You dont have javascript enabled! Please enable it!

উখিয়া উপজেলা

উখিয়া উপজেলা (কক্সবাজার) বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে রামু উপজেলা, দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলা, পূর্বে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ও মায়ানমার এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। ১৯২৬ সালে এটি থানার মর্যাদা পায় এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়। প্রত্যন্ত ও পাহাড়ি এলাকা হলেও এখানে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ কম লাগেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ এখানকার ছাত্র-যুবকরা অংশগ্রহণ করে। এতে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগ নেতা বাদশাহ মিয়া চৌধুরী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখানকার জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে ভােট দেয়। নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা না দেয়ায় ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সারাদেশে পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়, তাতে উখিয়ার জনগণও যােগ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণথেকে উখিয়ার জনগণ দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা পায়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বাধীনতা ঘােষণা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। উখিয়ার মানুষও জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য এখানে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন শমশের আলম চৌধুরী (আওয়ামী লীগ নেতা ও রত্নাপালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান), বদিয়র রহমান চৌধুরী (ফলিয়া), সিরাজুল হক চৌধুরী (ঘিলাতলী, সমাজসেবক), বাদশা মিয়া চৌধুরী (হলদিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী), আব্দুল মান্নান চৌধুরী (সােনারপাড়া), আলী আহমদ সিকদার বিকম (ঘিলাতলী), ইলিয়াছ মাস্টার (ঘিলাতলী), এজাহারুল হক বিএসসি (জালিয়াপালং), আব্দুল হক চৌধুরী (রত্নাপালং), বক্তার আহমদ চৌধুরী (পালংখালী), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ফলিয়াপাড়া), শামশুল আলম সিকদার (টাইপালং), বশির আহমদ (মালভিটা), আব্দুল খালেক (খয়রাতি), রমজান আলী সওদাগর (ফলিয়া) প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এরও একটি শাখা এখানে গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন দিদারুল আলম চৌধুরী (রত্নাপালং), সৈয়দ আলম (সাদৃকাটা), পরিমল বড়ুয়া (ভালুকিয়াপালং), রশিদ আহমদ (কোটাবাজার), নূরুল আমিন (কোটাবাজার), নজির আহমদ বিএ (মরিচ্যা), নূরুল ইসলাম (রত্না), আব্দুল করিম মাস্টার (গয়ালমারা), প্রফেসর ফজলুল করিম (টাইপালং), মাস্টার শাহজাহান (টাইপালং), সুলতান আহমদ (গয়ালমারা), সৈয়দ আবু আহমদ চৌধুরী (ফলিয়াপাড়া), আজিজুল হক চৌধুরী (ফলিয়াপাড়া), নূর আহমদ খান (ডিগলিয়া) প্রমুখ। এঁরা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিলে স্থানীয় লােকজনদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন।
৩১শে মার্চ স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামে যুদ্ধরত বাঙালি সেনা, ইপিআর, আনসার ও পুলিশের জন্য উখিয়ার ঘাট কাস্টমস গুদাম থেকে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন প্রকার মালামাল সংগ্রহ করেন। ৯ই এপ্রিল সেগুলাে কক্সবাজার মহকুমা সংগ্রাম কমিটির পক্ষে আবছার কামাল চৌধুরী গ্রহণ করেন এবং ১০ই এপ্রিল ট্রাকযােগে চট্টগ্রামে পৌঁছে দেন। এভাবে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ স্থানীয় লােকজনদের কাছ থেকেও বিভিন্ন প্রকার পণ্য সংগ্রহ করে তা চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। শমশের আলম চৌধুরী এবং বাদশা মিয়া চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবেও অস্ত্র, খাদ্য ও জ্বালানি দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেন। এক পর্যায়ে বাদশা মিয়া চৌধুরী বার্মা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন। তবে এখানে সামরিক কোনাে ব্যক্তি না থাকায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কোনাে ব্যবস্থা করা যায়নি। তারা অন্যত্র গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। উখিয়া উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা হলেন- তেজেন্দ্র চন্দ্র মল্লিক (উখিয়া বাজার), রত্নাপালং ইউনিয়নের ভালুকিয়া গ্রামের নূর আহমদ, আবুল হােসেন, শামশু মিয়া, দুদু মিয়া প্রমুখ।
উখিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার আবদুস ছােবহান, বাদশা মিয়া চৌধুরী এবং পরিমল বড়ুয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন আবদুস ছােবহানের নেতৃত্বে পুলিশ, ইপিআর, আনসার, ছাত্র-কৃষক ও চাকরিজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয় আবদুস ছােবহান বাহিনী।
৯ই ডিসেম্বর আবদুস ছােবহান বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা আলােচনাপূর্বক দুটি দলে বিভক্ত হয়ে উখিয়া থানা অপারেশন এবং পরবর্তীতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হলদিয়া-পাতাবাড়ি পুরিক্ষ্যা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালনা করেন।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী কক্সবাজার থেকে সামরিক কনভয় নিয়ে এসে উখিয়া ও টেকনাফ দখল করে। উখিয়া থানার দায়িত্ব নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সুবেদার মালিক। উখিয়া থানাকে তারা অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। পাকবাহিনী উখিয়ায় অনুপ্রবেশ করার পর সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ নেতা মায়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন ঢেকিবনিয়ায় আশ্রয় নেন এবং কতিপয় তরুণ ছাত্র গােপনে মুক্তি সংগ্রামের তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।
উখিয়ায় পাকবাহিনীর সহযােগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির লােকজন তৎপর ছিল। এখানে বিপুল সংখ্যক রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিল বলে জানা যায়। উখিয়ায় স্বাধীনতাবিরােধী শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে হাশেম চৌধুরী (রত্নাপালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান), মীর কাশেম চৌধুরী, রশিদ আহমদ চৌধুরী, জমির আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, আব্দুল আজিজ সিকদার, এজাহার মিয়া চৌধুরী, কাজী সিরাজুল কবির, কাজী নুরুল কবির, মৌলভী ফজলুল হক, হাসানুজ্জামান মাস্টার, জাকির হােসেন মুন্সী, আমিন শরীফ ভূঁইয়া, আলতাফ হােসেন, কামাল আহমদ পিসি, সােলতান আহমদ, জালাল আহমদ, আবুল হােসেন মেম্বার প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এদের সহায়তায় পাকবাহিনী এখানকার মুক্তিকামী মানুষ এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযােগ ও লুঠতরাজ চালায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রহরে উখিয়ার রুমখাপালং গ্রামের কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)-এর আবাসিক ছাত্র এ টি এম জাফর আলম ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। এরপর পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন ঘুমধুম জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মােহাম্মদ ইলিয়াছ মাস্টার। জুন-জুলাই মাসের কোনাে এক সময় এসএসসি পরীক্ষার্থী রত্নাপালং হাইস্কুলের ছাত্র নির্মল চন্দ্র দে (পিতা গঙ্গাচরণ দে, বন বিভাগের উখিয়া মরিচ্যা বন বিট অফিসের প্রহরী) স্কুল থেকে রুমখা মহাজনপাড়ায় তাদের বাড়িতে ফিরছিল। পথে পাকবাহিনী ধুরুমখালী থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি। এছাড়া মনিন্দ্র লাল বড়ুয়া ওরফে ভট্ট মহাজন (পিতা কালীধন মহাজন, রুমখাঁ মহাজনপাড়া: ২রা ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ), মণীন্দ্র বড়ুয়া ওরফে মনু বড়ুয়া (পিতা যতীন্দ্রমােহন বড়ুয়া, ঐ), ব্রজেন্দ্র লাল শীল (পিতা মাগন দাশ শীল, রুমখা নাপিতপাড়া) প্রমুখ হানাদারদের হাতে শহীদ হন। পাকবাহিনী বাদশা মিয়া চৌধুরীর বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়। এভাবে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এপ্রিল থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিকামী মানুষদের ওপর চরম নির্যাতন, জুলুম, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। পাকবাহিনী উখিয়া থানাকে তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে।
ডিসেম্বরের শুরুতে বাদশা মিয়া চৌধুরী, পরিমল বড়ুয়া, আব্দুস ছােবহান, আলী আকবর মেম্বার (তুমব্রু) প্রমুখ। ১৮-২০ জন মুক্তিযােদ্ধা মায়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন ঢেকিবনিয়া থেকে দেশে প্রবেশ করে উখিয়া সদরের আশপাশে অবস্থান নেন। ৯ই ডিসেম্বর তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে সকাল ১০টার দিকে উখিয়া থানা আক্রমণ করতে এগিয়ে আসেন। এ খবর পেয়ে থানায় অবস্থানরত রাজাকার, আলবদর ও পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এসময় উখিয়া থানার ওসি মনির মিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক সহযােগিতা করেন। মুক্তিযােদ্ধারা থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ফলে এদিনই উখিয়া হানাদারমুক্ত হয়।
উখিয়া উপজেলার যেসব মুক্তিযােদ্ধা অন্য এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন, তাঁরা হলেন- তেজেন্দ্র চন্দ্র দে (উখিয়া বাজার), রত্নাপালং ইউনিয়নের ভালুকিয়া গ্রামের নূর আহমদ, আবুল হােসেন ও শামশু মিয়া। উখিয়া সদরে ৯০-এর দশকে শহীদ মােহাম্মদ ইলিয়াছ মাস্টারের নামে একটি গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এছাড়া শহীদ এ টি এম জাফর আলমের নামে কক্সবাজারের লিংকরােড থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৭৯ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। উখিয়ার কোর্টবাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ মুক্তিযােদ্ধা মনিন্দ্র লাল বড়য়া (ভট্ট মহাজন) এর নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [রফিকুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!