মুক্তিযুদ্ধে উল্লাপাড়া উপজেলা
উল্লাপাড়া উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) সিরাজগঞ্জের বৃহত্তম উপজেলা। এখানকার মানুষ ঐতিহাসিকভাবে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চেতনাসম্পন্ন। ১৯২২ সালে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে এখানকার সলঙ্গা হাটে বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলন ভয়াবহ রূপ লাভ করে। এদিন ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে কয়েকশ নারী-পুরুষ হতাহত হয়; কারাবন্দি হয় অনেক কৃষক, দিনমজুর ও ছাত্র। পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এখানকার মানুষ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। আন্দোলন-সংগ্রামের এ ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতায় ১৯৭১এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন-এর আহ্বানে উল্লাপাড়ার মানুষ সাড়া দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে এগিয়ে আসে।
৭ই মার্চের পর আওয়ামী লীগ নেতা ও এডভােকেট গােলাম হাসনায়েন এমপিএ-এর নেতৃত্বে উল্লাপাড়া থানা সদর ও ১৩টি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ১২ই মার্চ উল্লাপাড়ার কৃষকগঞ্জ বাজারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলফিকার মতিন ও সলপ ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক বদরুল ইসলাম বাবলু যৌথভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাটি তৈরি করেন কৃষকগঞ্জ বাজারের দর্জি সাদ ইমান মুন্সি। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় সংঘটিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর ২৬শে মার্চ উল্লাপাড়ায় পৌঁছে। ছাত্র-যুবকসহ সর্বস্তরের মানুষ এ হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে আকবর আলী কলেজ মাঠে এডভােকেট গােলাম হাসনায়েনের সভাপতিত্বে প্রথমে বিক্ষোভ সমাবেশ করে এবং পরে এখান থেকে মিছিল বের হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন খােরশেদ আলম, ডা. মফিজ উদ্দিন, আব্দুস সামাদ, ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জা, আব্দুল আজিজ মির্জা, জয়দেব সাহা প্রমুখ। এ সমাবেশ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত ঘােষিত হয়। থানা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন আব্দুল লতিফ মির্জা, গিয়াস উদ্দিন, আলমগীর, আব্দুস সাত্তার, জয়দেব সাহা প্রমুখ। উপযুক্ত নেতৃবৃন্দ ছাড়া স্থানীয়ভাবে যারা নানাভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে শিবেন্দ্রনাথ ভৌমিক, এম বেলাল হােসেন, শাহজাহান আলী, আবু তাহের, আশরাফ আলী (কালিয়াকৈড়) প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। উল্লাপাড়ার আরাে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, তাঁরা হলেনমাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএনএ, কামাল লােহানী (সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব; ৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বার্তা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন; রণাঙ্গণের সংবাদ সংগ্রহ, গ্রন্থনা ও আকর্ষণীয় সংবাদ পাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত), এইচ টি ইমাম (৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি; মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের পূর্বাঞ্চলে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন; মুজিবনগরে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিযুক্ত হন; স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা), দীপ্তি লােহানী (কামাল লােহানীর সহধর্মিণী; মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ঢাকার মতিঝিল কলােনিতে গেরিলা যােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের আয়ােজন, অস্ত্র সংরক্ষণ ও গেরিলাদের গােপনে প্রতিপালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন; গােপনে কলকাতা গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথিকা লেখক ও পাঠকের দায়িত্ব পালন করেন; তার অসাধারণ সাহসী কথিকাগুলাে রণাঙ্গণের মুক্তিযােদ্ধাদের উজ্জীবিত করত) প্রমুখ।
৩০শে মার্চ সলপ উচ্চ বিদ্যালয় অঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খােলা হয়। উল্লাপাড়া পার্কেও একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন উল্লাপাড়ার বাখুঁয়া গ্রামের সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ। সলপ স্কুল ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন ল্যান্স নায়েক গিয়াস উদ্দিন, সেনাসদস্য দেওয়ান আজিজুর রহমান ও দেওয়ান আব্দুর রহমান। এ দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৪ শতাধিক ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ চলে। সলপ স্কুল কেন্দ্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটি আশ্রয় শিবির খােলা হয়। পরে উল্লাপাড়ার অনেক মুক্তিযােদ্ধা ভারতের পানিঘাটা, শিলিগুড়ি, তুরা পাহাড়, দেরাদুন, আগরতলা ইত্যাদি জায়গায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
উল্লাপাড়ায় যারা কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, তাঁরা হলেন- সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এ কে এম শামসুদ্দিন আহমেদ (যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন), ছাত্রনেতা ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এর পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা, সেনাসদস্য ও মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষক আব্দুস সামাদ, পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সেকশন কমান্ডার আব্দুল আজিজ মির্জা, খােরশেদ আলম, ইপিআর সদস্য খলিলুর রহমান, আব্দুল লতিফ, চৌধুরী ইফতেখার মবিন পান্না, এডভােকেট সামছুল আলম প্রমুখ। জুন মাসে সিরাজগঞ্জের ভদ্রঘাটে উল্লাপাড়ার বৃহত্তম মুক্তিযােদ্ধা সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ শিবিরের পরিচালক ছিলেন আব্দুল লতিফ মির্জা। এখানে প্রায় ছয়শ মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ সংগঠন পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে কখনাে গেরিলা পদ্ধতিতে কখনাে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়।
পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করতে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সিরাজগঞ্জ মহকুমা শহর ও বগুড়ার সঙ্গে উল্লাপাড়ার সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ১৯শে এপ্রিল মহকুমা প্রশাসক এ কে এম শামসুদ্দিন আহমেদ ও উল্লাপাড়া স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা আব্দুল লতিফ মির্জার যৌথ নেতৃত্বে পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ডাববাগানে মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করেন। পাকসেনারা নগরবাড়ি ও পাবনা থেকে সড়ক পথে উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর প্রবেশের সময় ডাববাগানে এ প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের দলে তখন বেড়া, পাবনা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় দুশ মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। ডাববাগান যুদ্ধ-এ বেশ কিছু বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্য অংশ নেন। যুদ্ধে উভয় পক্ষে প্রাণহানিসহ প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকহানাদার বাহিনীর ৫০ জন সৈন্য নিহত হয় মর্মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সংবাদ প্রচারিত হয়। হানাদার বাহিনীর হাতে বহুসংখ্যক বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এক পর্যায়ে তাদের ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে প্রতিরােধ যােদ্ধারা পশ্চাদপসারণ করেন।
২৪শে এপ্রিল ঈশ্বরদী থেকে আসা পাকসেনাদের প্রতিরােধ করতে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল উল্লাপাড়ার ঘাটিনা ঘাটে আসে। তারা এখানে করতােয়া নদীর ওপর রেলসেতুর কয়েকটি পাত খুলে নদীতে ফেলে দেন। এরপর নদীর পূর্বপাশে শাহজাহানপুর গ্রামের কাছে নদীর পাড়ে একাধিক বাংকার খুঁড়ে সশস্ত্র অবস্থায় ওঁৎ পেতে থাকেন। বেলা আড়াইটার দিকে পাকবাহিনী ঘাটিনা রেলসেতুর অবস্থা দেখার জন্য ট্রেন থেকে নামলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। এ কে এম শামসুদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে এ আক্রমণ শুরু হয়। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে এখানে যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে অন্তত ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে শাহজাহানপুর গ্রামের শিশু-নারীসহ ৩০ জন আহত হন। এযুদ্ধ ঘাটিনা রেলসেতু যুদ্ধ” নামে পরিচিত। পরদিন সকালে পাকসেনারা উল্লাপাড়া থেকে ৬ কিলােমিটার দূরে গাড়াদহে মর্টার বসিয়ে আবার মুক্তিযােদ্ধাদের বাংকারের ওপর শেলিং করে। ব্যাপক শেলিংয়ে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
২৫শে এপ্রিল দুপুরে পাকসেনারা রেলসেতুতে নতুন রেললাইন বসিয়ে ট্রেনে সিরাজগঞ্জ যায়। যাওয়ার সময় ২২ কিলােমিটার পথের দুপাশের গ্রামগুলাে পুড়িয়ে দেয়। ঘাটিনা রেলসেতুর এ-যুদ্ধ সিরাজগঞ্জের প্রথম প্রতিরােধ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। ২৫শে এপ্রিলের পর এ অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধারা সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলােমিটার পায়ে হেঁটে কুড়িগ্রামের রৌমারি ও ভারতের মানিকার চরে চলে যান।
২৫শে এপ্রিল উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেলসেতু যুদ্ধের পর এদিনই পাকসেনারা উল্লাপাড়া সদরে প্রবেশ করে। তারা উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন সরকারি খাদ্য গুদাম ও সিএন্ডবি কোয়ার্টার্সে ক্যাম্প স্থাপন করে। একই সময়ে তারা উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে ৩ কিলােমিটার দূরে থানা সদরের (বর্তমান পৌরসভা) হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পাট বন্দরে বিহারী আব্দুর রহমানের পাট-গুদামে পৃথক দুটি ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা হামিদা বালিকা বিদ্যালয়ে অস্ত্র ভাণ্ডার স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে হানাদাররা উপজেলায় গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, নারীনির্যাতন ও লুটপাটসহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করত।
মার্চ-এপ্রিলে যখন উল্লাপাড়ার ছাত্র-যুবক-শ্রমিকরা দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করতে থাকেন, তখনই স্বাধীনতা-বিরােধী পাকদোসরদের অশুভ তৎপরতা শুরু হয়। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা এখানে রাজাকার বাহিনী গড়ে তােলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা ছিল আহসান আলী। সে প্রথমে সলপ ইউনিয়নের স্বাধীনতা-বিরােধীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তােলে এবং পরে এ বাহিনী সমগ্র উল্লাপাড়ায় বিস্তৃত হয়। এছাড়া উল্লাপাড়ার সলঙ্গায় রাজাকার নেতা মমতাজ মিয়া ও রহমান মিয়া পাকবাহিনীর সহযােগিতায় এলাকায় হত্যা, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট করে। বাখুঁইয়া গ্রামের রাজাকার নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য তমজের মাস্টার হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। উল্লাপাড়া থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল দুর্গানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভােলা খাঁ। পাকহানাদার বাহিনীকে সহযােগিতাদানকারী অপর রাজাকার নেতাদের মধ্যে উল্লাপাড়ার হাবিবুর রহমান ওরফে বকু মিয়া, রামকান্তপুরের ইউপি সদস্য তছির উদ্দিন, মােকবেল হােসেন, লাহেরী মােহনপুরের এবাদত আলী, আবুল হােসেন, জাহাঙ্গীর হােসেন, বােয়ালিয়ার মােহাম্মদ দামু প্রমুখ উল্লেখযােগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকহানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযােগিতায় উল্লাপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। এ উপজেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যা হলাে চড়িয়া শিকার গণহত্যা ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী হাটিকুমরুল ইউনিয়নের চড়িয়া, পাটধারী ও গােলকপুর গ্রামে ঢুকে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষকে ধরে চড়িয়া শিকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ও বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর নিহত ব্যক্তিদের গণকবর দেয়। পাকবাহিনী এসব গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। মে মাসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বাথুয়া গ্রামের ৫ জনকে হত্যা করে। তারা উল্লাপাড়া মাতসদনের পাশে ৫ জন নারী-পুরুষকে এবং পাটবন্দরে করতােয়া খালের পাশে ৬-৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। পাটবন্দরে নিহতদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা জয়দেব সাহা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ধরইল গ্রামের ধীরেন সূত্রধর ও ভেংড়ী গ্রামের ফুটবল খেলােয়ার অরুণ সরকার প্রমুখ।
পাকবাহিনী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে লাহিড়ী মােহনপুরের ২৪ জনকে ধরে নিয়ে পাশের দহকুলা নদীর চরে গুলি করে হত্যা করে। এটি লাহিড়ী মােহনপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকসেনারা দালাল আব্দুর রহমানের সহযােগিতায় উল্লাপাড়ার কানসােনা ঘােষপাড়া গ্রামে ঢুকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। কানসােনা ঘােষপাড়া গণহত্যার পর পাকসেনা ও রাজাকাররা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে স্থানীয় রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরােধীদের। সহযােগিতায় পাকবাহিনী উল্লাপাড়ার সিংহগাঁতী গ্রামে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে, যা সিংহগাঁতী গণহত্যা নামে পরিচিত।
উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের পাশে সরকারি খাদ্য গুদাম ও সিএন্ডবি কোয়ার্টার্সে স্থাপিত পাকসেনাদের ক্যাম্পে ছাত্র-যুবকদের নির্যাতন করা হতাে। উল্লাপাড়া পাটবন্দরে আব্দুর রহমানের গুদাম পাকবাহিনীর বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতাে।
উল্লাপাড়ার সবচেয়ে বড় গণকবর হলাে চড়িয়া শিকার গণকবর চড়িয়া শিকার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এ গণকবর অবস্থিত। এখানে পাকসেনারা দেড় শতাধিক নারী-পুরুষকে হত্যার পর গণকবর দেয়। উপজেলার বধ্যভূমিগুলাে হলাে- দহকুলা রেলসেতু বধ্যভূমি, দুর্গানগর ইউনিয়নের সিংহগাঁতী গ্রামের পাশের বটতলা, লাহিড়ী মােহনপুর ইউনিয়নের দহকুলা নদীর চর, পাটবন্দরের পাশে করতােয়া নদীর মজা খাল এবং পাটধারী অন্ধ পুকুর। উল্লাপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধের মধ্যে ঘাটিনা রেলসেতু যুদ্ধ “উল্লাপাড়া-নওগাঁ যুদ্ধ” বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়া মার্চেন্টস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, শ্যামপুর রেলসেতু, সেনগাঁতী চারা বটতলা, চড়িয়া সড়ক সেতু, চৌকিদহ, দহকোলা রেলসেতু, সােলাগাড়ি সড়ক সেতু, মােহনপুর, সলঙ্গা বাজার, দিলপাশার রেলসেতু ও মানুষমােরা গ্রাম ইত্যাদি স্থানেও পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।
উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় নওগাঁয়। নওগাঁ পাবনা জেলার চাটমােহর থানার অন্তর্ভুক্ত হলেও যুদ্ধস্থলের এক বিরাট অংশ ছিল উল্লাপাড়া ও তাড়াশ এলাকার মধ্যে। ফলে এ-যুদ্ধ উল্লাপাড়া-নওগাঁ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১১ই নভেম্বর সংঘটিত এ-যুদ্ধে আব্দুল লতিফ মির্জা নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ১টি ব্রিটিশ এলএমজি, ৩০৩ রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল ও শতাধিক এসএলআর ব্যবহার করেন। প্রায় ৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পিছু হটে। এ-যুদ্ধে শতাধিক রাজাকার ও পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ৭ জন পাকসেনা ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে সেলিম আহমেদ নামে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনও ছিল। ধৃত পাকসেনাদের কাছ থেকে ১টি এইচএমজি, ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ১২টি চাইনিজ গান, ৩০টি ৩০৩ রাইফেল ও সাবমেশিন কার্বাইন (এসএমসি)-সহ বিভিন্ন ধরনের ৬০টি অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ-যুদ্ধে ৫ শতাধিক রাজাকার ও পাকসেনা অংশ নেয়।
নভেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর প্রবল চাপের মুখে উল্লাপাড়ার হামিদা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়, রেল স্টেশন ও রহমানের পাটের গুদামে স্থাপিত পাকহানাদার ক্যাম্পের সেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের যােদ্ধারা চারদিক থেকে পাকসেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। এ অবস্থায় পাকসেনারা ১২ই ডিসেম্বর রাতে হামিদা স্কুল ক্যাম্পের অস্ত্র ভাণ্ডারে আগুন ধরিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। বগুড়ানগরবাড়ি মহাসড়কের গাড়াদহের কাছে পলায়নরত একদল পাকসেনার ওপর মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেন। এতে দুজন পাকসেনা নিহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর উল্লাপাড়া সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। উল্লাপাড়ার অস্থায়ী প্রশাসনের সামরিক পরিচালক মুক্তিযােদ্ধা গাজী খােরশেদ আলম থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
উল্লাপাড়ার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- নেফাজ আলী (পিতা নওশের আলী মন্ডল, বড় কোয়ালিবেড়; ছাত্র), হােসেন আলী (পিতা পরান প্রামানিক, বড় কোয়ালিবেড়; ছাত্র), হায়দার আলী (পিতা আব্দুর রহমান মন্ডল, বড় কোয়ালিবেড়; ছাত্র), জয়দেব সাহা (পিতা সতীশ চন্দ্র সাহা, উল্লাপাড়া; ছাত্র), বিনয় ভূষণ সিংহ (পিতা বনওয়ারী লাল সিংহ, বড় মনােহারা; ব্যবসায়ী), এমদাদুল হক (পিতা রহিম প্রামানিক, পাইকপাড়া; ছাত্র), ল্যান্স নায়েক গিয়াস উদ্দিন আকন্দ (পিতা হাবিব উদ্দিন মােল্লা, উল্লাপাড়া), হাবিলদার মেছের মিয়া (পিতা কাঙ্গাল আলী, নওকৈড়), জামাল উদ্দিন (পিতা গহের আলী আকন্দ, ভেংড়ী; ছাত্র), বীরেন্দ্রনাথ সূত্রধর (পিতা ধীরেন্দ্রনাথ সূত্রধর, শ্যামাইলদহ; কাঠমিস্ত্রী), কে এম হাসিম (পিতা কে এম এ নুরুল হুদা, নবগ্রাম), তােজাম্মেল হক (পিতা মাে. আবুল হােসেন, গুয়াগাতী), নুরুল ইসলাম (পিতা আব্দুল মােতালেব মিয়া, ভট্টকাওয়াক) ও অনীল কুমার ঘােষ (পিতা শিবনাথ ঘােষ, উল্লাপাড়া; ব্যবসায়ী)। উল্লাপাড়ার যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- সাখাওয়াত হােসেন (চকচৌবিলা), শামছুল ইসলাম (সােনতলা), আশরাফ হােসেন মিয়া (উল্লাপাড়া), সামুজ্জামান (কয়ড়া) ও এ টি এম মােয়াজ্জেম হােসেন (পঞ্চক্রোশী)।
বীর মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদ করতােয়া নদীর পূর্বপাড়ে শাহজাহানপুর গ্রামের পাশে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ উল্লাপাড়া কমান্ড উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি নামফলক তৈরি করেছে। এ ফলকে এখানকার ৪২০ জন মুক্তিযােদ্ধার নাম রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল গােলচত্বরে একটি নান্দনিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৭ কিলােমিটার দূরে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের পাশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কার্যালয় চত্বরের আমবাগানে দুর্জয় বাংলানামে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। উল্লাপাড়া পৌর শহরে থানা থেকে শ্যামলীপাড়া পর্যন্ত রাস্তাটির নাম শহীদ মুক্তিযােদ্ধা জয়দেব সাহা সড়ক রাখা হয়েছে। উপজেলার তাতসমৃদ্ধ বালসাবাড়িতে শহীদ বিনয় ভূষণ সিংহের নামে একটি রাস্তা রয়েছে। উল্লাপাড়ার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নামে উপজেলার পাটধারী গ্রামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সলঙ্গায় একটি কলেজ স্থাপিত হয়েছে। [কল্যাণ ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড