উজানিসার ব্রিজ বধ্যভূমি
উজানিসার ব্রিজ বধ্যভূমি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত। এখানে মুক্তিযােদ্ধাসহ বহু সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের কোনাে একদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা সুলতানপুরের উত্তর বাজার এলাকা থেকে ২৩ জন গ্রামবাসীকে ক্যাম্পে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করায়। তারপর তাদের পরনের কাপড় খুলে দুজনকে হিন্দু বলে চিহ্নিত করে। এ দুজন হলাে- বিরামপুরের রতন মিস্ত্রি এবং মঙ্গল কাপালিক। অতঃপর তাদের দুজনকে উজানিসার ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সুলতানপুর থেকে কসবা পর্যন্ত মহাসড়কে বেশ কয়েকটি ব্রিজ রয়েছে। ব্রিজগুলাের মধ্যে বলরামের ব্রিজ, মহিউদ্দিন নগর ব্রিজ, ধরঘার ব্রিজ, তন্তর ব্রিজ, ছতুরা ব্রিজ, তিনলাকপির ব্রিজ, উজানিসার ব্রিজ ও সায়দাবাদ ব্রিজ উল্লেখযােগ্য। বর্ষাকালে এসব ব্রিজের নিচ দিয়ে বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী এবং মুক্তিযােদ্ধারা যাতায়াত করতেন। ব্রিজ অতিক্রম করার সময় বহু মুক্তিযােদ্ধা, শরণার্থী ও সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে আটক হয়েছে। আটককৃতদের অনেকেই আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারেনি। বিশেষ করে নারীরা। নারীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। বহু লােককে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসী প্রতিদিন লাশের পর লাশ ভেসে যেতে দেখেছে।
আগস্ট মাসে ঢাকা শহর ও আশপাশে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য ৫২ জনের একটি গেরিলা দলকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হয়। ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফ সিদ্ধান্ত নেন- গেরিলাদের ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে অপারেশনের জন্য ঢাকার উত্তরে পাঠানাে হবে। সেখানে তাঁরা ঘাঁটি স্থাপন করে যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেবেন এবং ঢাকায় আক্রমণ চালাবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমান্ডার মানিক ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের নেতৃত্বে তিনটি বড় পাটের নৌকায় করে মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএন্ডবি মহাসড়ক অতিক্রম করে তিতাসমেঘনা-বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে ঢাকার উত্তরে ধামরাইতে তাঁদের প্রথম ঘাঁটি স্থাপন করতে হবে। কিন্তু সিএন্ডবি রােডের ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা পার হওয়ার মুহূর্তে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের শিকার হন। এতে সামনের দিকের ফরিদপুর কোম্পানির পাঁচটি নৌকাভর্তি মুক্তিযােদ্ধারা মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। নাসির উদ্দিন ইউসুফদের দলের মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানিতে লাফিয়ে পড়তে থাকেন। গাঢ় অন্ধকার, আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিৎকার, কামানের গােলায় আলােড়িত জলরাশি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অবিরাম গুলি – সব মিলিয়ে সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। ঠিক এ-সময় মুক্তিযােদ্ধা মেসবাহ উদ্দিন সাবু অসম সাহসিকতায় পুরাে ব্যাপারটা সামাল দেন। তাঁর নেতৃত্বে জীবিত মুক্তিযােদ্ধারা নিঃশব্দে জলে নেমে নৌকার পাশ ধরে সাঁতার কেটে অস্ত্রসহ নৌকা নিয়ে বাঁশঝাড়ের আড়ালে চলে যান। প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে ধীরেধীরে নৌকাগুলাে নিয়ে তারা নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যান। তারপর নৌকা থেকে অস্ত্র খালাস করে গ্রেনেড ও মাইনগুলাে দুটি বস্তায় ভরে তাঁদের ট্রানজিট ক্যাম্প ভারতের মনতলিতে পৌছান। এদিন ফরিদপুর কোম্পানির অর্ধশত মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
এভাবে উজানিসার ব্রিজ এলাকায় বহু লােককে হত্যা করে। নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এখানে প্রায় প্রতিদিনই হত্যার ঘটনা ঘটে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে কয়েক হাজার মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। হত্যার শিকার প্রায় সকলেই দেশের বিভিন্ন এলাকার, তাই তাদের পরিচয় সংগ্রহ করা যায়নি। [জয়দুল হােসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড