You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর উত্তম এ টি এম হায়দার

এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম (১৯৪২-১৯৭৫) বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২নং সেক্টরের কমান্ডার। তাঁর পূর্ণনাম আবু তাহের মােহাম্মদ হায়দার, তবে তিনি এ টি এম হায়দার নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালের ১২ই জানুয়ারি তাঁর পিতার কর্মস্থল কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান কিশােরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মােহাম্মদ ইসরাইল এবং মাতার নাম হাকিমুন্নেসা বেগম। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে তার পিতার বদলির চাকরির জন্য তাঁকে বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া করতে হয়েছে। তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় পাবনার বীণাপাণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর ১৯৫৮ সালে তিনি কিশােরগঞ্জ রমাকান্ত হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) ও ১৯৬১ সালে কিশােরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) এবং ১৯৬৩ সালে লাহাের ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে এমএসসি শ্রেণিতে ভর্তি হন।
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন অবস্থায় এ টি এম হায়দার সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যােগ দেন। কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ট্রেনিং সমাপ্ত করে তিনি ১৯৬৫ সালে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে গােলন্দাজ ইউনিটে যােগদান করেন। এরপর তিনি চেরাট থেকে কমান্ডাে ও সােশাল সার্ভিস গ্রুপ (SSG) প্যারাট্রুপার কোর্স সম্পন্ন করে মুলতান সেনানিবাসে যােগ দেন এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নে ক্যাপ্টেন হিসেবে পােস্টিং পান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ক্যাপ্টেন হায়দারকে কয়েকদিনের জন্য। ঢাকায় বদলি করে পুনরায় কুমিল্লায় পাঠানাে হয়।
২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের ওপর ব্যাপক গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতন শুরু করলে সঙ্গে-সঙ্গে সারা দেশের মতাে কুমিল্লা সেনানিবাসেও তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ক্যাপ্টেন হায়দার পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নিতে মনস্থির করেন। ২৭শে মার্চ তিনি কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় গিয়ে মিলিত হন। সেখান থেকে তিনি হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়ায় পৌছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে মিলিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ টি এম হায়দার ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে এ সেক্টরে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে গেরিলা ও প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনা, দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনাসহ সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। এপ্রিল ও মে মাসে তিনি ময়মনসিংহ, কিশােরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলাে সফল অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও আগরতলার মেলাঘরে অবস্থিত ২নং সেক্টরের সদর দপ্তরে ক্যাপ্টেন হায়দার মুক্তিযােদ্ধাদের কমান্ডাে, বিস্ফোরক ও গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করাসহ মুক্তিযােদ্ধাদের শপথ বাক্য পাঠ করানাের দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীতে ব্রিগেড আকারে ৭ই অক্টোবর কেফোর্স গঠিত হবার পর খালেদ মােশাররফ ফোর্সের দায়িত্ব নেন এবং তখন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত ক্যাপ্টেন হায়দার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ২নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
ক্যাপ্টেন হায়দার এবং মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য ক্র্যাক প্লাটুন গঠন করা হয়। হায়দার এ ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশনের পরিকল্পনা, নির্দেশনা, ট্রেনিং দেয়া এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুন জুন মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরে ৮২টি সফল অপারেশন পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার সঙ্গে এ কে খন্দকার, কে এম সফিউল্লাহ এবং ক্যাপ্টেন হায়দার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন হায়দারের ছােট বােন ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম ও ছােট ভাই এ টি এম সফদার জিতুও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বােন ক্যাপ্টেন সেতারা মেলাঘরে অবস্থিত ২নং সেক্টরের অধীন বিশ্রামগঞ্জে অবস্থিত বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। হাসপাতাল পরিচালনাসহ মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ১৯৭২ সালে মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে যােগদান করেন এবং সেখানে ১৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে এ বীর মুক্তিযােদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের সঙ্গে প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার ছিলেন অবিবাহিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও নির্দেশনায় অসামান্য অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ বীর মুক্তিযােদ্ধাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!