You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণবিদ্রোহ ‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান’ - সংগ্রামের নোটবুক

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণবিদ্রোহ। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ মাস ধরে এই গণবিদ্রোহ চলে। এতে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এ অভ্যুত্থানে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংঘটিত এক ঐক্যবদ্ধ গণবিদ্রোহ। আগরতলা মামলার (১৯৬৮) পটভূমিতে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিল আরাে ব্যাপক ও বিস্তৃত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক ধাচের শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের বিদ্রোহ। আইয়ুব শাসনের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কোনােকোনাে অংশ বিশেষ করে ছাত্রসমাজের মধ্যে গণঅসন্তোষ দেখা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তার কারণ ছিল ভিন্ন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই তাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ নামে অভিহিত। সে রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ হলাে শাসক ও শাসিতের। নানাভাবে পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার হতে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্ববাংলার অর্জন পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অধিক হলেও তা বিনিয়ােগ হতাে দেশের পশ্চিম অংশে। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ছিল জাতি-বিদ্বেষ। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণে তাদের অসম্মতির মূলে ছিল সেটি। ভাষা-সংক্রান্ত দাবি আদায়ে বাঙালিদের অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে, এমনকি রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভােটে জয়লাভের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও মাত্র ৫৬ দিন ঐ মন্ত্রিসভা টিকে ছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২-ক ধারাবলে ঐ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৫৬ সালে বাঙালিদের প্রিয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে সক্ষম হন বটে, কিন্তু তাঁর ঐ সরকারকে মাত্র ১৩ মাস ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালিরা যাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন ৯ বছর বিলম্বিত হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে তা মাত্র ২ বছর ৬ মাস কোনােভাবে কার্যকর ছিল। মুখ্যত কেন্দ্রীয় শাসন থেকে বাঙালিদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ১৯৭০ সালের পূর্বে পাকিস্তানে কখনাে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৫৯ সালের প্রথমদিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা দেখা দিলে, এর পূর্বে ১৯৫৮ সালে প্রথমে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা এবং ৩ সপ্তাহের ব্যবধানে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। শুরু হয় জেনারেল আইয়ুবের এক দশকের শাসন।
আইয়ুব খানের শাসনামলে রাষ্ট্রের উপর পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সেনা-আমলা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের শাসন-নিয়ন্ত্রণ নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্ন করতে নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয়। শাসনতন্ত্র বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। সােহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। সােহরাওয়ার্দীসহ ৭৮ জন রাজনৈতিক নেতাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। ৩ বছর ৮ মাস দেশে একটানা সামরিক শাসন চলে। এরপর ১৯৬২ সালে প্রণীত হয় আইয়ুবের ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা প্রসূত তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থাধীনে পরােক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি নির্ভর কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার এক অভিনব সংবিধান, আইয়ুবি শাসনতন্ত্র নামে অভিহিত। এ ব্যবস্থাধীনে ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষ থেকে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভগ্নী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হয় এবং তাঁর বিপুল জনসমর্থন সত্ত্বেও শুধু সর্বজনীন ভােটাধিকার না থাকায় তিনি হেরে যান। বিরােধী দলের জন্য এ ছিল এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। আইয়ুব শাসনকালে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নতুন করে আঘাত আসে। আরবি বা রােমান হরফে বাংলা লেখার নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়। রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশন ও ১৯৬৪ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্টে উর্দু ভাষা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ, শিক্ষা সংকোচন এবং শিক্ষাকে দীর্ঘসূত্রী ও ব্যয়বহুল করা হয়, যা ছাত্র সমাজকে তীব্রভাবে বিক্ষুব্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি করার লক্ষ্যে পূর্বে (১৯৬১) কালাকানুন নামে পরিচিত ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। এদিকে পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার অব্যাহত থাকে। দুই অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য দিনে-দিনে আরও বৃদ্ধি পায়। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। নিম্ন ও মধ্যবর্তী পর্যায়ে যতটুকু ছিল, তাও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম। বাঙালিদের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। ব্যাংক-বিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। এক হিসেবে দেখা যায়, আইয়ুব শাসনের শেষের দিকে পাকিস্তানের সকল সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগের মালিক ছিল মাত্র ২২ পরিবার। এসব পরিবারের মধ্যে শুধু একটি ছিল বাঙালি। ট্যাক্স ও খাজনার ভারে কৃষকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। পাটচাষি পাটের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিক শ্রমের মজুরি, অন্য সুবিধাদি ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকে অবহেলিত। যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে বাঙালিদের নিরাপত্তা বিধানে সম্পূর্ণ অকার্যকর, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তা স্পষ্ট হয়।
এ-রকম এক সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আইয়ুব সরকার প্রথমে তাকে গ্রেপ্তার এবং পরে বন্দি অবস্থায় তাকে প্রধান আসামি করে মােট ৩৫ জন বাঙালি সামরিকবেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার অভিযােগ এনে এক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, যা আগরতলা মামলা- (১৯৬৮) নামে পরিচিত। ৬-দফাপন্থীদের ওপর নেমে আসে সরকারের চরম নির্যাতন-নিষ্পেষণ। আওয়ামী লীগের উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ের বহু নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন। ৬-দফার পক্ষে প্রচার চালানাের অভিযােগে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ, প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং এর ক্ষুরধারসম্পন্ন লেখক-সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬৮ সালের জুন মাস থেকে ঢাকার সেনানিবাসে স্থাপিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা মামলার আসামিদের বিচারকার্য শুরু হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে তা চলে। প্রতিদিনের বিচারিক কার্যক্রম, আসামি পক্ষের কৌসুলিদের সওয়ালজবাব দৈনিক পত্রিকাসমূহে ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। অতি শীঘ্রই বাঙালিদের মধ্যে এ ধারণা দৃঢ়মূল হয় যে, এ মামলা ছিল বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে আইয়ুবের ষড়যন্ত্রের ফল। আইয়ুব সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালিদের স্বার্থের প্রধান মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জাতি হিসেবে তাদের চিরদিন পদানত করে রাখা।
এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুর সহ-সভাপতি (বর্তমানে আওয়ামী লীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা) তােফায়েল আহমদের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে এগিয়ে আসে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপ), সরকারি ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) এর দোলন-নাজিম-কামরান গ্রুপ এবং ডাকসু মিলে আইয়ুববিরােধী ঐক্যবদ্ধ ছাত্রমঞ্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত ৬-দফা কর্মসূচি পূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর পাশাপাশি ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক ও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া এবং আরাে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করে তারা আন্দোলনের এগারােদফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। ৬-দফা দাবির অতিরিক্ত ১১-দফা কর্মসূচিতে আরও যেসব দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়, সেগুলাের মধ্যে ছিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট বাতিল, শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিহার, গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম, কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান, ছাত্রবেতন হ্রাস ও তাদের অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন, মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা, বাংলাকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে চালু, ব্যাংক-বিমা, পাটব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, কৃষকের ওপর থেকে খাজনা ও ট্যাক্সের বােঝা হ্রাস, বকেয়া মওকুফ ও সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও বােনাস প্রদান, ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘটের অধিকারের স্বীকৃতি, পাটের মূল্য নির্ধারণ, পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, জরুরি অবস্থাসহ সকল নিবর্তনমূলক আইন বাতিল, ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশনার ওপর জারিকৃত সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ নিয়ে সেখানে সাব-ফেডারেশন গঠন, সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট- নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ, দেশের কারাগারে আটক সকল নেতাকে অবিলম্বে মুক্তিদান ইত্যাদি। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার সম্বন্ধে ১১-দফা কর্মসূচির শেষ দফার শেষাংশে যা বলা হয়, বলার অপেক্ষা রাখে না, উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা-ই ছিল আন্দোলনের মূল লক্ষ্য: ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
দেশের বিস্ফোরণােন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আইয়ুব সরকার অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে তথাকথিত উন্নয়নের এক দশক পালনার্থে নানা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে, যা দেশের গণমানুষ বিশেষ করে বাঙালিদের আরাে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার কাছাকাছি সময়ে ১৯৬৯ সালের ৮ই জানুয়ারি ঢাকায় এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬-দফা পন্থী), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী খান), নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি, জমিয়ত-উলউলামা-ই-ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ (মমতাজ দৌলতানা), ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (নসরুল্লাহ খান, পিডিএম পন্থী) এই ৮টি রাজনৈতিক দল মিলিত হয়। বৈঠকে দেশের সর্বক্ষেত্রে অবনতি ও ধ্বংস ডেকে আনার জন্য আইয়ুবের ‘এক ব্যক্তির স্বৈরাচারী ও জুলুমের শাসন’কে দায়ী করে পূর্ণাংগ গণতন্ত্র ও জনগণের পূর্ণ রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ৮-দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব দলের সমন্বয়ে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বা ডাক (DAC) গঠন করা হয়। ৮-দফা দাবিনামার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, সকল কালাকানুন বাতিল, সংবাদপত্রের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, খান আবদুল ওয়ালী খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে জেনারেল আইয়ুবের এককালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী (পরবর্তীকালে সম্পর্ক ছিন্ন), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থী) প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তখন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব সরকার-বিরােধী গণবিক্ষোভ চলছিল।
১৯৬৯ সালের ১৭ই জানুয়ারি ডাক-এর নেতৃবৃন্দ পল্টনে সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। একইদিন সকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় (বর্তমান ক্যাম্পাস) ছাত্র জমায়েতের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ঐ দিনের সকল সভাসমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল বের করার চেষ্টা করা হলে শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষ। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পরের দিন ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানাে হয়। এদিনও ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দিনভর চলা সে সংঘর্ষ এমন রূপ নেয় যে, এক পর্যায়ে সরকার ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) তলব করে। পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা বেপরােয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডবলীলা চালায়। হলে-হলে ঢুকে ছাত্রদের বেধড়ক প্রহার ও অনেককে গ্রেপ্তার করে। তাদের হাতে শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। দিনে পুলিশের সঙ্গে যখন সংঘর্ষ চলছিল, তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রদের একটি মিছিল গুলিস্তান পৌঁছায় এবং সেখানে ছাত্র-জনতার সমাবেশ হয়। পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর হামলা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ২০শে জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে লাঠিহাতে ছাত্রদের একটি জঙ্গি মিছিল বের হলে মিছিলের শেষাংশে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) নেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সারা বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আসাদের মৃত্যুতে কালাে ব্যাজ ও কালাে পতাকাসহ ছাত্র ও শিক্ষকদের শােক মিছিল বের হয়। শােক মিছিলে বিপুলসংখ্যক ছাত্রী যােগ দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২১শে জানুয়ারি ঢাকা শহরে হরতাল, ২২শে জানুয়ারি সারাদেশে শােক দিবস এবং ২৩শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিলের কর্মসূচি ঘােষণা করে। ২৪শে জানুয়ারি ঢাকা শহরে হরতাল পালন করা হয়। হরতাল চলাকালে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সচিবালয় ও গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন) আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। সচিবালয়ের সামনে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুর নিহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ঢাকা শহরে অব্যাহত সান্ধ্য আইন জারি ও সেনাবাহিনী তলব করে। দেশের কোনাে-কোনাে জেলা শহরেও সান্ধ্য আইন জারি ও সেনা তলব করা হয়। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ এর মধ্যে একের পর এক তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে প্রতিদিন হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলা, মহকুমা (বর্তমানে জেলা), থানা (বর্তমান উপজেলা), গ্রাম, মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পাঞ্চলে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানানাে হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা এলে ঐদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দোকানপাট, যানবাহন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালাে পতাকা উত্তোলনসহ কৃষ্ণ দিবস পালন করা হয়। এর পূর্বে ১লা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ডাক (DAC) নেতৃবৃন্দ তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা আইয়ুব সরকারের পদত্যাগ, আগরতলা মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং ১১-দফার অন্যান্য দাবি পূরণে অনড় থাকেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার এক মহাসমাবেশে ৯ই ফেব্রুয়ারি সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ঐসব দাবি আদায়ে রক্তশপথ গ্রহণ করে। একই সভা থেকে আইয়ুব নগরের নাম ‘শেরে বাংলা নগর’, আইয়ুব গেইট (মােহাম্মদপুর)-এর নাম ‘শহীদ আসাদ গেইট’ এবং আইয়ুব চিলড্রেন পার্কের নাম ‘শহীদ মতিয়র পার্ক’ রাখার কথা ঘােষণা করা হয়। অতিদ্রুত আন্দোলন সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের কৃষক পর্যন্ত তাতে যােগ দেয়। আন্দোলনের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের অংশগ্রহণ। ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন কার্ফ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-সেনাবাহিনীর গুলি উপেক্ষা করে নারায়ণগঞ্জের আদমজী, ডেমরা, ঢাকার পােস্তগােলা, তেজগাঁ ও টঙ্গি শিল্পাঞ্চলের হাজার-হাজার শ্রমিক বিপ্লবী ছাত্রজনতার সঙ্গে যােগ দিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ডাক-এর পক্ষ থেকে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) এ জোটে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আন্দোলনের এ পর্যায়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৪ই ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির প্রতি তাঁর দলের পূর্ণ সমর্থন ঘােষণা করেন। শুধু সমর্থন ঘােষণাই নয়, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনেও এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা এবং অপর এক আসামি ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। ছাত্র-জনতা রুদ্ররােষে জ্বলে ওঠে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী পল্টনে বিক্ষুব্ধ জনতার এক বিশাল সভায় সরকারের উদ্দেশে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ এবং ঘেরাও-এর মতাে সহিংস কর্মসূচি গ্রহণের হুমকি দিয়ে ঘােষণা করেন যে, প্রয়ােজনে ফরাসি বিপ্লবের বাস্তিল দুর্গ ভাঙ্গার মতাে জনতাকে সঙ্গে নিয়ে জেলখানা ভেঙ্গে বন্দি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনা হবে। সঙ্গে-সঙ্গে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী শ্লোগান ধ্বনিত হয়: ‘জেলের তালা ভাঙ্গবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে, ‘তােমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। বিক্ষুব্ধ জনতা যােগাযােগ মন্ত্রী সুলতান আহমদ, কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা হাসান আসকারী এবং আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক এস এ রহমানের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। সারাদেশে যখন এ-রকম অগ্নিগর্ভ অবস্থা, তখন ১৮ই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর সদস্যের হাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়নের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশপথ কাজলার মােড়ে ড. জোহার এ হত্যাকাণ্ড ছিল আগুনে ঘৃতাহুতির মতাে। রাতেই ঢাকা নগরীর সান্ধ্য আইনের শৃঙ্খল ও সেনাবাহিনীর টহল ছিন্নভিন্ন করে হাজার-হাজার মানুষ আগ্নেয়গিরির দাবানল উদগীরণের মতাে চতুর্দিক থেকে রাস্তায় নেমে এসে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আইয়ুববিরােধী গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
বিপ্লবী জনতার অভ্যুত্থান যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত, তখন দিশেহারা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারােলে (parole) মুক্তিদানে তাঁর সম্মতি ব্যক্ত করেন, যাতে তিনি (মুজিব) তাঁর আহুত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২২শে ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তিদানে বাধ্য হন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেয়ার আয়ােজন করে। ডাকসু-র সহসভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা তােফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে দশ লক্ষ জনতার এক ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। সে সংবর্ধনা সভায় তােফায়েল আহমদ কর্তৃক জনসমুদ্রের পক্ষ থেকে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১-দফা কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, আমি যদি দেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবী আদায় করতে না পারি তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব।’ তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে, বাংলার মাটিকে আমি ভালবাসি। বাংলার মাটিও আমাকে ভালবাসে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গােলটেবিল বৈঠক ডেকে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান ও অন্য কিছু শর্তে আরাে কিছুকাল ক্ষমতায় টিকে থাকার নিষ্ফল চেষ্টা করেন। অবশেষে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ২৪শে মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে এক পত্রে তিনি লেখেন, ‘… দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। … এমতাবস্থায় ক্ষমতার আসন হইতে নামিয়া যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর দেখিতেছি না। তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করিয়া যাওয়া সাব্যস্ত করিয়াছি।’ ২৫শে মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান বিদায় নেন। এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে। এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটে আইয়ুবের এক দশকের স্বৈরশাসনের।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চেতনার উত্থান ঘটে। আর বাঙালির মুক্তিদাতা হিসেবে রাজনীতির শীর্ষবিন্দুতে আবির্ভাব ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর। এটি ছিল কার্যত সেনা-আমলা নির্ভর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালিদের বিদ্রোহ। উনসত্তরের এ গণঅভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী ঘটনাবলির ভিত্তিভূমি রচনা করে। [হারুন-অর-রশিদ]
সহায়ক গ্রন্থ: হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৯-২০১৮, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮; হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয় খ-, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ১৯৮২; মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০-১৯৭১, ঢাকা ১৯৯৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড