বীর উত্তম এম আফতাবুল কাদের
এম আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম (১৯৪৭-১৯৭১) বীর মুক্তিযােদ্ধা। ১৯৪৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামে তার জন্ম। তাঁর পিতার নাম আবদুল কাদের এবং মাতার নাম রওশন আরা বেগম। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান। মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যােগদান করেন এবং ১৯৬৮ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দারাবাদে ফিল্ড রেজিমেন্টে। মার্চ মাসের উত্তাল আন্দোলনের সময় তিনি ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন। ২০শে মার্চ চট্টগ্রামে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম জুই।
২৫শে মার্চের কালরাতে আফতাবুল কাদের তার ঢাকাস্থ ফরিদাবাদ বাসা থেকে পাকবাহিনীদের নারকীয় হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। তিনি নতুন বিবাহিত জীবনের বন্ধন উপেক্ষা করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে মনস্থির করেন এবং ২৮শে মার্চ চট্টগ্রাম হয়ে রামগড়ে পৌছান। সেখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম এর নির্দেশে তিনি মহালছড়িতে প্রতিরােধ যুদ্ধে যােগ দেন। ১৪ই এপ্রিল তিনি জানতে পারেন যে, পাকবাহিনীর উপর্যুপরি স্থল, নৌ ও বিমান হামলার মুখে টিকতে না পেরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর যােদ্ধারা রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করছেন। আফতাবুল কাদের তার অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে রাঙ্গামাটিখাগড়াছড়ি এলাকায় অবস্থান নেন। ২৪শে এপ্রিল তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেন।
২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী ও প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী মিজো বাহিনী সম্মিলিতভাবে মহালছড়িতে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লে. মাহফুজের সম্মিলিত বাহিনীকে আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিদ্রোহী মিজোরা পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে। সংবাদ পেয়েই ক্যাপ্টেন আফতাবুল তার বাহিনী নিয়ে প্রতিরােধযােদ্ধাদের সহযােগিতায় এগিয়ে যান। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী ও মিজো বিদ্রোহীরা মুক্তিযােদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযােদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুদের মােকাবেলা করতে থাকেন। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর তাঁদের গােলাবারুদ শেষ হয়ে আসে। এমতাবস্থায় আরাে বিপর্যয় ঠেকাতে কৌশলগত কারণে তারা শত্রুষ্টেনী থেকে কভারিং ফায়ারের সাহায্যে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ কভারিং ফায়ার দেয়া মেশিনগানটি অকেজো হয়ে পড়লে মুক্তিযােদ্ধারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের জীবন বাজি রেখে গােলাগুলির মধ্যেই দৌড়ে এলএমজি নিয়ে উঁচু স্থানে অবস্থান নিয়ে কভারিং ফায়ার দিতে থাকেন। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকাংশই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হন। তবে চরম মূল্য দিতে হয় ক্যাপ্টেন আফতাবুলকে। কভারিং ফায়ার চলাকালে শত্রুর ছােড়া গুলি এসে তার বুকে লাগে। মুমুর্ষ অবস্থায় তিনি কভারিং ফায়ার করতে থাকেন। এ অবস্থায় শওকত ও ফারুক নামে দুজন স্বেচ্ছাসেবক বহু কষ্টে তাঁকে নিচু স্থানে নামিয়ে এনে একটি জিপে তুলে ফিল্ড হাসপাতালের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে রামগড় শহরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য প্রায় ৫০০ প্রতিরােধযােদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রাণে বেঁচে যান। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর এই অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৯, খেতাবের সনদ নং ২২)। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শহীদ আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম ট্রাস্ট ফান্ড স্থাপন করা হয়। [সােজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড