি এবং ত্বরান্বিত করেছিল, নিজে সেই সব criminal organization সমূহের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল। এই বক্তব্যে আরও গভীর আরেক অপরাধমূলক দুরভিসন্ধির আভাস নিহিত রয়েছে। শরণার্থী শিবিরের আপাত নিরাপত্তায় আশ্রয় নেয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করার এই উদ্যোগ আসলে ছিল দেশত্যাগের ভিকটিমদের পুনরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং auxliary force-এর নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার পাঁয়তারা, যাতে তাদের বিরুদ্ধে নির্মূলকরণ, অসমাপ্ত হত্যাযজ্ঞ এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নতুন উদ্যমে চালানাে সম্ভবপর হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে উদ্দেশ্য করে এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ সরাসরি অপরাধ এবং তার সংগঠনের সম্পৃক্তি (complicity) প্রমাণ বহন করে ।
দৈনিক সংগ্রাম, সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তান, সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৭১) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মােহাম্মদপুর থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখে এসএসআই সিরু মিয়া তার বাসা চামেলিবাগে চলে যান। ২ মার্চ তিনি স্ত্রী আনােয়ারা বেগম, কিশােরপুত্র আনােয়ার কামাল ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ কখনাে পায়ে হেঁটে, কখনাে নৌকাযােগে নিজের বাড়ি রামকৃষ্ণপুর, থানাহােমনা, জেলা-কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে নিজ বাড়িতে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযােগী বাহিনীদের আক্রমণের কারণে দেশত্যাগে বাধ্য শরণার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা ও ভারতে পৌছাতে সাহায্য করেন। ৭/৮ দিন পর সিরু মিয়া নিজেও ভারতে চলে যান। সপ্তাহখানেক পর তিনি পুনরায় বাড়িতে ফেরত আসেন। ২৫ অক্টবর ১৯৭১ সিরু মিয়া দারােগা তার কিশাের পুত্র আনােয়ার কামাল, নজরুল, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর সেলিম ও শফিউদ্দিন ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় এস আই সিরু মিয়া ও নজরুল ইসলামের কাছে একটি করে রিভলবার ছিল। ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ সকাল ১০টার সময় ভারতে প্রবেশের প্রাক্কালে কুমিল্লা জেলার কসবা থানাধীন তন্তর চেকপােস্টে পেীছামাত্র রাজাকাররা তাদের আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঐ সময় একটি আর্মি জীপযােগে ৫/৬ জন পাকিস্তানি সেনা সেখানে আসে। তারা এস আই সিরু মিয়া দারােগা ও নজরুল ইসলামের কাছ থেকে রিভলবার দুটি নিয়ে যায় । সিরু মিয়া, তার ছেলে আনােয়ার কামাল, কাসেম, শফিউদ্দিনকে একটি চালের ট্রাকে তুলে দেয়া হয়। বেলা অনুমান ১২টার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একপ্রান্তে চালের ট্রাক থেকে তাদেরকে নামিয়ে সেখানে শান্তিকমিটি ও জামায়াত নেতা পেয়ারা মিয়া আসে ও গালিগালাজ করে।
তার সাথে আরাে ৪/৫ জন যুবক ছিল। তারা আটককৃতদের হাতে থাকা হাতঘড়ি, আংটি ইত্যাদি ছিনিয়ে নেয় এবং পায়ে হাঁটিয়ে বিকেল অনুমানিক ৪/৫টার সময় রাজাকার মঞ্জিল (অন্নদা স্কুলের সামনে কালিবাড়ী)-এ নিয়ে যায়। পথে তাদেরকে দেখিয়ে মাইক দিয়ে তারা প্রচার করতে থাকে যে, স্পেশাল বাহিনী অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে।’ সেখানে এক রাত থাকার পর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের সামনে দানা মিয়ার বাড়িতে পেয়ারা মিয়া ও তার সাথের লােকজন আটককৃতদের নিয়ে যায়। দিনের বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দানা মিয়ার বাড়ির নিচতলায় একটি কক্ষে নির্যাতন করতাে। শান্তিকমিটি ও জামায়াত নেতা পেয়ারা মিয়া এই নির্যাতনের তদারকি এবং নিজেও নির্যাতন করতাে । দানা মিয়ার বাড়ির অন্যান্য কক্ষেও নির্যাতন করা হতাে। সারাদিন নির্যাতনের পর রাতের বেলা আটককৃতদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা হাজতে রাখা হতাে এবং সকালবেলা থানা থেকে দানা মিয়ার বাড়িতে এনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লােকজন, পেয়ারা মিয়া ও তার সাথের লােকজন অমানসিক নির্যাতন করত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আলী। রেজা, ব্রিগেডিয়ার সাদাতউল্লাহ, মেজর আব্দুল্লাহ, হাবিলদার বশিরউদ্দিন এই নির্যাতন কেন্দ্রে এই নির্যাতন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করত। এভাবে দু-তিন দিন নির্যাতনের পর এস আই সিরু মিয়া ও তার ছেলে আনােয়ার কামাল নজরুল ইসলাম, আবুল কাসেম, জাহাঙ্গীর সেলিম ও শফিউদ্দিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এস আই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনােয়ারা বেগমের ভাই ফজলুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানায় তাদের দেখতে গেলে এস আই সিরু মিয়ার ছেলে আনােয়ার কামাল তার মাকে উদ্দেশ্য করে ০১,১১.৭১ তারিখে হাতে। লেখা একখানা চিঠি দেয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং শান্তিকমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার কারণে সে ইচ্ছে করলে আটককৃত সিরু মিয়া দারােগা, তার পুত্র আনােয়ার কামালসহ সকলকে মুক্ত করতে পারবে, এই বিশ্বাস রেখে ১৫ রােজার দিন এস আই সিরু মিয়ার স্ত্রী আনােয়ারা বেগম তার পিতা আয়েত আলী সরকারসহ ঢাকায় আনােয়ার বেগমের মেজ বােন মনােয়ারার স্বামী মােহসিন আলী খানের খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার বাসায় আসেন। মােহসিন আলী খান তখন খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলাে। গােলাম আযমের দুই ছেলে আযমী ও আমীন তার ছাত্র ছিল। আনােয়ারা বেগমের অনুরােধে তার ভগ্নিপতি মােহসিন আলী খান আসামীর কাছে তার মগবাজারের বাসায় গেলে সে বলে যে, সিরু মিয়া দারােগা ও তার পুত্র মুক্তিবাহিনী। তারা অস্ত্রসহ বর্ডারে ধরা পড়েছে তা সে জানে। একথা বলার পর মােহাম্মদ মুহসীন আলী খানকে দুই দিন পর পুনরায় তার সাথে দেখা করতে বলে। কথামতাে দুদিন পর মহসিন আলী খান গােলাম আযমের মগবাজারের বাসায় গেলে সে একটি গাড়িযােগে মহসিন আলী খানকে নিয়ে তৎকালীন পুরাতন সংসদ। ভবনের নিকটবর্তী নাখালপাড়ায় জামায়াতের অফিসে যায়। তার গাড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গার্ড ছিল। কিছুক্ষণ পর গােলাম আযম একটি খামবদ্ধ চিঠি। মহসিন আলীর হাতে দেয় এবং কাউকে ঐ চিঠি দেখাতে নিষেধ করেন এবং চিঠিটি তার দলের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তিকমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে দিতে বলে। চিঠিটি দিয়ে গােলাম আযম যা বলেছে তা তাকে বিস্তারিত বলেন।
আনােয়ারা। বেগম চিঠিটি নিয়ে নিজ বাড়িতে আসেন এবং তার ভাই ফজলুর রহমানকে গােলাম আযমের কথামতাে চিঠি কাউকে দেখাতে নিষেধ করে তা তার হাতে দেন। ফজলুর রহমান চিঠি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তিকমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে গেলে সে চিঠিটি পড়ে গােলাম আযমের লিখিত আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি ফজলুর রহমানকে দেখায়। এতে সিরু মিয়া দারােগা ও তার ছেলে আনােয়ার কামালকে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করার নির্দেশ ছিল। পেয়ারা মিয়া ফজলুর রহমানকে আরাে বলে যে, ‘যে চিঠি এনেছ তাতে নতুন কিছু নেই বাড়িতে গিয়ে আল্লাহ আল্লাহ কর।’ পরে ফজলুর রহমান বাড়িতে এসে আনােয়ারা বেগমকে জানালে বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করে। ২১ নভেম্বর ৭১ রােজার ঈদের দিন দিবাগত রাত ১টার দিকে পত্রের নির্দেশানুযায়ী সিরু মিয়া দারােগা, আনােয়ার। কামাল, নজরুল, শফিউদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেমসহ ৪০ জনকে স্থানীয় জেলখানা থেকে বের করে লরিতে ওঠায়। ওঠাবার পর শফিউদ্দিন পাকিস্তানে লেখাপড়ার করার কারণে উর্দুতে কথা বলতে পারায় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লার নির্দেশে তাকে ছেড়ে দিয়ে বাদবাকি ৩৯ জনকে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগী বাহিনী রাজাকার ও আল-বদররা পৈরতলা নামক স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে রাজাকার ও আল-বদরদের সহযােগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আটককৃতদের গুলি করে এবং একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ছাড়া বাদবাকি ৩৮ জন নিহত হয় । ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জখমী একজন প্রাণে রক্ষা পায়। গুলিতে নিহতদের লাশ পরে রাজাকার, আল-বদররা মাটিতে পুঁতে ফেলে ।