বীর উত্তম এ জে এম আমিনুল হক
এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম (১৯৪৪-২০১১) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা, ব্রিগেডিয়ার ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার। তিনি ১৯৪৪ সালের ২৩শে মার্চ বর্তমান গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা নুরুল হক ও মাতার নাম ফাতেমা হক।
আমিনুল হক কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যােগ দিয়ে সেখান থেকে কোর্স সম্পন্ন করে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাকিস্তানে অবস্থানকালে তিনি বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ করেন। ৭০-এর নির্বাচন ও আওয়ামী লীগএর বিপুল বিজয় অন্যান্য বাঙালিদের মতাে নিজেদের ন্যায্য অধিকার অর্জনে তাঁকেও বিপুলভাবে আশান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল তাঁর নিকট স্বাধীনতার অমর বাণী। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকহানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরােচিত গণহত্যা তাঁকে বিদ্রোহী করে তােলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলে নিয়ােজিত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ২৭শে মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়ে চট্টগ্রামে অষ্টম বেঙ্গলের ওপর পাকিস্তানিদের হামলায় যে বিপর্যয় ঘটে, তা পরবর্তীতে এ বাহিনীর পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। ধীরে-ধীরে ৮ম বেঙ্গল মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। ২৫শে জুন নাগাদ ‘জেড’ ফোর্সের অধীন ৮ম বেঙ্গলের সেনারা ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হকের নেতৃত্বে তাদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যস্থল নকশী গজনী এলাকায় আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে পাকসেনারা যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়, তবে স্থানটি দখলে আনতে মুক্তিযােদ্ধারা ব্যর্থ হন। এখানকার যুদ্ধে আমিন আহমেদ চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হন। অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় শত্রুসেনাদের অবিশ্রান্ত গােলাবর্ষণের মুখে যুদ্ধাহত আমিন আহমেদ চৌধুরীকে তুলে নিয়ে আমিনুল হক দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমিনুল হক সহযােদ্ধাকে এভাবে রক্ষা করেন।
ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক ময়মনসিংহের নকশী, জামালপুরের কামালপুর, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন। ৩রা আগস্ট ক্যাপ্টেন (তখনকার তার র্যাংক) আমিনুল হক ৩য় ও ৮ম বেঙ্গলের সেনাদের নিয়ে নকশী বিওপি আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পাল্টা জবাব দেয়। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। আমিনুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর কামানের গােলা, পেতে রাখা মাইন আর তাদের গুলিতে সহযােদ্ধাদের শহীদ হবার দৃশ্য উপেক্ষা করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় মনােবল আর সাহস দেখে পিছু হটতে থাকে পাকবাহিনী। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমিনুল হক বুলেটবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায়ও তিনি সহযােদ্ধাদের নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। তাঁর এ অসীম সাহসিকতা সহযােদ্ধাদের উজ্জীবিত করে। এক পর্যায়ে তিনি একহাত দিয়ে অস্ত্র ধরে গুলি চালাতে-চালাতে শত্রুশিবিরের সীমানার ভেতরে ঢুকে যান। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। তিনি নিজেই অনেক পাকসেনাকে হত্যা করেন, বন্দি করেন বেশ কয়েকজনকে। এখানকার যুদ্ধে অনেক মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন, আহত হন আরাে বেশি সংখ্যক। তবে যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ী হন। ব্রিগেডিয়ার এ জে এম আমিনুল হকের নেতৃত্ব ও যুদ্ধকৌশল বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে নবাগত ক্যাডেটদের নির্ধারিত পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য এ জে এম আমিনুল হককে বাংলাদেশ সরকার বীর উত্তম খেতাবে ভুষিত করে। তিনি ১ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জন। তার স্ত্রীর নাম মেরি হক। ২০১১ সালের ১৬ই জানুয়ারি এ বীর মুক্তিযােদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড