You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক উইলহিলমাস এ এস ঔডারল্যান্ড

উইলহিলমাস এ এস ঔডারল্যান্ড, বীর প্রতীক (১৯১৭-২০০১) ওলন্দাজ বংশােদ্ভূত অস্ট্রেলীয় নাগরিক। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
ঔডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্রাহাম ঔডারল্যান্ড। দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান উইলিয়ম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযােগ পাননি। ১৯৩৪ সালে তিনি নেদারল্যান্ডে বাটা সু কোম্পানিতে সু-শাইনার বা জুতা পালিশের কাজ নেন। দুবছর পর এ-কাজ ছেড়ে তিনি ওলন্দাজ জাতীয় সেনাবাহিনীতে যােগ দেন (১৯৩৬) এবং চার বছর ওলন্দাজ রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডাে হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের সময় তিনি জার্মানিদের হাতে বন্দি হন। কিন্তু অচিরেই বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেসিস্ট্যান্স মুভমেন্টে যােগ দেন। এই গােপন সংস্থায় তিনি গােয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাটা সু কোম্পানিতে ফিরে যান।
বাটা সু কোম্পানির প্রােডাকশন ম্যানেজার পদে নিয়ােগ নিয়ে ঔডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষদিকে ঢাকায় আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ এবং সারা দেশে নিরীহ জনগণের ওপর তাদের নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলােকচিত্র তুলে ঔডারল্যান্ড গােপনে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তােলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই এক পত্রে লিখেছেন, ইউরােপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলাে যেন আমি নিজের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানাে উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই কোম্পানি-ম্যানেজার ঔডারল্যান্ড যেন নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখােমুখি প্রাক্তন সৈনিক ঔডারল্যান্ডকে। প্রথমদিকে তিনি দখলদার পাকবাহিনীর পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের গােপন তথ্য সংগ্রহ করে আগেভাগেই মুক্তিযােদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। একজন বিদেশী এবং বাটা সু কোম্পানির মতাে বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে। পাকবাহিনীর নিকট তাঁর নিঃসংশয় গ্রহণযােগ্যতা ছিল। তিনি সেনাসদরে অবাধ বিচরণ এবং সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলােচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযােগ পেতেন। এ-সময় তিনি সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিশেষত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, সিভিল অ্যাফেয়ার্স এডভাইজার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রমুখের সঙ্গে সখ্য গড়ে তােলেন। সেনাসদরে অবাধ যাতায়াতের সুযােগে ঔডারল্যান্ড সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের গােপন তথ্য সংগ্রহ করে ২নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দারের নিকট প্রেরণ করতেন। এছাড়া তিনি গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা দান এবং সকল সম্ভাব্য উপায়ে সাহায্য করতেন। এ-সময় তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিজ আবাসস্থলকে মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত করেন। উইলহিলমাস ঔডারল্যান্ড ছিলেন ২নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডাে হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে অস্ত্র, গােলা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ অকুতােভয় ঔডারল্যান্ড টঙ্গীর বাটা সু ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গণসহ আরাে কয়েকটি গােপন ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। এক সময় তিনি নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়েন। গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইন, ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে তিনি যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তােলেন। তার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালিত হয়।
উইলহিলমাস ঔডারল্যান্ড ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বাটা সু কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ফিরে যান তাঁর নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে ২০০১ সালের ১৮ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ দিনগুলােতে প্রায়শ তিনি তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের ভালােবাসা; পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আবেগের এ ধারা অব্যাহত রেখাে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য উইলহিলমাস এ এস ঔডারল্যান্ডকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর প্রতীক’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে এবং ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (মরণােত্তর) প্রদান করে। এছাড়া ২০১০ সালে ঢাকার গুলশানে তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!