You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক, ভারতে বিবিসির প্রতিনিধি ও দীর্ঘদিন বিবিসি-র নয়াদিল্লি ব্যুরাের প্রধান উইলিয়াম মার্ক টালি - সংগ্রামের নোটবুক

উইলিয়াম মার্ক টালি

উইলিয়াম মার্ক টালি (জন্ম ১৯৩৫) প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক, ভারতে বিবিসির প্রতিনিধি ও দীর্ঘদিন বিবিসি-র নয়াদিল্লি ব্যুরাের প্রধান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত। ১৯৩৫ সালের ২৪শে অক্টোবর ভারতের কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৪ বছর বয়সে দার্জিলিংয়ের ব্রিটিশ বাের্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ইংল্যান্ডের টাইফোর্ড স্কুল ও মার্লবােরাে কলেজে পড়াশােনা শেষে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি হলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চার্চের একজন যাজক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে সে চিন্তাধারা থেকে সরে আসেন। তিনি ১৯৬৪ সালে বিবিসিতে যােগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে বিবিসি-র সংবাদদাতা হিসেবে ভারতে চলে আসেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণীকলকাতা ও বিবিসি এ ৩টি ছিল প্রধান। সঠিক বা বস্তুনিষ্ঠু সংবাদের জন্য বিবিসি-র ওপর মানুষের আস্থা ছিল সর্বাধিক। পাকিস্তানি হানাদার অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিবিসি-র সান্ধ্যকালীন ও রাত ১০টার সংবাদ ও সংবাদ পর্যালােচনা অনুষ্ঠান শােনা ছিল একটি নিয়মিত বিষয়। বিবিসি-র জনপ্রিয়তা তখন শীর্ষে। এর নয়াদিল্লি ব্যুরাের প্রধান মার্ক টালি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির ঘরে-ঘরে অতি পরিচিত নাম।
ভারতের সঙ্গে মার্ক টালির পরিবারের পূর্বপুরুষদের দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। অনেকে এখানে থেকে দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। তাঁর পিতাও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে থাকতেন। তবে তাঁর মাতৃকূলের বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশে। মার্ক টালির জন্ম কলকাতায়, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরেও এ দেশের সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ির টান।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ বিবিসি-তে মার্ক টালি পরিবেশন করেন। সে-সময় বহু বিদেশী সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন। এর পরপর ৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে, তবে তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ। বস্তুত নির্বাচনী ফলাফলে পাকিস্তানের স্পষ্ট দ্বিধা বিভক্তি প্রকাশ পায়। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মাত্র ২ দিন পূর্বে স্থগিত ঘােষণা করেন। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও বাঙালিদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান আসে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকার পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ওপর আক্রমণ করে বহু ইপিআর ও পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ও ছাত্রাবাসে আক্রমণ চালিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হয়। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘােষণা করে পাকিস্তানের শেষ শত্ৰুটিকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানান। শুরু হয় বাঙালির নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। অপরদিকে সারাদেশব্যাপী চলতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযােগ, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন। জীবনের ভয়ে ভীত এক কোটি বাঙালি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পরপর সকল বিদেশী সাংবাদিককে প্রথমে ঢাকার হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আবদ্ধ করে রেখে পরের দিন তাদের প্লেনে তুলে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও এসােসিয়েটেড প্রেসের ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট ৭২ ঘণ্টার জন্য আত্মগােপন করে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বাস্তব চিত্র সংগ্রহ করে তা বিশ্বকে সর্বপ্রথম জানাতে সক্ষম হন।
এদিকে যুদ্ধের নয় মাস মার্ক টালি বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, রণাঙ্গনের খবর, ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের দুর্বিষহ অবস্থা ইত্যাদি বিবিসি-র বাংলা ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে অত্যন্ত নিপুণতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সার্বিক পরিস্থিতির চাপে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ অন্তত দুবার মার্ক টালিকে বাংলাদেশে প্রবেশের অধিকার দেয়। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের চিত্র দেখে খুবই মর্মাহত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় মহাকুমার (বর্তমান জেলা) ভারত সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়া উপজেলা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত ছিল। মার্ক টালি বিবিসি রেডিও-র উইলিয়াম ক্রলিকে নিয়ে তেঁতুলিয়ার মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন। মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন, মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং, ভজনপুর ফ্রন্টের যুদ্ধের আলােকচিত্র, মুক্তিযােদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি বিবিসি-র মাধ্যমে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে তুলে ধরেন। যুদ্ধের শেষের দিকে বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা ও পাকিস্তানি বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর, ৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় পর্যন্ত প্রতিদিনের খবর গুরুত্বসহকারে সবিস্তার বিবিসি-তে প্রচারিত হয়। মার্ক টালি ছিলেন এর মূল ভূমিকায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্ক টালি তার প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামে অভিহিত করেন। এজন্য কোনাে-কোনাে মহল তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযােগ পর্যন্ত তােলে। পাকিস্তানিদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই সমালােচিত ব্যক্তি। প্রধানত তার ভূমিকার কারণে পাকিস্তানিরা বিবিসি-কে ভারতীয় ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’, ‘দ্য ব্রিটিশ বুলশিট করপােরেশন’ ইত্যাদি নামে তিরস্কৃত করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এক সেমিনারে বক্তব্যদানকালে মার্ক টালির উদ্দেশে ৭১-এ তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করে জনৈক শ্রোতার মন্তব্য ছিল, আপনি এবং বিবিসি আমাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে জয় এনেছেন। আক্ষরিক অর্থে না হলেও একথা অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে বিশ্ব জনমত গঠন এবং মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের মনােবল সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রে বিবিসি ও এর ভারতীয় প্রতিনিধি মার্ক টালির ভূমিকা ছিল খুবই গুরত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর মার্ক টালি বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ও বিবিসি-র ভূমিকার উচ্চশিত প্রশংসা করেন। মার্ক টালি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, সারল্য এবং জনগণের প্রতি তার ভালােবাসা দেখে মুগ্ধ হন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটি পেন্টিং উপহার দেন, যেটি মার্ক টালি দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় তাঁর বাসভবনে সংরক্ষিত করে রাখেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কভারেজ ছিল মার্ক টালির জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মার্ক টালিকে ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত করে। এছাড়াও মার্ক টালিকে ভারত সরকার তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে সার্বিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালে ‘পদ্মশ্রী’ এবং ২০০৫ সালে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করে। ২০০২ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নাইট’ উপাধি লাভ করেন।
মার্ক টালি দীর্ঘ ৩০ বছর বিবিসি-র সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে ১৯৯৪ সালে সেখান থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘােষণার পর ১৯৭৫ সালে তিনি ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ১৯৭৭ সালে তিনি পুনরায় ভারতে ফিরে এসে দিল্লিতে বসবাস করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলাের মধ্যে No Full Stops in India (1988), India’s Unending Journey (2008) উল্লেখযােগ্য। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড