You dont have javascript enabled! Please enable it!

এ আর হাওলাদার জুট মিলস নির্যাতনকেন্দ্র, বধ্যভূমি ও গণকবর

এ আর হাওলাদার জুট মিলস নির্যাতনকেন্দ্র, বধ্যভূমি ও গণকবর (মাদারীপুর সদর) মাদারীপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়।
মাদারীপুর শহরের পশ্চিম দিকে ইটের পুল এলাকায় ছিল এ আর হাওলাদার জুট মিলস। ২৪শে এপ্রিল মাদারীপুর শহরে প্রবেশের পর পাকিস্তানি বাহিনী এ জুটমিলসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এটিকে তারা মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গড়ে তােলে।
হানাদার বাহিনী প্রতিদিন অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধরে এনে জুটমিলসের একটি ডি-টাইপ ভবনে বন্দি করে রেখে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। পরে জুটমিলসের পেছনে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে অবস্থিত জেটিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মিলের অভ্যন্তরেই মাটিচাপা দিত। এখানে গণহত্যা ও গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ আর হাওলাদার জুটমিলস ক্যাম্পে নির্যাতিত মানুষের অনেকে নির্যাতন কক্ষের দেয়ালে তাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচারের বর্ণনা এবং জীবনের শেষ দিনগুলাে কী মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন, তা লিখে গেছেন। তাদের একজন লিখেছেন, “তােমরা আমাকে মেরে ফেল, গুলি করে মেরে ফেল, কষ্ট দিও না আর, আমি আর সইতে পারছি না। আরেকজন লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’ বলেছি তাে বলেছিই। তােরা একজনকে মারবি আর আমরা হাজার হাজার জন তৈরি হব। আরেকজনের কথা এ-রকম , ‘আমাকে তােরা না হয় মেরে ফেললি, কিন্তু আমার আদরের পুত্র কন্যারা কি খেয়ে বাঁচবে? তােরা আমাকে মুক্তি দে, মৃত্যুর পূর্বে কাকেও কিছু বলে যেতে পারলাম না। শুধু এটুকু লিখে গেলাম। জয় বাংলা।
৩০শে মে পাকসেনারা আওয়ামী লীগ নেতা এওজ গ্রামের মােতালেব খাঁকে আটক করে। তার ছােট ভাইও মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মােতালেব খাঁ-র সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর এক মামাতাে ভাই এবং শ্যামল নামে এক মিস্ত্রিকেও আটক করে। রাত ১টার দিকে ৪০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা এসে তাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। তাদের পিঠমােড়া দিয়ে বেঁধে এ আর হাওলাদার জুটমিলস নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যায়। বর্তমানে র্যাবের অফিস যে দালানে, তার দোতলার পশ্চিম দিকের একটি রুমে এনে তাঁদের রাখে। এভাবে ধরে আনা প্রায় ৪০ জন লােকে রুম ভর্তি ছিল। সবাই রুমের ফ্লোরে গােল হয়ে শুয়েছিল। তাদের মধ্যে নয়াচরের আজিজ, সৈয়দ মােক্তার, তার ছেলে এরতেজাউর দুলু, কাবিন রেজিস্ট্রার রাজা মীর, ছাত্রনেতা বদিউজ্জামান বদুও ছিলেন। বদু নাজিমউদ্দিন কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২৬শে মার্চের পর তিনি কলেজে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়েছিলেন। পরে বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমান সূর্য আত্মসমর্পণ করলে আটকৃতদের অনেককে ছেড়ে দেয়। বদুর সঙ্গে সূর্যের দেখা হয়নি। আগেই পাকহানাদাররা বদুকে হত্যা করেছিল।
এখানে আটককৃতদের রুমের ভেতরে সারাক্ষণ হাত-পা বেঁধে রাখা হতাে। শুধু খাওয়ার সময় হাত একটু ঢিলে করে দিত। চালের জাউ রান্না করে কোনাে তরকারি ছাড়া ঘরের ফ্লোরে ঢেলে দিত। ফ্লোর থেকে সবাইকে তুলে খেতে হতাে। প্রতিদিন দুবেলা সবাইকে শারীরিক নির্যাতন করা হতাে। সকাল ৯ থেকে ১০টার দিকে একবার এবং রাত ৩টার দিকে একবার পালাক্রম নির্যাতন চলত। মােটা বেত দিয়ে বেধড়ক পেটানাে হতাে। বুট দিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছে সবাইকে পাড়াত। মুক্তিযােদ্ধা হাবিবুর রহমান সূর্যকে একসঙ্গে চার-পাঁচ জনে মিলে পাড়াত। বুটের লাথিতে পায়খানা-প্রস্রাব বের করে দিত। অনেকের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যেত। যাদের গুলি করে মারতে নিত, তাদের রাত ২টার সময় এসে বেয়নেট দিয়ে খোচা মেরে তুলে নিত। একটু পরে গুলির আওয়াজ শুনে অন্যরা বুঝতে পারত সব শেষ।
আওয়ামী লীগ নেতা মােতালেব খাঁ-র ওপর ১১ দিন অবিরাম নির্যাতন করা হয়। এক রাতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তাঁকে মিলের ২নং গেটের সামনে মেইন রােডে ফেলে দিয়ে যায়।
২১শে জুন পুরান বাজার থেকে হাবিলদার শুকুর আহমেদ চরমুগরিয়ার মােসলেম চোকদারের ছেলে ইয়াকুব আলী চোকদার ওরফে চানমিয়াকে ধরে এ ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়। এখানে ইয়াকুব আলীকে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। ইয়াকুব আলী তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-এর একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
মাদারীপুর সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আনােয়ার ফরাজি। জুন মাসে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্য বাবলু, নানু ও শাহেদ আলী মাদারীপুর শহরের বেপারী বাড়ি রােড থেকে তাঁকে আটক করে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। হানাদার বাহিনী তাঁকে দীর্ঘ দুমাস এ আর হাওলাদার জুটমিলস ক্যাম্পে আটকে রেখে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দেয়। তাঁর সঙ্গে আরাে দুশ যুবককে হানাদার বাহিনী একই কায়দায় নির্যাতন করে। তাদের ১০-১২ জন বাদে বাকি সবাইকে পাকিস্তানি সেনারা আড়িয়াল খাঁ নদীর কিনারে জেটির ওপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
১৪ই আগস্ট সকালে উকিলবাড়ি গ্রামে হামলা করে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আবদুর রব হাওলাদার, আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার, আবদুর রশিদ হাওলাদার, শফিজ উদ্দিন তালুকদার, হাসেম হাওলাদার ও কাসেম মাতুব্বরকে ধরে এ আর হাওলাদার জুটমিলসে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের বন্দি করে রেখে ১৯ দিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তাদের হাত ও পায়ের গিটে গিটে পেটা। পা ওপরে ঝুলিয়ে নাকে গরম পানি ঢালে। এভাবে নির্যাতন করে আর জিজ্ঞেস করেছে, বাতাও, মুক্তি কাহা হ্যায়?’ জবাব দেয়ার সময় না দিয়ে আবার পেটায়। নির্যাতনে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখন শরীরে সিগারেটের আগুন লাগিয়ে চেতন ফিরিয়ে এনে আবার নির্যাতন করে।
৯ই ডিসেম্বর মাদারীপুর শহর শত্রুমুক্ত হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আস্তানা এ আর হাওলাদার জুটমিলসের বিভিন্ন স্থান ও পার্শ্ববর্তী কুমার নদীর চড়াভূমিতে অসংখ্য নরমুণ্ডু, কঙ্কাল, ছেড়া শাড়ি, মেয়েদের ব্লাউজ, লুঙ্গি, শার্ট ও রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়। এখানে নারীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানাে হতাে। এখানে নারীদের বন্দি করে রাখা হতাে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়েদের ধরে আনা হতাে। কখনাে-কখনাে বালির বস্তার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া হতাে। অনেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। অনেককে জ্যান্ত কবরও দেয়া হয়। মে মাস থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজারের বেশি মানুষকে তারা এখানে ধরে এনে হত্যা করে।
অনেককে ধরে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেই গর্তেই গুলি করে বা জ্যান্ত মাটিচাপা দেয়া হতাে। পাকিস্তানি হানাদাররা পালং থানার আবদুল কাদের বেপারীকে ধরে এ আর হাওলাদার জুটমিলসের নির্যাতন কক্ষে প্রথমে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরে তাকেসহ ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করার জন্য জুটমিলসের জেটির ওপর সারি বেঁধে দাঁড় করায়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। আবদুল কাদের বেপারী কোনােরকমে বেঁচে যান।
মাদারীপুর শহর মুক্ত হবার পর ডা. এম এ কাসেম এমপি হাওলাদার জুটমিলসের জেটির নিচে নদীর চড়ায় ১৮৩টি নরমুণ্ডু দেখতে পান। এখানে ছিল মাদারীপুরের সাবজেলার আবদুর রশীদ খান, তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা টনি (১২), বাবুল (১৫), বেবি (১৭), সুফিয়া (১৯); মাদারীপুর নতুন টাউন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মহসিন আহমেদ তালুকদার, মুক্তিযােদ্ধা ধলু, বুর্জক আলীসহ অন্য শহীদদের কঙ্কাল।
মিলের ঘাটে জেটির ওপর কোনাে-কোনাে দিন ২০-২৫ জনকে এক সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করত। কেউ জীবিত থাকলে ঐ অবস্থায়ই ঠেলে পানিতে ফেলে দিত। তখন নদীতে সারি-সারি লাশ ভাসত। এখান থেকে কান্না, চিকার আর গােঙানির আওয়াজ পাওয়া যেত। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর জুট মিলসের ভেতরে অনেক লাশ পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানাে-ছিটানাে ছিল হাড্ডি ও মাথার খুলি। কিছু কংকালের সঙ্গে তখনাে কাঁচা মাংস লেগে ছিল ও দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।
এ আর হাওলাদার জুটমিলস বধ্যভূমিতে নিহত অসংখ্য মানুষের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- আবদুর রশিদ খান (শার্শা, যশাের), আবদুর রশিদ খানের স্ত্রী, টনি, রবিউল ইসলাম বাবু, জানু বেগম বেবী, সুফিয়া বেগম (২০), মানিক শরিফ (কলেজ রােড, মাদারীপুর শহর), নুরুল আলম পান্না (রাজদী, কালকিনি), কাজী আবদুল মান্নান (গােপালপুর, কালকিনি), ইয়াকুব আলী চানমিয়া (চরমুগরিয়া), একরাম উদ্দিন আহমদ আরিফ (মাদারীপুর শহর), হারুন অর রশিদ (দরগা শরীফ সড়ক, মাদারীপুর শহর), আবদুস সাত্তার মাদবর (ছয়না, মাদারীপুর), বদিউজ্জামান বদু (পুরান বাজার, মাদারীপুর শহর), মাে. শাহজাহান (পাঙ্গাশিয়া, কালকিনি), বিজয় মৃধা (আমগ্রাম, রাজৈর), মানিক সরদার (স্বরমঙ্গল, রাজৈর), মাে. নকিব উদ্দিন (হরিকুমারিয়া, মাদারীপুর), সাইদুর রহমান সাদী (স্বরমঙ্গল, রাজৈর), মাে. জাহাঙ্গীর হােসেন (শিকারমঙ্গল, কালকিনি) ও রাধেশ্যাম চক্রবর্তী (শিবচর)। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!