উদালিয়া চা-বাগান ক্যাম্প অপারেশন (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ১৪ই নভেম্বর। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ক্যাম্পটি হানাদারমুক্ত হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের পতন ঘটিয়ে নাজিরহাট কলেজ, আহমদিয়া মাদ্রাসা ও বিবিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-সামগ্রী সরবরাহ এবং ক্যাম্পসমূহের ওপর নজরদারি করার সুবিধার কথা ভেবে উদালিয়া চা-বাগানেও একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। চা-বাগানের ভবনসমূহ পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের জন্য অবস্থানগত দিক ছাড়াও থাকার জায়গা হিসেবেও অত্যন্ত সুবিধাজনক ছিল। অপরদিকে ফটিকছড়ি থানা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এ ক্যাম্প ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে অত্র এলাকায় অবস্থিত হানাদার বাহিনীর ছােট-খাটো ক্যম্পগুলাে মুক্তিযােদ্ধারা দখলে আনতে সক্ষম হলেও উদালিয়া চা| বাগান ক্যাম্প দখল করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কারণ এ ক্যাম্পে ছিল পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সুদৃঢ় অবস্থান। তাই এ ক্যাম্প থেকে আক্রান্ত হওয়ার কথা ভেবে মুক্তিযােদ্ধারা শঙ্কিত ছিলেন। তবে কৌশলগত কারণে এ ক্যাম্প অপারেশন মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
চা-বাগানস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের সৈন্য সংখ্যা, লজিস্টিক সুবিধা, মজুদ অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির কথা ভেবে লে. শওকত আলী ফটিকছড়ির পূর্বে জঙ্গলহিরাম এলাকায় বিনাজুড়ি ক্যাম্পে বসে পুরাে ফটিকছড়ি থানা, হাটহাজারী থানা ও রাউজান থানা এলাকায় কর্মরত মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ কমান্ডারদের নিয়ে এক গােপন সভায় মিলিত হন। সভায় তিনি ইতােমধ্যে সাহসিকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। এমন সব গ্রুপ কমান্ডারকে উদালিয়া চা-বাগান ক্যাম্প অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানালে অকুতােভয় গ্রুপ কমান্ডার নুরুল গণি নিজে ঐ অপারেশনের দায়িত্ব নিতে সম্মতি জানান। তাঁকে সহায়তা করার জন্য হাটহাজারী থানা এলাকার গ্রুপ কমান্ডার খালেদ এবং গ্রুপ কমান্ডার আহমদ ছফাকে নির্দেশ দেয়া হয়। ফটিকছড়ির মুক্তিযােদ্ধাদের সিইসি আবদুল হালিম নুরুল গণি গ্রুপকে কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন। উল্লেখ্য যে, একই সময়ে ফটিকছড়ি থানা, নাজিরহাট কলেজ, কেনুয়া চা-বাগান ও রাউজান থানার আমির হাট (মাইদ্যাম্যা হাট) মিলিশিয়া ক্যাম্প অপারেশনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের সদস্য সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে নিজেদের সেন্টারের দূরত্ব প্রভৃতি বিবেচনার পরও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা লে. শওকত আলীর উৎসাহব্যঞ্জক ও বীরত্বপূর্ণ বক্তৃতা শুনে একই সময়ে এতগুলাে অপারেশন পরিচালনার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণে এগিয়ে আসেন। উদালিয়া চা-বাগান অপারেশনের দিন ধার্য হয় ১৪ই নভেম্বর।
গ্রুপ কমান্ডার নুরুল গণি উদালিয়া চা-বাগান অপারেশনের জন্য তাঁর গ্রুপের ৬৫ জন যােদ্ধাকে বাছাই করেন এবং তাঁদের আসন্ন যুদ্ধের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তােলেন। কিন্তু ১৪ই নভেম্বর অপারেশনের রাতে চাবাগানে যাওয়ার পথে রােসাংগিরি হাইস্কুলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গাইডার ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের জন্য সিইসি আবদুল হালিম বা অপর কেউ আসেননি। কিন্তু নুরুল গণি দমবার পাত্র নন। যে-করেই হােক চা-বাগানে অপারেশন চালাতেই হবে। তাই তিনি দলবল নিয়ে চা-বাগানের দিকে রওনা হন। হালদা নদী পার হয়ে প্রথমে তারা নাজিরহাট এলাকায় যান। তারপর নূর আলী মিয়ার হাট পার হয়ে কুয়াশাভেজা শীতের রাতে নাজিরহাটের পশ্চিমে মন্দাকিনী পাহাড় এলাকায় যান। পাহাড় ঘেঁষে মন্দাকিনী খালের ভেতর দিয়ে অতি সন্তর্পণে তাঁরা উদালিয়া চা-বাগানের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছান।
গন্তব্য স্থলে পৌছে কামান্ডার নুরুল গণি গ্রুপ কমান্ডার আহমদ ছফাকে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান সম্পর্কে রেকি করার নির্দেশ দেন। রেকি শেষ করে আহমদ ছফা কমান্ডার নুরুল গণির কাছে তাঁর রিপাের্ট পেশ করেন। রিপাের্টের ভিত্তিতে কমান্ডার নুরুল গণি আত্মরক্ষার কৌশল ঠিক করে হানাদার ক্যাম্পে ত্রিমুখী আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পুরাে গ্রুপকে তিনটি দলে বিভক্ত করে তিনটি স্থানে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। মুক্তিযােদ্ধারা নিজ-নিজ এম্বুশে বসে লে. শওকত আলীর সঙ্কেতের অপেক্ষায় থাকেন। রাত আড়াইটার দিকে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান এলাকায় প্রথম মর্টারের গােলা বর্ষিত হয়। মার্টারের এ সাঙ্কেতিক গােলার আওয়াজের সঙ্গে-সঙ্গে চা-বাগান আক্রমণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের দলনেতাগণ ফায়ার ওপেন করেন। শুরুতেই বিশালদেহী এক পাঞ্জাবি সেন্ট্রিকে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে ধরাশায়ী করেন। কমান্ডার নুরুল গণির ফায়ারের সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা ত্রিমুখী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা একনাগারে আক্রমণ চলার পর হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা ‘রেডক্রস মার্কাযুক্ত প্যারাস্যুট বােমা আকাশে নিক্ষেপ করে। সাহায্যের জন্য নিক্ষিপ্ত প্যারাস্যুট বােমা দেখে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও মনােবল কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং তারা হালকা অস্ত্র দিয়ে এলােপাথাড়ি আক্রমণ চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে হানাদাররা আত্মরক্ষার জন্য পিছু হটে সীতাকুণ্ড পাহাড়ের দিকে চলে যায়। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে বেশ কয়েকজন পাঞ্জাবি সৈনিকের ছিন্ন-ভিন্ন লাশ। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড