You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক এনামুল হক - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক এনামুল হক

এনামুল হক, বীর প্রতীক (১৯৫২-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৫২ সালে বাগেরহাট জেলার মােল্লারহাট উপজেলার আটজুরি ইউনিয়নের বাসাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আ. হাকিম গাজী এবং মাতার নাম ফুলজান বিবি।
এনামুল হক ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন। করাচিতে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তাকে যশাের সেনানিবাসে বদলি করা হয়। ১৯৭১ সালে তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। সেনাবাহিনীতে চাকরিকালে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব তিনি বুঝতে পারেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। একই নীলনকশা অনুযায়ী তারা যশাের সেনানিবাসে ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিকদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে অনেক নিরস্ত্র সৈনিককে হত্যা করে। এনামুল হক এ-সময় ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তিনি যশাের সেনানিবাসে যােগদান না করে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধ করতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মাে. আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বয়রা সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। বয়রা সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কে এম নাজমুল হুদা। খুলনা, যশাের ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে এ কোম্পানি গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। এনামুল হক সেসব যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে যশাের জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার সঙ্গানন্দপুর ইউনিয়নের কাশীপুরের অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে কাশীপুরের পাশ দিয়ে কপােতাক্ষ নদ প্রবাহিত। এ নদের ওপরের সেতু দিয়ে চৌগাছা উপজেলার সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার পথ ছিল। সামরিক কৌশলগত কারণে মুক্তিযােদ্ধা এবং হানাদার বাহিনী উভয়ের নিকট কাশীপুরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ঝিকরগাছা উপজেলার পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প থেকে ৫৫ ফিল্ড এবং ২২ এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যরা কাশিপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে টহল দিত। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল গােপনে কাশীপুরে অবস্থান নেয়। সুযােগ বুঝে প্রায়ই তারা হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করতেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালে কাশীপুরে অসংখ্যবার যুদ্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ই নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল কাশীপুর আসছে। এমন খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তারা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এনামুল হক। হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
এনামুল হকসহ মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় এনামুল হক শত্রুদের একেবারে কাছে চলে আসেন। হঠাৎ হানাদারদের একটি গুলি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়। মারাত্মক আহত অবস্থায়ও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁর অদম্য মনােবলে সহযােদ্ধারা উৎসাহিত এবং উজ্জীবিত হন। কিন্তু কিছু সময় পরেই এনামুল হক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পলায়ন করে। যুদ্ধশেষে সহযােদ্ধারা শহীদ এনামুল হকের মরদেহ কাশীপুরেই সমাহিত করেন। কাশীপুরে আরাে ৪ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধা নূর মােহাম্মদ, বীরশ্রেষ্ঠ, মনিরুজ্জামান, বীর বিক্রম, আব্দুস সাত্তার ও বাহাদুরের সমাধি রয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতাপূর্ণ অবদান ও নিজ জীবন উৎসর্গ করায় বাংলাদেশ সরকার শহীদ এনামুল হক গাজীকে ‘বীর প্রতীক’ (মরণােত্তর) খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। [মনিরুজ্জামান শাহীন]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড