ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা (ময়মনসিংহ) ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে প্রায় ২৪ কিলােমিটার দূরে। ১৯৬৬ সালের ৬দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ঈশ্বরগঞ্জের সচেতন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাতেম আলী মিয়াকে বিপুল ভােটে এমপিএ নির্বাচিত করে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে সারা বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রশ্নে উত্তাল হয়ে উঠলে ঈশ্বরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষও তাতে যােগ দেয়।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঈশ্বরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ ও সহযােগী সংগঠনের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ঈশ্বরগঞ্জ খেলার মাঠ ও থানা মাঠে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। সেখানে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে এলাকার ছাত্রযুবকরা প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। প্রশিক্ষণ চলে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী ঈশ্বরগঞ্জে প্রবেশ করলে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবকরা ভারতের মেঘালয় প্রদেশের তুরাতে চলে যান এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর মােকাবেলা করেন।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে হাতেম আলী মিয়া এমপিএ, আওয়ামী লীগের মােসলেম উদ্দিন খান, হাসেম উদ্দিন আহমেদ, আমির আলী মণ্ডল, এনায়েতুল্লাহ সরকার, মতিউর রহমান, এনামুল হক ভূঁইয়া, পরেশ সাহা (ন্যাপ), আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া (ছাত্রলীগ-) প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে যুদ্ধকালীন দুজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাঁরা হলেন- আব্দুস সালাম (পিতা ঈমান আলী, চর আগলী) ও কাজী হাসানুজ্জামান হিরু (পিতা কাজী ফজলুল হক, নিচতুলন্দর)।
১৯৭১ সালের ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী ভৈরব-কিশােরগঞ্জ রেলপথে ঈশ্বরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে এবং ডাকবাংলাে ও পুলিশ স্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে রামগােয়ালপুর রেলওয়ে ব্রিজ ও মাইজাটি রেলওয়ে ব্রিজের পাশে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঈশ্বরগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দু-বাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ওসমান গণি তালুকদার (নিচতুলন্দর, শান্তি কমিটি), সামসুদ্দিন মওলানা (সােহাগী), শহিদুল্লাহ ফকির (কাকনহাটি, রাজাকার), নূরুল ইসলাম চৌধুরী (জাটিয়া), আমুদি (মাসিয়াকান্দি), আবুল কাশেম সরকার (দত্তপাড়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
পাকবাহিনী ২১শে এপ্রিল ঈশ্বরগঞ্জে প্রবেশের পথে সােহাগী গ্রামের আব্দুর রহমান, তারা মিয়া, গােপাল কর, সরিষা ইউনিয়নের আব্দুল জব্বার ও আব্দুল লতিফকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন ঈশ্বরগঞ্জে প্রবেশ করে তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পুড়াবাইচ্যা গ্রামের আব্দুল গফুর, ঈশ্বরগঞ্জের যতীন্দ্র, শুকুর আলী, খুশির বাপ, ব্রজেন্দ্র দাস, প্রতাপ দাস, বিপিন দাস, ক্ষিতীশ চন্দ্র বণিক ও আব্দুল মজিদ (টেলিফোন অপারেটর) কে গুলি করে হত্যা করে। মে মাসে চরণীখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিদাস ভট্টাচার্য ও তাঁর পুত্র দেবদাস ভট্টাচার্যকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তারঘাট ব্রিজে গুলি করে হত্যা করে। ২৩শে জুন বিশ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ধীরেন্দ্র কুমার সরকারকে সােহাগী ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামে তার নিজ বাড়িতে শান্তি কমিটির নেতা সামসুদ্দিন মওলানার সহযােগিতায় পাকবাহিনী হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী ঈশ্বরগঞ্জ বাজার এবং মােসলেম উদ্দিন খান (চরশিহারী, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), হাসেম উদ্দিন আহমেদ (মাসিয়াকান্দি, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও আব্দুস সাত্তার (দত্তপাড়া)-এর বাড়ি, নিচতুলন্দর গ্রামের কাজীবাড়িসহ বহু স্থানে অসংখ্য ঘরবাড়িতে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযােগ করে। ২৮শে অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধা আব্দুস সাত্তারের পিতা কাদির উদ্দিন আহমেদ ও তাঁর বড়ভাই রইচ উদ্দিন আহমেদকে ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে।
১৯৭১ সালের ২৭শে আগস্ট ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা বাজারে বাবু মান্নানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে প্রায় এক ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে চারজন রাজাকার নিহত হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ থানায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ১২ই সেপ্টেম্বর তিন প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা তিনদিক থেকে ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। প্রায় দিনভর যুদ্ধ চলে। ঈশ্বরগঞ্জ থানা আক্রমণ ছিল খুবই ভয়াবহ। এ-যুদ্ধে ৭ জন মুক্তিযােদ্ধা ও একজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। অপরদিকে শান্তি কমিটির এক নেতা নিহত হয়। উপজেলায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা হলেন- আশরাফ আলী খান, বীর প্রতীক (চট্টিগ্রাম)।
ঈশ্বরগঞ্জে ৫ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধার নাম জানা যায়। তারা হলেন- আব্দুল খালেক (পিতা খােরশেদ আলী, হরিপুর), আব্দুল মান্নান (পিতা আবু মিয়া, সােহাগী), শামছুল হক (পিতা ইউনুছ আলী, রুকনপুর), মতিউর রহমান (পিতা আব্দুস ছালাম, খৈরাটি) ও আব্দুর রহিম (পিতা নবী হােসেন বেপারী, ঈশ্বরগঞ্জ বাজার)। ঈশ্বরগঞ্জ চৌরাস্তার পাশে (ডাকবাংলাের দক্ষিণ পাশে) মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [আশিক আজিজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড