You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন প্রশাসনের বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণকারী এডওয়ার্ড কেনেডি - সংগ্রামের নোটবুক

এডওয়ার্ড কেনেডি

এডওয়ার্ড কেনেডি (১৯৩২-২০০৯) যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কেনেডি পরিবারের সদস্য, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ছােটভাই, ৪৭ বছর (১৯৬২-২০০৯) ধরে ডেমােক্রেটিক দলীয় সিনেটর, অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনের প্রণেতা, সুবক্তা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন প্রশাসনের বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণকারী, বাঙালি শরণার্থীদের ওপর অক্সফাম প্রকাশিত The Testimony of Sixty (21 October 1971) নামে প্রকশিত ডকুমেন্টে অন্তর্ভুক্ত অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত।
এডওয়ার্ড কেনেডির পূর্ণ নাম ছিল এডওয়ার্ড মুর কেনেডি। টেড কেনেডি নামে তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৩২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বােস্টনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জোসেফ পি কেনেডি এবং মাতার নাম রােজ ফিটজেরাল্ড কেনেডি। নয় ভাই-বােনের মধ্যে টেড কেনেডি ছিলেন সবার ছােট। তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতক এবং ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া থেকে ১৯৫৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি ম্যাসাচুসেটস বারে যােগদান করেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জন এফ কেনেডি ১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এর এক বছর ম্যাসাচুসেটসের ঐ আসন থেকে মাত্র ৩০ বছর বয়সে এডওয়ার্ড কেনেডি প্রথম সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আরাে ৭ বার সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জানুয়ারি ১৯৬৯ থেকে জানুয়ারি ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সিনেটে মেজরিটি পার্টির হুইপ ছিলেন। ১৯৭১-এ কেনেডির বয়স ছিল মাত্র ৩৯ বছর। তিনি ছিলেন সিনেটে জুডিশিয়াল রিফিউজি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি ছিলেন উদার, অত্যন্ত সংবেদনশীল ও মানবতাবাদী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তখন ছিল স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। একই সময়ে পাকিস্তানের সহায়তায় চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন জনমত, গণমাধ্যম, অধিকাংশ সিনেট সদস্য ও কংগ্রেসম্যান, এমনকি নিক্সন প্রশাসনের ভেতরকার কারাে-কারাে সমর্থন সহানুভূতি বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। তরুণ ও প্রভাবশালী সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি শুরু থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে ও পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বাঙালিদের ওপর গণহত্যার বিরুদ্ধে জোড়ালাে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১লা এপ্রিল তিনি এ মর্মে সিনেটে প্রথম বক্তব্য তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিনি মার্কিন সিনেট, সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি, জুডিশিয়াল রিফিউজি সাব-কমিটি, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে বাংলাদেশ সংকট, সংকট সৃষ্টির মূল কারণ, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের দায়-দায়িত্ব, পূর্ব বাংলায় গণহত্যা, ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের অবস্থা, পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানএর গােপন বিচার, বাংলাদেশ প্রশ্নে নিক্সন প্রশাসনের অবস্থান, সংকটের রাজনৈতিক সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি গভীরভাবে মনে করেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা এবং নির্বাচনে বিজয়ী মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা ছিল সংকটের মূল কারণ। সিনেটের জুডিশিয়াল রিফিউজি সাব-কমিটির সদস্য হিসেবে আগস্ট মাসে তিনি ভারতে সরেজমিনে বাঙালি শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে আসেন। তাঁর পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা সফরেরও কথা ছিল, কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় ভারতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের মধ্যেই তার ঐ সফর সীমাবদ্ধ থাকে। ভারত সফরকালে তিনি কলকাতা, বনগাঁও, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও ত্রিপুরার একাধিক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ পর্যন্ত তাদের করুণ কাহিনী মনােযােগ সহকারে শােনেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কীভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, শরণার্থী পরিবারের অনেককে হত্যা করেছে, যাত্রাপথে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা শরণার্থীদের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে, তাদের অনেককে পথিমধ্যে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, শরণার্থী শিবিরে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, সেনিটেশন ইত্যাদির অভাব, মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব এবং শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ বহু মানুষের মৃত্যু, বহু শরণার্থীর খােলা আকাশের নীচে আশ্রয় গ্রহণ, খাদ্য, পুষ্টি ও প্রয়ােজনীয় ঔষধের অভাবে অনেকের বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ব্যাপক হারে মৃত্যু এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃর্ক অবরুদ্ধ পূর্ব বাংলায় সমূহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের দিল্লিতে (১৬ই আগস্ট) ও দেশে ফিরে ওয়াশিংটনে (২৬শে আগস্ট) সংবাদ সম্মেলন করে তা সবিস্তার তুলে ধরেন এবং সিনেটেও এর বিশদ বিবরণ দেন। অক্টোবর মাসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অক্সফাম কর্তৃক The Testimony of Sixty (21 October 1971) নামে যে ডকুমেন্ট প্রকাশিত হয়, তাতেও তার এসব বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে তিনি মুজিবনগর সরকার-এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপর বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চার্চের নেতৃবৃন্দ এবং বাংলাদেশে কলেরা গবেষণায় নিয়ােজিত এক শ্রেণির মার্কিন ডাক্তারদের উদ্যোগে যথাক্রমে The Friends of East Bengal 978 Bangladesh Information Centre নামে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৪ই অক্টোবর থেকে ১০ দিন ধরে হােয়াইট হাউসের পার্শ্ববর্তী দ্য লাফায়েত পার্কে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের অনুকরণে তারা অস্থায়ী রিফিউজি ক্যাম্প স্থাপন করেন। বড়বড় পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের মধ্যে আয়ােজকদের অনেকে আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন কাটান। এটি ছিল তাদের এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা। এতে অনেক মার্কিন নাগরিক, প্রবাসী বাঙালি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ যােগ দেন। সেখানে সর্বধর্মীয় প্রার্থনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। অনুরূপ একটি সভায় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি উপস্থিত হয়ে তার সহমর্মিতা ঘােষণা করেন।
সিনেটর কেনেডি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গােপন বিচারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে তার মন্তব্য ছিল, ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয় লাভই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপারাধ’ (বঙ্গানুবাদ)। কেনেডি বাংলাদেশ প্রশ্নে নিক্সন প্রশাসনের পাকিস্তানি সামরিক সরকারে প্রতি অব্যাহত সমর্থনকে ভ্রান্ত নীতি’ হিসেবে অখ্যায়িত করেন। মূলত মার্কিন অস্ত্র সাহায্য পেয়ে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অব্যাহত গণহত্যা এবং তার নিন্দা জ্ঞাপনে অপারগতায় তিনি নিক্সন প্রশাসনের কঠোর সমালােচনা করেন। তিনি বাঙালিদের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনা করে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সুপারিশ করে আসেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বৃহৎ শক্তি ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগ ও বিশেষ ভূমিকা পালনের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। ১০ থেকে ১২ই নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসি-তে বাংলাদেশের মার্কিন বন্ধুদের পূর্ব বাংলার সংকটের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও অবস্থান বিষয়ক একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এডওয়ার্ড কেনেডি ছিলেন এর উদ্বোধক। সেখানেও তিনি তার ওপরে উল্লিখিত সুপারিশ তুলে ধরেন। পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্সকে তিনি তার এ অভিমত চিঠি আকারে লিখিতভাবে জানান। বাংলাদেশ সংকটের গ্রহণযােগ্য সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ রাখার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। ৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান সরাসরি ভারতের বিমান ঘাটিতে আক্রমণের মাধ্যমে সেদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে এক বিবৃতিতে নিক্সন প্রশাসন যুদ্ধের জন্য ভারতকে দোষারােপ করে। কেনেডি ৭ই ডিসেম্বর সিনেটে তাঁর বক্তৃতায় নিক্সন প্রশাসনের ঐ বিবৃতিকে ভারতকে ‘Scapegoat’ বানানাের চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে বলেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে নিক্সন প্রশাসনের ‘হতাশা, ব্যর্থতা ও পররাষ্ট্রনীতির দেউলিয়াপনা থেকে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি। একই দিন সিনেটে তাঁর ভাষণে তিনি বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ওপর জোর দিয়ে বলেন যে, শক্তি প্রয়ােগ করে কিছুতেই তা নস্যাৎ করা যাবে না এবং বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। ১৯৭২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি অপর ১২ জন সিনেট সদস্যসহ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পররাষ্ট্রনীতির সংশােধনের সুযােগ গ্রহণে সিনেটে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উল্লেখ্য, ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭২ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকায় আসেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলেও মার্কিন জনগণসহ সারাবিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন। সেই সংগ্রামের একজন হিসেবে আমি আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আজ আপনারা স্বাধীন এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সারাবিশ্বের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আমি আপনাদের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে অভিবাদন জানাই।’ এ ভ্রমণকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে একটি বটগাছের চাড়া রােপণ করেন, যা তাঁর স্মৃতিকে আজো অম্লান করে রেখেছে।
দুরারােগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালের ২৫শে আগস্ট এডওয়ার্ড কেনেডি ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশের এই অকৃতিম বন্ধুকে Friends of Liberation War সম্মাননায় (মরণােত্তর) ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]।
তথ্যসূত্র: A M A MUHITH, AMERICAN RESPONSE TO BANGLADESH LIBERATION WAR, Dhaka, University Press Limited 1996; https://en.wikipedia.org/wiki/Ted_Kennedy; Morning News, 15 February 1972

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড