ইতিহাসের অনিবার্য দায়মুক্তি
ত্রিশ লাখ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু, গণহত্যা, পাশবিক নির্যাতনের শিকার চার লাখ নারী, এক কোটি অসহায় মানুষের প্রতিবেশী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ ও অমানবিক জীবন যাপন, ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ নয় মাস যুদ্ধের এ পরিসংখ্যান বিশ্বইতিহাসে আর কোনাে যুদ্ধের সাথে তুলনীয় নয়। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা, মা-বোেনদের সম্ভ্রম, শীর্ষ-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এ হিংস্রতার, বর্বরতার, নৃশংসতার কোনাে বিচার হবে না জাতি হিসাবে এ কলঙ্ক বয়ে বেড়ানাে কোনাে ভাবে সম্ভব নয়। । যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শুধু পাকিস্তানিরা নয় এদেশীয় কোলাবােরেটররাও এর আওতাভুক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আইনটি দালাল আইন হিসেবেই প্রণীত। দালালরা সহযােগিতা না করলে পাকিস্তান সেনারা এভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারতাে না।ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শান্তির ধর্ম হিসেবেই ইসলামের প্রসার ঘটেছে। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের ইমেজ সংকট আছে কিন্তু তার কারণ ইসলাম নয় বরং কতিপয় মুসলমান যারা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। ইসলাম কখনােই কোনাে প্রকার, সংঘাতের অনুমােদন দেয় না। সকল মুসলমান একটি উম্মাহ (community)। ধর্মীয় কারণে সংঘাত কেন, বিভাজন বা বিভক্তিকেই হারাম বলা হয়েছে এবং এটি আল্লাহর নির্দেশ। আলকোরআনে বলা হয়েছে
“Surely this community of yours is one community (Ummah), and I am your Lord” (21:92) “And hold fast, all together, by the rope which Allah (stretches out for you), and be not divided among yourselves. (3:103)। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “One who gets up in the morning and his mind is not preoccupied with the matters of Muslims, is not one of them.” Sahih Bukhari
শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিকেই উত্তম পথ হিসেবে। নির্দেশিত হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, জোরজবরদস্তিকে নিষিদ্ধ করা ছাড়াও বলা হয়েছে –
If anyone kills any innocent people whether muslim or nonmuslim) it is as though he has killed the whole humanity.
উল্লেখিত নির্দেশগুলােতেই শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ নয়, ইসলামে যুদ্ধের কয়েকটি মৌলিক নির্দেশনা রয়েছে যা বিশ্বের কোনাে মুসলিম আলেম কিংবা মুফতি অস্বীকার করতে পারবে না । তন্মধ্যে প্রতিপক্ষের নারী ও শিশুদের আক্রমণ না করা, গাছপালাপ্রাকৃতিক সম্পদ-পশুপাখির ক্ষতিসাধন না করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তির প্রাধান্য এ বিষয়গুলাে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য এবং মুসলিম হিসেবে অনুসরণ আবশ্যকীয়। ১৯৭১ সালে ইসলাম অননুমােদিত এই হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিচার যদি দাবি করা হয় তাহলে ইসলামিক আইন অনুযায়ী শীর্ষ রাজাকারদের শিরােচ্ছেদ অবধারিত। সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হবে হাত-কাটা থেকে ক্ষেত্রবিশেষে দোররা মারা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ইসলামিক আইন অনুযায়ী কাউকে হত্যা করা হলে সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বোচ্চ শাস্তি হয় এবং নিহত পরিবার ক্ষমা না করলে শাস্তি মওকুফের ক্ষমতা কারও নেই। ৭১-এ ইসলামের জিকির তােলা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা কোন্ শ্রেণির মুসলিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলামের আলােকে যদি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করা হয় তাহলে উপসংহার কি তা উল্লেখ করা নিপ্রয়ােজন। অপরাধী শাস্তি পাবে এটি ইসলামেরও বিধান। কোনাে ব্যক্তি মাওলানা হলে তার বিচার করা যাবে না এরকম কোনাে নির্দেশনা নেই, বরং অপরাধ দমন করার। ক্ষমতা না থাকলে অন্তত হৃদয় থেকে যদি তার বিরােধিতা করেন তবেই আপনি। মুমিন হবেন।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল
যুদ্ধাপরাধের বিচার বলতে প্রচলিত অপরাধ আইনে অথবা আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালা ভঙ্গের অভিযােগে অভিযুক্তদের বিচার বােঝায়। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রচলিত আইনে সম্ভব নয়। এ অপরাধের বিচার সংশ্লিষ্ট দেশ/ দেশগুলাে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সম্পন্ন করে।
বিশ্বে যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ১৯১৮ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্স এই মর্মে একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, আন্তর্জাতিক আইন ও মানব সভ্যতার মূলনীতি অগ্রাহ্য করে যারা যুদ্ধ করবে তারা অব্যাহতি পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম যুদ্ধাপরাধের বিচার হয় ক্যাপ্টেন হেনরিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত হেনরি একটি কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল, যেখানে আটক ২৪৮৬৬ জন যুদ্ধবন্দি মৃত্যুবরণ করে। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১৩টি অভিযােগের অন্যতম ছিল হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে হাজার হাজার গ্রন্থ, চিত্রকলা ছাড়াও বিভিন্ন শহরে শুধু হলােকাস্ট মিউজিয়ামের সংখ্যা ছিল শতাধিক। ১৮৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন এই চার দেশের স্বাক্ষরিত মস্কো ঘােষণায় বলা হয়, যে সকল রাজনৈতিক নেতা ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগ পাওয়া যাবে তাদের গ্রেফতার করে বিচার করা হবে।
টোকিও ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল
The International Military Tribunal for the far east (IMTF) RTC fatto এই ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত হয়। বিচার কাজ শুরু হয় ১৯৪১ সালের ৩ মে। এই ট্রাইব্যুনালে তিন শ্রেণির অপরাধকে শ্রেণিবিভাগ করা হয়।
১. শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ অবৈধ যুদ্ধ ঘােষণা ও পরিচালনা যার জন্য।
রাজনৈতিক ও সরকারি নীতি-নির্ধারক ও সমরনায়করা দায়ী
২. যুদ্ধাপরাধ ।
৩. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। এ বিচারে প্রায় ৫৭০০ জনের বিচার করা হয়, তন্মধ্যে রাজকীয় উপদেষ্টাসহ ২৮ জন প্রথম শ্রেণির অপরাধে দায়ে শাস্তি পায়।
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের বিচারে সবচেয়ে আলােচিত এটি। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি দেশগুলাে লন্ডন চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে বলা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে। এই আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের স্থান নির্ধারিত হয় জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরের প্যালেস অব জাস্টিস ভবন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসনকে প্রধান প্রসিকিউটর করে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় । মিত্রশক্তির দেশগুলাে তাদের প্রসিকিউটর নিয়ােগ করে। ২০ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে এই ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য শুরু করে। এ ট্রাইব্যুনালে ডাক্তার (United States of America v. Karl Brandt) এবং বিচারকদের (The United States of America vs. Josef AItstotter) বিচারের জন্যও Subsequent Nuremberg Trials-এর অধীনে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ।
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমেই প্রথম যুদ্ধাপরাধ আইনশাস্ত্রে নির্দিষ্টভাবে বিধিবদ্ধ হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের ৬ নং ধারায় শাস্তিযােগ্য অপরাধ হিসাবে। পরিগণিত হয়
১, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ
৩, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
বিচারের মানদণ্ড প্রাথমিক প্রমাণ হিসাবে লিখিত বক্তব্য, সরকারি দলিল এবং পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। সাক্ষী ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা, সেনাবাহিনীর সদস্য, গেস্টাপাে এবং এসএস পার্টি-সহ বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে স্বাক্ষরিত লক্ষাধিক এফিডেভিট প্রামাণ্য দলিল হিসাবে বিবেচনা করা হয় । • এই ট্রাইব্যুনাল অনুসারে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার
প্রধানও অব্যাহতি পাবে না। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ১২৩ জনের বিচার করা হয় যাদের অধিকাংশের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। উল্লেখ্য, এই ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, নাৎসী পার্টি-সহ সাতটি সংগঠনের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। হয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত প্রথমে গ্রহণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী বাংলাদেশ সরকার । ১৯৭১ সালের ২৪ মে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মুখপাত্র পাকিস্তানের সাথে গােপন আলোচনার জন্য যে চারটি শর্ত আরােপ করেছিল তার মধ্যে ৩নং শর্ত ছিলাে আন্তর্জাতিক আদালতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতাে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
১ জানুয়ারি ১৯৭২ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । হাইকোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোনাে বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোনাে মনােনীত ব্যক্তি মৌখিক ও লিখিত সক্ষাৎকার গ্রহণ করে রিপাের্ট পেশ করবেন বলে ঘােষণা করা হয়। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে দেশে ফিরেই ঘাতক দালালদের বিচারের মুখােমুখি করার ঘােষণা দেন। রমনা রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি বলেন, বিশ্বকে মানব ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে।…যারা দালালী করেছে, আমার শত শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে, মা বােনকে বেইজ্জতি করেছে তাদের কি করে ক্ষমা করা যায়? তাদের কোন অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না। ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পরও তিনি একই মত পুনর্ব্যক্ত করেন। ৬ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দশ লক্ষ লােকের বৃহত্তম জনসমাবেশকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যারা গণহত্যা চালিয়েছে তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, এদের ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে মিছিল রাজধানী ঢাকায় দেখা গিয়েছিল সেটি ছিল ‘৭১ এর গণহত্যাকারী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে । ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা গণহত্যাকারী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে। নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ এটির আয়ােজন করেন। নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ মঞ্চের দ্বিতীয় কর্মসূচী ছিল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্মারকপত্র প্রদান, ১৯৭২ সালের ১৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সমবেত হয়ে প্ল্যাকার্ডসহ মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মারকপত্র দিয়ে ৭১-এর গণহত্যার বিচারের দাবি করেছিলেন। ১৯ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক শেষে এক যৌথ ঘােষণায় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানী সেনাসদস্য। এবং বেসামরিক কর্মচারী যারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছিল তাদের দ্রুত বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ, ১৯৭২
যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অস্থিতিশীলতা রক্তের বৃত্তের মধ্য হতে সদ্যজাত বাংলাদেশে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। দেশজ প্রেক্ষিতে পাকিস্তান। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশকারী দালালদের বিষয়টির মীমাংসায় আইনানুগ পথেই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অগ্রসর হতে হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি। পেয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ১৪দিন পর বঙ্গবন্ধু দালাল অধ্যাদেশ নামে একটি আইন জারি করেন। এই আইন জারির মধ্যদিয়ে পাকিস্তান হানাদারদের এ দেশীয়। দালালদের বিরুদ্ধে বিচারের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হয়। ২৪ জানুয়ারি ৭২-এ ঘােষিত এই অধ্যাদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দেশে গণহত্যায় লিপ্ত দখলদার পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সহযােগী দালালদের দ্রুত বিচার করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা ঘােষণা করেন। রাষ্ট্রপতি এই আদেশ বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদেশ-৭২) নামে অভিহিত হয়। এবং তা অবিলম্বে কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই আদেশ ৬ ফেব্রুয়ারি, ‘জুন ও ২৯ আগস্ট ১৯৭২ তারিখে ৩ দফা সংশােধনীর পর চূড়ান্ত হয়। ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ সরকার এক ঘােষণায় পাকিস্তানি বাহিনীর দালালদের বিচারের জন্য ৭২টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ঘােষণায় বলা হয় বাংলাদেশে গণহত্যা চালানাের কাজে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যারা সহযােগিতা। করেছে তাদের বিচার ত্বরান্বিত করা এবং সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলাে গঠন করা হয়েছে। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২-এর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ অনুসারেই গঠিত হয় এই ৭২টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩
৭২-এর দালাল আইনে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উল্লেখ করা হলেও এর যথাযথ সংজ্ঞা দেয়া হয়নি এবং অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের আওতায় নেয়া হয়েছিল। যার ফলে চাক্ষুস প্রমাণের অভাবে বহু হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা যায়নি। দালাল রক্ষার এই ষড়যন্ত্র কুখ্যাত দালালদের তথাকথিত বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত জনসাধারণের কাছে ধরা পড়েনি। তবে সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি প্রথম থেকে এই চক্রান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এরপর যখন দেখা যায় সরাসরি গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী দালালরা নামমাত্র শাস্তি পেয়ে নিষ্কৃতি পাচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সচেতনতা আরাে বৃদ্ধি পায়। ২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখের দৈনিক বাংলায় দালাল আইন সংশােধন প্রয়ােজন শীর্ষক একটি রিপাের্ট লেখা হয়- দেশ স্বাধীন হবার পর দালাল বলে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের শতকরা ৭৫ জনেরই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ অধিকাংশ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযােগ পাওয়া যাচ্ছে না। দালাল আইনের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করে। এই আইন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষত্রে আইনশাস্ত্রে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে, কারণ এর আগে কোনাে দেশ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শাস্তির বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য এ ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ মৌলিক আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় সংসদ প্রণীত এই আইনে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দান করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রণীত এই আইনের কিছু সংশােধনী এনে এখন মানবতাবিরােধী (বা যুদ্ধাপরাধ) অপরাধের বিচারের দু’টি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। এটি পরিচিতি ১৯৭৩ সালের ১৯নং আইন হিসেবে। এই আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই আইনে বলা হয় – “যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণে গণহত্যা, মানবতাবিরােধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদানের ও তৎসঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঘটনাবলীর ব্যবস্থা নেওয়া যুক্তিযুক্ত, এতদ্বারা নিম্নবর্ণিত আইন পাস করা হইল।
সংক্ষিপ্ত শিরােনাম, আওতা সূচনা –
১. এই আইন আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ নামে। অভিহিত হইবে। ২. ইহা সমগ্র বাংলাদেশে প্রযােজ্য হইবে ৩. ইহা তাৎক্ষণিক কার্যকর হইবে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংভাবে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও ফিরে আসার সুযােগ পায়। স্বল্প সময়ের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় খন্দকার মুশতাক আহমেদ। দেশে স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তি ও প্রতিবিপ্লবী ঘাতক দালালদের সর্বস্তরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এক সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম একাধারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান হন প্রধান সেনাপতি। জিয়া পুতুল রাষ্ট্রপতি সায়েমকে দিয়ে কোলাবরের্টস আইন বাতিল করান। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এম এ সায়েম ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক অর্ডিন্যান্স জারি করে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কোলাবরের্টস (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশটি (১৯৭২ সালের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট আদেশ) বাতিল করেন। এর ফলে দালালদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সমস্ত মামলা আইনি বৈধতা হারায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ বিশেষ করে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্দান, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এর পক্ষ হতে পূর্ণ সাহায্যও সহযােগিতা প্রাপ্তির। লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতা বিধানাবলী ১২ অনুচ্ছেদ। তুলে দিয়ে পাকিস্তানি ধারায় শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে দাঁড় করলেন। এবং একই সালে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার সম্বলিত ফরমান জারি করেন এবং সংবিধানের ৩৮নং ধারার শর্তসমূহ বাতিল করেন। ১৯৬৭ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি নিয়ন্ত্রণ (পিপিআর) জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। গঠনের সুযােগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধী দালালদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযােগ সৃষ্টি করে দেন। পাশাপাশি সামাজিক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও যুদ্ধাপরাধী।
ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসন করা হয়। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে স্বৈরাচারী দাপটে সামরিক শাসনের আওতায় জনগণকে বুটের তলায় রেখে স্বাধীনতা বিরােধীদের ক্ষমতার অংশীদারিত্বে আনার ক্ষেত্র প্রস্তুতে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে স্বাধীনতা বিরােধীদের প্রধান পৃষ্ঠপােষক ব্যক্তি হিসাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবেন, সন্দেহ নেই। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য যেসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে যুদ্ধ। পরবর্তী সময়ে স্বজনহারা পরিবারবর্গ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছিল, জিয়াউর রহমান বিচারের পরিবর্তে তাদেরকে পুরস্কৃত করেন। মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের কমাণ্ডার জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাধীনতার সরাসরি বিরােধীতাকারী শাহ আজিজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করেন। মশিউর রহমান, মীর্জা গােলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, শাফিউল আলম এবং আব্দুল আলীমের মতাে চিহ্নিত রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রী বানানােসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নাগরিক আইনের সংশােধন এনে স্বাধীনতার বিরােধীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে দেশে প্রবেশের সুযােগ দেন। এসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধ ধ্বংসের জন্য কাজ করেন। নাগরিকত্ব আইন সংশােধনের সুযােগ নিয়ে গােলাম আযমও। নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আবেদন জানায়। জিয়া নাগরিকত্ব ফিরিয়ে না দিলেও অসুস্থ মাতাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেন। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানি পাসপাের্ট নিয়ে তিন মাসের ভিসায় অসুস্থ মাতাকে দেখার অজুহাতে গােলাম আযম বাংলাদেশে আসে। এই নরপিশাচ গােলাম আযম আর পাকিস্তানে ফিরে যায়নি। উল্টো নানা সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাক্টরে পরিণত হয়।
২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছােট্ট এক কলাম সংবাদ বেরিয়েছে জামাতে ইসলামীর পাঁচ দিনব্যাপী মজলিশে শুরার বৈঠকে গােলাম আযমকে দলের আমির নির্বাচন করা হয়েছে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় গােলাম আযমের ঘােষণা দিয়ে রাজনীতিতে যােগদান স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আহত করেছিল। এর প্রতিবাদে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেন। ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক নির্মূল কমিটি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক বােরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, হাশেম খান, আলী যাকের, সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, নীলিমা ইব্রাহিম, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমানসহ আরাে অনেকেই জড়িত ছিলেন এর সাথে। ১০১ জন সদস্য নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। কিছুদিন পর রাজনৈতিক দলের সমর্থনের জন্য ৭২টি সংগঠন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সমন্বয় কমিটি ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুটি গণতদন্ত কমিশন রিপাের্ট প্রকাশ করে এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গােলাম আযমের বিরুদ্ধে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন প্রথমে পর্যায়ে ৮জন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৭ জন যুদ্ধাপরাধীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভােগীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দুটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। আন্দোলনকে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে। দেশদ্রোহী মামলা দেয়। এই মামলা মাথায় নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে মারা যান। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ‘৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতাবিরােধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ‘৭৩-এর আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে বসেছে অস্থায়ী আদালত। ইতােমধ্যে অনেক শীর্ষস্থানীয় দালালকে গ্রেপ্তার করে মুখােমুখি করা হয়েছে বিচারের।
হযরত মুহাম্মদ(স.) যখন ১০২৪ (প্রায়) জন নিয়ে মক্কা বিজয় করেন তিনি ক্ষমা। করে উদারতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, এটি যেমন সত্যি তেমনি এটিও সত্যি যে বীর হামজা (রা.)’র কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দার শিরােচ্ছেদ করা। হয়েছিলাে। যে কোনাে দেশে যুদ্ধ পরবর্তী অস্থির অবস্থায় সাধারণ ক্ষমা একজন রাষ্ট্রনায়কের উদারতার পরিচয়ই বহন করে না একই সাথে তার নেতৃত্বের পরিপকতা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের একটি শ্রেণি পাকিস্তানের প্রতি নীতিগত সমর্থন পােষণ করতাে অথবা তাদের মতাদর্শের অনুসারী ছিল অথচ কোনাে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে রাজনৈতিক রঙ দেয়ার চেষ্টা করার সম্ভাবনাও থাকে। গৃহযুদ্ধের দৃষ্টান্তও ইতিহাসে রয়েছে। আমরা এক সময় কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক এক রাজাকারকে প্রহার করার পােস্টার রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছি। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট ছিল তবু এ সাধারণ ক্ষমা দ্রুততম সময়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছিল। তাই মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনী। বাংলাদেশ ত্যাগ করে এবং এত দ্রুততম সময়ে মিত্রবাহিনীর ফিরে যাবার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু এই সাধারণ ক্ষমায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল যারা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল তারা সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত নয়। বঙ্গবন্ধু দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় কুলদীপ নায়ারের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তাদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যৎ বংশধর এবং বিশ্বসমাজ আমাকে ক্ষমা করবে না।’
১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি
আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিচারের আওতায় আসার কথা। তাদের মুক্তি দেয়া হল কেন? কিছু বিষয় মনে রাখা প্রয়ােজন। যুদ্ধাপরাধের বিচার সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে হয়ে থাকে। জার্মানি মিত্র বাহিনীর সাথে জার্মান যুদ্ধবন্দিদের বিচারের অঙ্গীকার করেছিল কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার কারণে তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। যেমনটি করেনি পাকিস্তান এবং ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের শাসকরা। ৭০ এর নির্বাচনের পর থেকে বিশেষত ৭১ সালের জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে শুরু করে। স্বাধীনতার পর বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী পাকিস্তানে ছিল। তাদের নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিদেশীয় চুক্তিতে ১৫ নং ধারায় বলা হয়, যেহেতু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ফেরত পাঠানাের অনুরােধ করেছিল সে প্রেক্ষিতে তাদের ক্ষমা করা হয়।’ এ প্রেক্ষিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন বলেন, পাকিস্তান সরকার তাদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিধায় তাদের দেশে ফেরত পাঠানাে হয়। তাই পাকিস্তানি ও এদেশীয় দালালদের বিচার এক করে দেখার উপায় নেই। উল্লেখ্য, যুদ্ধফেরত ১৯৫ জনের সকলেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনাে তামাদি হয় না
বিশ্বের অনেক দেশেই ৪০-৫০ বছর পর মানবতা-বিরােধী অপরাধের দৃষ্টান্ত আছে, এখনাে বিচার চলছে। ২০০৮ সালে কম্বােডিয়ায় যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় তখন প্রশ্ন করা হয়েছিল ৩০ বছর পর কি বিচারের প্রয়ােজন আছে? তখন কম্বােডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিল – “অবশ্যই এ বিচার জরুরি। এ বিচারের মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র দায়মুক্তই হবাে না। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হবে।’ ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌশলী জ্যাকসনের একটি মন্তব্য আইনশাস্ত্রে প্রবাদ স্বরূপ, যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনাে তামাদি হয় না। ৭১-এর মানবতা বিরােধী অপরাধের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি সহ প্রগতিশীল সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করে আসছে। যুদ্ধাপরাধীদের। বিচারে নির্মূল কমিটির অবদান অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারা ৭১টি সংগঠনকে একত্রিত করে এবং তারা সংহতি প্রকাশ করে। জনমত গঠন ও বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করা ছাড়াও তাদের কর্মকাণ্ড এবং তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত তথ্য, প্রমাণ, দলিল এ বিচারকার্যকে অনেক সহজতর করেছে, কারণ এসব প্রামাণ্য সংগ্রহের দায়িত্ব ট্রাইব্যুনাল এবং সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের করতে হতাে। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয় এদেশের জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতাে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। এ বিচার সম্পন্নের জন্য ২৯ জানুয়ারি ২০০৯। সংসদে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাশ হয় এবং ২৫ মার্চ ২০১০ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা কবি আহমদ সেলিম ও এডভােকেট জাফর মালিক এ ট্রাইব্যুনালের পক্ষে একাত্মতা ঘােষণা করে পাকিস্তানে এ সম্পর্কে জনমত সৃষ্টি করেন। প্রচলিত আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোনাে সুযােগ নেই। আমাদের দেশে অপরাধ দমনেও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বা দ্রুত বিচার আদালত গঠিত হয়েছে। টোকিও ট্রায়াল, ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, হ্যাগসহ অন্যান্য যে কোনাে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ে আমাদের গঠিত ট্রাইব্যুনাল অনেক বেশি উদার। শুধুমাত্র শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে যাদের অপরাধ, অপকর্ম ও নৃশংসতা নিয়ে দ্বিমত পােষণ করার কোনাে সুযােগ নেই।
এ ট্রাইব্যুনাল কোলাবােরেটরদের বিচার সম্পন্ন করার যা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে The term collaborator, namely Razakars, Al-Badr and Al-Sams, who assisted the Pakistan Armed forces. কোলাবােরেটর বা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নিয়ে, তাদের বর্বরতা নিয়ে। অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় তা প্রচারিত হয়েছে। চার দশক সময়কাল ইতিহাসে খুব দীর্ঘ কোনাে সময় নয়, যার জন্য গবেষণা প্রয়ােজন। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সগ্রামের তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত সংবাদগুলাের চেয়ে আর কোনাে বড় প্রমাণ কি প্রয়ােজন আছে? ভ্রষ্ট রাজনীতির সুফল-ভােগকারী এই দুর্ধর্ষ অপরাধীরা স্বাধীনতা-বিরােধীরা কখনাে ভুল শিকার করেনি, বরং স্পর্ধার সাথে মন্তব্য করে ‘৭১-এ কোনাে ভুল করি নাই’, ‘দেশে কোনাে স্বাধীনতাবিরােধী ছিল না।’ জাপান কর্তৃক যুদ্ধবন্দি চীনাদের হত্যার কারণে ২০০৫ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনার পূর্ব পর্যন্ত চীন জাপানের সাথে কোনাে আলােচনায় কখনাে বসেনি। দাবি জানানাে সত্ত্বেও পাকিস্তান কখনাে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। অনেক বছর অপেক্ষার পর বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। প্রাথমিক ভাবে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের এ বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এবং ইতিমধ্যে ১৫টি মামলার রায় ঘােষিত হয়েছে। কার্যকর করা। হয়েছে একজন শীর্ষ যুদ্ধপরাধীর বিচারের রায়।
সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার