You dont have javascript enabled! Please enable it!

এপােলাে পেট্রোল পাম্প অপারেশন

এপােলাে পেট্রোল পাম্প অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় ১৪ই আগস্ট রাতে। পাম্পটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম শহরের হযরত মিসকিন শাহ মাজারের দক্ষিণে ঐতিহ্যবাহী গণি বেকারির সামনে এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার ও কনভেনশন মুসলিম লীগ-এর নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডস্ হিল-এর নিচে। পাম্পের মালিকও ছিলেন তিনি। যেহেতু গুডস্ হিলে ধরে এনে বাঙালিদের নির্মম নির্যাতন করা হতাে, সেহেতু এ বাড়ির ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের চরম ক্ষোভ ছিল। উপরন্তু, ফজলুল কাদের চৌধুরী শুধু পাকিস্তানি আদর্শেই বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযােগী। তার সার্বিক সহযােগিতায় হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহরসহ বৃহত্তর এ অঞ্চলে বহুসংখ্যক বাঙালিকে নির্যাতন করে হত্যা করে। এসব কারণেই মুক্তিযােদ্ধারা তাঁর এই পেট্রোল পাম্পে অপারেশন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন।
পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়মিত এই পেট্রোল পাম্পে আসত। এর কারণ ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ি পাহারা দেয়া এবং তাদের যানবাহনে পেট্রোল নেয়া। কিন্তু এলাকার মানুষজন সব সময় ভীতির মধ্যে থাকত। তাই ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার সহযােগীদের শায়েস্তা করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গ্রুপ তৎপর ছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে পেট্রোল পাম্প এলাকায় রেকি করেন। বেশ কয়েকবার তারা পেট্রোল নেয়ার ভান করে অপারেশনের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। একবার আগুন দিয়ে পেট্রোল পাম্পটি জ্বালিয়ে দিতে মনস্থির করেন। কিন্তু এলাকার বাসিন্দা, ঘরবাড়ি এবং মসজিদ ও মাজারের কথা বিবেচনা করে তা থেকে তারা বিরত হন।
১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস হওয়ায় ঐদিন অন্যান্য দিনের মতাে পাকিস্তানি সেনাদের পাহারা তেমন জোরালাে ছিল না। শুধু গুডস্ হিলের মূল প্রবেশদ্বারে একটি গাড়ি ছিল। সবাই, বিশেষকরে পাকিস্তানি দালাল আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হিলের ওপর আনন্দে ব্যস্ত ছিল। মােস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা এ-দিনটিকে অপারেশনের জন্য বেছে নেন। পাম্পের ভেতরে ছিল কয়েকজন পাম্পকৰ্মী। দু-একটি গাড়ি মাঝে-মধ্যে এসে পেট্রোল নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যায় রাস্তার পাশের লাইটগুলাে জ্বলে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধারা বিদ্যুৎ বিভাগের দুজন লাইন্সম্যানকে আগেই হাত করে নিয়েছিলেন। তাদের সাহায্যে তারা বিদ্যুতের মেইন লাইনের তার কেটে দেন। হঠাৎ রাস্তার এবং পেট্রোল পাম্পের লাইটগুলাে নিভে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে পরপর তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। পেট্রোল পাম্পের ভেতরটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। পাকসেনারা এদিক-ওদিক গুলিবর্ষণ করে। তাদের চোখের সামনে তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ হলাে অথচ তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। মােড়ে পাহারারত কালাে পােশাকধারী মিলিশিয়ারা গুডস্ হিলে আশ্রয় নেয়। রাস্তাঘাটে লােকজনের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদ ও মাজারে অবস্থানরত মুসল্লিরা কবরস্থানসহ যে যেখানে পারে আশ্রয় নেয়। পুরাে রাত এলাকাটি ছিল বিদ্যুৎবিহীন। পাকিস্তানপন্থী নেতার বাড়ির পাশের পেট্রোল পাম্পে গ্রেনেড চার্জের ফলে তার কর্মী-সমর্থকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
মুক্তিযােদ্ধাদের এই অপারেশনের পর পাকসেনাদের ঐদিন রাতে তেমন কোনাে তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি, কারণ তারা ভীষণ ভীত হয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল, মাজার-সংলগ্ন পাহাড়ে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে। তাই পুরাে রাত অপেক্ষা করে সকালে তারা পেট্রোল পাম্প পর্যবেক্ষণে আসে। পাহাড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে মাজার ও মসজিদ থেকে কতিপয় ভাসমান ফকিরকে তুলে নিয়ে যায়। হানাদাররা মনে করেছিল এরাই মুক্তিযােদ্ধা, ছদ্মবেশ ধারণ করে এখানে অবস্থান নিয়েছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আর জানা যায়নি।
এ অপারেশনের ফলে গুডস্ হিলের অত্যাচার কিছুটা কমে আসে। অপরদিকে, পেট্রোল পাম্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এখানকার মিলিশিয়া গ্রুপটিকেও আর দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম কলেজ ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজেও তাদের সব ধরনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।
এ অপারেশনের বড় সফলতা ছিল, প্রতিরাতে এলাকায় আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা পাকসেনাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের বাড়িতে গিয়ে যে হানা দিত, তাদের সে অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে, মুক্তিযােদ্ধারা সর্বত্রই আছে। [সাখাওয়াত হােসেন মজনু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!