You dont have javascript enabled! Please enable it!

উপদেষ্টা পরিষদ

মুক্তিযুদ্ধকে সর্বজনীন রূপদানে স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে এর গঠন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে ৬ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রধানদের এক বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ হাতে পত্র লেখেন। ৮ ও ৯ই সেপ্টেম্বর এ দুদিন মুজিবনগরে ঐ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে যারা যােগদান করেন, তাঁরা হলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি, ন্যাপ ভাসানী), কমরেড মণি সিংহ (কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান), মনােরঞ্জন ধর (সভাপতি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), প্রফেসর মােজাফফর আহমদ (সভাপতি, ন্যাপ মােজাফফর), তাজউদ্দীন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার), খন্দকার মােশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী), এ এইচ এম কামারুজ্জামান (বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ও আব্দুস সামাদ আজাদ (রাজনৈতিক উপদেষ্টা)। বৈঠকে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনা শেষে ৮ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদ (Consultative Committee) গঠিত হয়। এর সদস্যরা হলেন- মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, মনােরঞ্জন ধর, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ এবং আওয়ামী লীগ থেকে আরাে দুই জন (নাম উন্মুক্ত)। তাজউদ্দীন আহমদ কমিটির সভা আহ্বান ও পরিচালনা করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। এটি গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি এবং দেশবিদেশে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তুলে ধরা। পরিষদের প্রধান কর্তব্য ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার পরামর্শ ও সহযােগিতা দান।
উপদেষ্টা পরিষদ গঠন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত দুদিনের সভায় মােট ৭টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলাে ছিল- (১) বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে অবৈধভাবে পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখার বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ; তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক জান্তা কর্তৃক প্রহসনমূলক বিচারের আয়ােজন বন্ধ; বিচার কার্য বন্ধসহ অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বের সকল শক্তির প্রতি আহ্বান; (২) মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নেতৃবৃন্দের সর্বপ্রকার আস্থা ও বিশ্বাস জ্ঞাপন এবং সর্বাত্মক সহযােগিতার অঙ্গীকার; (৩) ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান; বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদি দিয়ে সহযােগিতা দানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান; (৪) মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি এবং শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন; (৫) বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয়দান ও তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা এবং মুক্তি সংগ্রামে নিয়ােজিত বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদানের জন্য ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন; (৬) পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের শােষণমুক্তির লড়াইয়ের প্রতি একাত্মতা ঘােষণা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানে তাদের প্রতি আহ্বান; এবং (৭) রক্তই যদি মুক্তির মূল্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ প্রতি মুহূর্তে তা দিচ্ছে উল্লেখ করে এই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ব্যতীত বাংলাদেশের জনগণের কাছে অন্য কোনাে রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযােগ্য হবে না।
উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হওয়ার পর দ্রুত তা সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এর ফলে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয়ত, ভারতের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অধিকতর সক্রিয় হয়; তৃতীয়ত, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ ও অস্ত্র সংগ্রহ সহজতর হয়; চতুর্থত, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে ও বিশ্বজনমত গঠনে তা সহায়ক হয়; এবং পঞ্চমত, সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে।
কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) বিশ্বের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের নিকট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চিঠি লেখে। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় ও জনমত গঠনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জাতিসংঘে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে চীনের পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করেন এবং চীনের নেতৃবৃন্দের নিকট চিঠি লেখেন। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার পক্ষের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ছিল সুচিন্তিত ও অত্যন্ত সময়ােপযােগী একটি পদক্ষেপ। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি ২০১২।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!