You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে উলিপুর উপজেলা

উলিপুর উপজেলা (কুড়িগ্রাম) ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নগুলাে হলাে- ধামশ্রেণী, তবকপুর, বজরা, গুনাইগাছ, থেতরাই, দলদলিয়া, পান্ডুল, দুর্গাপুর, বুড়াবুড়ী, হাতিয়া, ধরনীবাড়ী, সাহেবের আলগা ও বেগমগঞ্জ। এর উত্তরে কুড়িগ্রাম সদর ও রাজারহাট, পশ্চিমে তিস্তা নদী, দক্ষিণে চিলমারী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে উলিপুর থানার ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও সংগ্রামী জনগণের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। অতীতে ৬ দফা, ১১ দফা ও সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলনে তারা অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তারা ছিল সােচ্চার। ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে এখানে ছাত্রসমাজ জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা ১৮ই ফেব্রুয়ারি পাকবাহিনীর হাতে নিহত হবার খবর বেতার ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানার পর তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গুনাইগাছ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ২০শে ফেব্রুয়ারি শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করে রেলগাড়ি অবরােধ করে। স্টেশন প্লাটফরমে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা হয়। ছাত্রলীগ নেতা মােয়াজ্জেম হােসেন মুকুট, মনসুর আলী, আব্দুল কাদের, মােস্তাফিজার রহমান (লিচু), আজাহার আলী ও মনােরঞ্জন রায় বক্তব্য রাখেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর বিজয় সত্ত্বেও ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহবানে অসহযােগ আন্দোলন-এ সারাদেশের মতাে উলিপুরের মানুষও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং গণপ্রতিরােধ গড়ে তােলে। ১৩ই মার্চ উলিপুর থানা সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) আবু শহীদ চৌধুরীর সহযােগিতায় থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মাে. সাদাকাত হােসেন (ছক্কু মিয়া) এমএনএ, আব্দুল্লাহ সরােয়ার্দী এমপিএ এবং কানাই লাল সরকারকে উপদেষ্টা, থানা আওয়ামী লীগের আব্দুল হাফিজ মিয়া ওরফে বাচ্চা মিয়াকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম মিয়াকে সম্পাদক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যবৃন্দ হলেন- আমজাদ হােসেন তালুকদার, শামসুল হক গাটু, সৈয়দ হামিদুর রহমান, সুধাংশু মােহন সরকার, ডা. কালিপদ বর্মণ (কমিউনিস্ট পার্টি), আবুল কাশেম মিঞা (ন্যাপ) মােজাফফর), অজিত কুমার সরকার, আব্দুল আউয়াল মিঞা, সােহন লাল সিংহী, সাইদুল হক (বাচ্চু), শ্যামল মজুমদার ও মােয়াজ্জেম হােসেন মুকুটসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। ২৩শে মার্চ সকাল ১১টায় পুরাতন শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রলীগ সভাপতি মােয়াজ্জেম হােসেন মুকুট। এ সময় আজিজ মুনশী, মােফা, সুনীল দেব, তােজাম্মেল হক, লিয়াকত আলী, স্বপন কুমার সরকার ভগত, বাবর আলী, আবু বক্কর সিদ্দিক ও মনােরঞ্জন রায়সহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আরাে অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে এ কমিটি উলিপুর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, ব্রিজ ও নদীবন্দরে পাহারার ব্যবস্থা করে। ঢাকা থেকে খায়রুল আলম (নজরুল ইসলাম) নামে একজন ছাত্রনেতা (ছাত্র ইউনিয়ন) উলিপুর এসে ছােট-ছােট বােমা তৈরি করেন। তিনি স্থানীয় যুবকদের একটি দল নিয়ে ট্রেনিং-এর জন্য ভারতে যান। ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় তাঁর নেতৃত্বে একটি কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং উলিপুর-চিলমারীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে তাঁরা অপারেশন পরিচালনা করেন। এ সময় রংপুরের ছাত্রলীগ নেতা সরকার ইসহাক আলীকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আব্দুস সালামকে যুগ্ম-আহবায়ক করে দলদলিয়া, নাজিমখান ও রাজারহাট এলাকা সমন্বয়ে আঞ্চলিক মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যবৃন্দ হলেন ডা. বিনয় বােস, জ্যোতিরিন্দ্র নাথ, বাচ্চু এবং আরাে অনেকে। এ কমিটির সদস্যরা স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে যােগদানের জন্য উৎসাহ প্রদান এবং আহত লােকদের চিকিৎসার জন্য স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা করেন। সাহেবের আলগা ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন মুক্তাঞ্চল হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার বিপদগ্রস্থ ও নির্যাতিত মানুষজন এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। একাত্তরে নর্থ জোনে সিভিল প্রশাসন চালু হলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হরি গােপাল সরকার ৫২০ টাকা বেতনে পলিটিক্যাল মােটিভেটর হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন। অধ্যাপক হরি গােপাল সরকার, লালমনিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ সামসুল হক ও কুড়িগ্রাম কলেজের অধ্যাপক মাহবুব হােসেন যুবশিবিরগুলােতে আগত তরুণদের সামরিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা দিতেন।
উলিপুর ও চিলমারী এলাকায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগ নেতা সরকার ইসাহক আলী এবং ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আলিফ উদ্দিন। এঁদের সঙ্গে ছিলেন দছিজল হক, আবু তৈয়ব সরদার, স্বপন কুমার সরকার (ভগত), তােফাজ্জল হক, শুকুর আলী প্রমুখ।
২৪শে এপ্রিল একজন মেজরের নেতৃত্বে পাকবাহিনী উলিপুরে অনুপ্রবেশ করে ডাকবাংলাে, রেলস্টেশন, সার্কেল অফিস সংলগ্ন এলাকা ও উলিপুর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে ডা. এ এম মালেকের নেতৃত্বে গঠিত তাবেদার মন্ত্রিসভার সদস্য ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা আবুল কাশেম মিয়া মে মাসের মাঝামাঝি নিজ বাড়িতে এসে স্থানীয় মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুল মাঠে জনসভা করে মুক্তিযােদ্ধাদের ধ্বংস করার জন্য জনগণকে রাজাকার বাহিনীতে যােগদানের অনুরােধ করে। তার আহ্বানে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতারা শান্তি কমিটি গঠন করে। আবুল কাশেম মিয়া এবং আবুল বাসার মিয়াকে উপদেষ্টা, মাওলানা আবদুন্নাছির (পিতা আবদুল করিম মুন্সী; সাতদরগাহ পীর)-কে সভাপতি, গােলাম মাহবুব চৌধুরী (গুনাইগাছ স্কুলের প্রধান শিক্ষক)কে সেক্রেটারি, বকিয়ত উল্লাহ সরকারকে সহ-সেক্রেটারি, আব্দুল হাকিম, অধ্যক্ষ আব্দুস সােবহান, আব্দুস ছাত্তার তালুকদার, আব্দুল খালেক, আব্দুস ছাত্তার চেয়ারম্যান, রােস্তম আলী, মওলানা আকবর আলী, আ. ছামাদ মওলানা, বাবর আলী, হায়বর আলী, কাজী মজিবর রহমান, আব্দুল জব্বার, আব্দুর রশিদ, গােলাম মােস্তফা, আব্দুল গফুর মিস্ত্রী, ডা. আব্বাছ আলী, আবেদ আলী, জমির উদ্দিন, কাশেম বেপারী, নবাব আলী, আব্দুস ছাত্তার (পাইলট), মনির উদ্দিন, সাহাবুদ্দিন প্রমুখকে সদস্য করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সুপারিশে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি শুরু হয়। উলিপুরের উল্লেখযােগ্য রাজাকাররা হলাে- হামিদ মওলানা ওরফে ডাগগিল, সাহাবুদ্দিন, গােলজার, নূরুল হক, বফার মুনশী, সাইদুর রহমান, ছামাদ মওলানা, ছামাদ মেম্বার, কাশেম, করিম, খড়কু, তছলিম, মকবুল প্রমুখ। রাজাকার বাহিনী বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। দালাল সাহাবুদ্দিন ছিল পাকবাহিনীর বিশ্বস্ত সহযােগী।
এদের সহযােগিতায় পাকবাহিনী অত্র এলাকায় লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। হামিদ মওলানা প্রতিদিন অন্তত একজন লােক হত্যা না করে কিছু খেত না। খড়কু মিয়া ছিল কুখ্যাত রাজাকার। এই দুই অত্যাচারী দুর্গাপুর ও গুনাইগাছ ইউনিয়নে লুটপাট, নির্যাতন, হত্যাসহ চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। গােলাম মাহবুব চৌধুরীর নেতৃত্বে উলিপুর শান্তি কমিটি সরকারি অফিসের মতাে নিয়মিত অফিস করত। কালী প্রসন্ন সেনগুপ্তর বাড়ি ছিল তাদের অফিস। আর হেমেন দত্তর বাড়ি ছিল রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প।
পাকবাহিনী স্থানীয় শান্তি কমিটির পরামর্শ এবং রাজাকার বাহিনীর সহযােগিতায় এলাকায় সন্ত্রাস ও জ্বালাও-পােড়াও নীতি গ্রহণ করে। তারা সরদার পাড়ার কবিরাজ আজিজার রহমান, মুনশী বছির উদ্দিন, আমজাদ হােসেন তালুকদার, মােয়াজ্জেম হােসেন মুকুট, খালেক মেম্বার (ধরনীবাড়ী), নূরুল ইসলাম (বলদিপাড়া) ও আলিফ উদ্দিন মাস্টারের (জোনাই ডাঙ্গাঁ) বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে। তারা স্টেশনপাড়ার সবগুলাে বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এলাকাটি ফাঁকা করে দেয়। ২৮শে মে তারা থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল হাফিজ মিয়া (বাচ্চা মিয়া) ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম মিয়ার বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে। আগুনে আব্দুর রহিম মিয়া, আব্দুস সামাদ মিয়া, আব্দুল জব্বার মিয়া ও মফিজুল হক মিয়ার ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে রাজাকাররা বাকরেরহাট এলাকায় মুক্তিযােদ্ধা সাহেব আলী এবং মুক্তিযােদ্ধা মফিজুল হকের বড় ভাই আবুল হােসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা ১৩ই নভেম্বর তবকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মাে. আব্দুল আউয়াল মিয়ার বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ এবং সরদার পাড়ায় ১২টি বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। একই দিন পাকবাহিনী হাতিয়া ইউনিয়নে ভবেশ ও দাগারকুটি গ্রামে নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করে। হাতিয়া গণহত্যায় ৬৯৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এদিনই তারা মণ্ডলের হাটে ২১ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তারা উলিপুর ও ধামশ্রেনীতে মন্দির লুটপাট করে। উলিপুরে নারীনির্যাতন ও গণহত্যার প্রধান কেন্দ্র ছিল ডাকবাংলাে। রেললাইনের পাশের ঐ ডাকবাংলােটিতে কেউ গিয়ে ফেরত আসতে পারেনি। রাজাকাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে হানাদার বাহিনীর মেজরকে উপহার দিত। ঘাতকরা কয়েকদিন তাদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করার পর হত্যা করত। ডাকবাংলাের পাশে গর্ত খুঁড়ে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। রেললাইনের পশ্চিমে পুকুর পাড়ে অনেক মাথার খুলি পাওয়া গেছে। এসব স্থানে মেয়েদের হাতের আঙ্গুল, শাড়ীর আঁচল, মাথার চুল ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
উলিপুরে মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি যুদ্ধ এবং অপারেশন পরিচালনা করেন। তার মধ্যে দালাল সাহাবুদ্দিনের বাড়ি অপারেশন, পাঁচপীর যুদ্ধ, রেলগাড়ি অপারেশন, উলিপুর থানা আক্রমণ উল্লেখযােগ্য। ৬ই আগস্ট সুবেদার আলতাফ হােসেনের নেতৃত্বে উলিপুর, চিলমারী ও গাইবান্ধায় আলিফ উদ্দিন, আখতারুজ্জামান, জয়নাল, বাদলসহ ১৯ জন মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত একটি অপারেশন টিম পাকবাহিনীর দালাল অত্যাচারী সাহাবুদ্দিনকে হত্যা করে। এসময় তারা উলিপুর বাজার এবং ধানহাটির কয়েকজন রাজাকারকে গ্রেফতার করেন।
১২ই সেপ্টেম্বর পাঁচপীর এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে কমান্ডার আমিনুল ইসলামের প্লাটুন দুর্গাপুর ইউনিয়নের চণ্ডিজান ব্রিজের কাছে রেলগাড়ি আক্রমণ করে। এলাকার পাকসেনা, পুলিশ ও রাজাকারদের জন্য বেতনের টাকা নিয়ে লালমনিরহাট থেকে পাকবাহিনীর একটি দল তাদের ব্যাংকারগুলাের কাছে ট্রেন থামিয়ে ঐ বেতনের টাকা বিতরণকালে মুক্তিযােদ্ধারা চণ্ডিজান ব্রিজে গ্রেনেড ছুড়ে মারলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই খণ্ডযুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা আখতারুল করিম (হারুন) আহত হন।
নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে উলিপুর বাজারের উত্তরে মাঠের পাড় এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা রেললাইন তুলতে গেলে পাকসেনা ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। ১৩ই নভেম্বর পাকবাহিনী হাতিয়া ইউনিয়নের ভবেশ ও দাগারকুটি গ্রামে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। এ সময় মণ্ডলের হাট দিয়ে অগ্রসরমাণ পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা নওয়াব আলী, আবুল কাশেম (কাচু), মােন্তাজ আলী, হীতেন্দ্র নাথ ও গােলজার হােসেন শহীদ হন এবং মুক্তিযােদ্ধা শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম আহত হন।
নভেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহে একদল মুক্তিযােদ্ধা পূর্বদিক থেকে পাকবাহিনীর ডাকবাংলাে ক্যাম্প আক্রমণ করেন। শত্রু বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির কারণে মুক্তিযােদ্ধারা সেদিন পিছু হটেন। প্রতিশােধ নেবার জন্য ঐদিন রাতে পাকবাহিনী জোনাই ডাঙ্গা গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং অধিকাংশ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে।
কমান্ডার আমিনুলের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল ১লা ডিসেম্বর রেললাইনে বিস্ফোরক বসিয়ে বােমার সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত রেললাইন উড়িয়ে দেয়। ২রা ডিসেম্বর লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম শহরে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়, রেলস্টেশন ও পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলাের ওপর মিত্রবাহিনী বিমান হামলা চালায়। ৩রা ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা চাদ কোম্পানির নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে রাত ১২টায় উলিপুর থানা আক্রমণ করেন। খবর পেয়ে পাকবাহিনী অপর ৩টি ক্যাম্প গুটিয়ে থানায় একত্রিত হয়। উভয় পক্ষে সারারাত গােলাগুলি হয়। এ সময় ট্রেনযােগে কুড়িগ্রাম থেকে পাকসেনাদের একটি দল এসে উলিপুর থানায় যােগ দেয়। শত্রুর শক্তিবৃদ্ধির কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সেদিন উলিপুর থানা দখল করা সম্ভব হয়নি। পরদিন পাকসেনারা বেপরােয়া হয়ে উলিপুর বাজারের সর্বত্র তল্লাশি চালায়। ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকসেনারা একটি শাটল ট্রেনে রংপুর পালিয়ে গেলে উলিপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উলিপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আবুল কাশেম (পিতা বড়াই মামুদ, বুড়াবুড়ী), আব্দুল বাতেন (পিতা আলী, ধরনীবাড়ী), আবুল কাশেম কাচু (পিতা মােবারক উল্লাহ, ধরনীবাড়ী), নওয়াব আলী (পিতা শামসুদ্দিন বকসী, দুর্গাপুর), নজরুল ইসলাম (পিতা মােহাম্মদ আলী, পান্ডুল), ফজলুল হক (পিতা আজির উদ্দিন, ধরনীবাড়ী), মাহফুজার রহমান (পিতা মােহাম্মদ আলী, বজরা), সাহেব আলী (পিতা ফরিদ উদ্দিন, উলিপুর), হায়বর আলী (পিতা বছর উদ্দিন, পান্ডুল), মােস্তফা আব্দুল লতিফ (পিতা ফজলে রহমান, পান্ডুল), শাহাদৎ আলী (পিতা ছাদেক মন্ডল, গুনাইগাছ), নূরুল ইসলাম (পিতা ছেফাত আলী, গুনাইগাছ), আব্দুল হামিদ, (পিতা নাছির উদ্দিন, দূর্গাপুর), মতিয়ার রহমান (পিতা আকবর আলী, দলদলিয়া), আবু বক্কর (পিতা কালা মামুদ, হাতিয়া), দেলােয়ার হােসেন (পিতা নাছির উদ্দিন, বজরা), আব্দুল ওয়াহাব (পিতা নাছির উদ্দিন, বজরা) ও মােজাম্মেল হক (পিতা জয়েন উদ্দিন, হাতিয়া)।
হাতিয়া ইউনিয়নের দাগারকুটি মৌজায় সংঘটিত সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে দাগারকুটি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। অনন্তপুর (পুরাতন) বাজারের উত্তর দিকের মােড়ে মুক্তিযােদ্ধা মিজানুর রহমানের কবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। উলিপুর ডাকবাংলাের পশ্চিমে পুকুর পাড়ে নির্মিত হয়েছে বধ্যভূমি ও গণকবর স্মৃতিস্তম্ভ। উপজেলা কমান্ড মুক্তিযােদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের সামনে শহীদদের স্মরণে একটি গেট নির্মাণ করা হয়েছে। এম এস স্কুল থেকে রেলগেট পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আবুল কাশেম সড়ক, পাগলি মায়ের মাজার থেকে পান্ডুল বাজার পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ নওয়াব আলী সড়ক, জয়নালের কাপড়ের দোকান থেকে রেলব্রিজ পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আব্দুল হামিদ সড়ক, কে সি সড়ক থেকে বীরু বাগচির পুকুর পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযােদ্ধা সড়ক, উলিপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় দক্ষিণ গেট থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ফজলুল হক সড়ক, গুনাইগাছ ব্রিজ থেকে খােকা চেয়ারম্যানের বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ শাহাদৎ হােসেন সড়ক, মুন্সীপাড়া মসজিদ থেকে বুদা বাবুর বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মাহফুজুর রহমান সড়ক, গরুহাটি থেকে বলদিপাড়া পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ নূরুল ইসলাম সড়ক, আবেদ আলী দর্জির দোকান থেকে রব সর্দারের রাইস মিল পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আবু বক্কর সড়ক, গবা পাণ্ডের মােড় থেকে রেলগেট পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মােজাম্মেল সড়ক, পূর্ব বাজার মসজিদ থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ ওহাব সড়ক, বজরা কলেজ থেকে ওয়াপদা বাঁধ পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ দেলােয়ার সড়ক, কৃষি ব্যাংক থেকে উপজেলা চত্বর পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মােস্তফা আব্দুল লতিফ সড়ক, পিআইও অফিস থেকে ডরমেটরি পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক, মাতৃমঙ্গল থেকে টিএনওর বাসভবন পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ সাহেব আলী সড়ক, বসা মিয়ার মােড় থেকে উপজেলা ভূমি অফিস পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ হায়বর আলী সড়ক, আবুল হােসেনের বাড়ি থেকে কাজিচক মসজিদ পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মতিয়ার রহমান সড়ক এবং সাকিম মিয়ার দোকান থেকে কোর্ট বিল্ডিং পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ মতিয়ার রহমান সড়ক করা হয়েছে। [মনােরঞ্জন রায়]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!