You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম উ ক্য চিং - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম উ ক্য চিং

উ ক্য চিং, বীর বিক্রম (১৯৩৭-২০১৪) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৩৭ সালের ১৭ই নভেম্বর বান্দরবানের উজানীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয়ভাবে তিনি উ ক্য চিং নামে খ্যাত। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভুক্ত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন। তাঁর পিতা বাই স্যু উ এবং মাতা ন্যেই স্যা উ। ১৯৫২ সালের ১৭ই নভেম্বর উ ক্য চিং ইপিআর বাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে তেঁতুলিয়া প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে এন্টি-ট্যাঙ্ক পরিখা খনন করে মেডেল পান। ইপিআর হকি টিমের ফরােয়ার্ড হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে কয়েক দফা খেলেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ উ ক্য চিং লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা সীমান্ত ফাঁড়িতে নায়েক পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন এবং বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে মিলে বিওপি-র পাঞ্জাবি ও বিহারি সৈনিকদের ওপর নজরদারি করেন। নিজে মারমা জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সব সময় বলতেন যে, ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকরা তাঁর পরিবারের সদস্যের মতাে। ঢাকার পিলখানাসহ অন্যত্র গণহত্যার খবর স্থানীয় কয়েকজন তরুণের কাছ থেকে তাঁরা ২৭শে মার্চ সকালে জানতে পারেন। ঐদিনই বিওপির কমান্ডার হাবিলদার মাজহারুল হকের নেতৃত্বে ছােট ভাই উ বাই প্র-সহ তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। যুদ্ধ করেছেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের অধীনে ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে।
একাত্তরের ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাগভান্ডার বিওপিতে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু করলে উ ক্য চিং মাত্র ১৫ জনের একটি সেকশন নিয়ে তার মােকাবেলা করেন। ৪ দিন পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর বাগভান্ডার আসেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ঐ মেজর তাঁকে নিয়ে ভুরুঙ্গামারী যান এবং উ ক্য চিং মেজরকে পাকিস্তানিদের অবস্থান চিহ্নিত করতে সহায়তা করেন। পরদিন রাতে ৬টি মর্টার দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গােলাবর্ষণ করলে পাকিস্তানি এক ক্যাপ্টেনসহ কয়েকজন সৈনিক নিহত হয়।
মে মাসের প্রথম দিকে কাউয়াহাট যুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার উ ক্য চিং একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে জীবিত আটক করে তথ্য আদায়ের পর তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। পরদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুরুষদের এক জায়গায় জড়াে করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। উ ক্য চিং সহযােদ্ধাদের নিয়ে ৩০-৩২টি লাশ কবর দেন। পার্শ্ববর্তী বালুচরে গর্তের ভেতর লুকিয়ে থাকা বেশ কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করেন এবং পরদিন সীমান্তের ওপারে শরণার্থী ক্যাম্পে তাদের পৌঁছে দেন।
উ ক্য চিং-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ভুরুঙ্গামারী-জয়মনিরহাট-রায়গঞ্জের যুদ্ধ। ১৩ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে কমপক্ষে ৪০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধারা সেখান থেকে ১৯-২০ জন নারীকে উদ্ধার করেন। এরপর তিনি ও তার বাহিনী রাস্তায়-রাস্তায় বসানাে মাইনগুলাে অকার্যকর করেন। জয়মনিরহাট আক্রমণে উ ক্য চিং-এর বাহিনীকে লেফট ফরােয়ার্ড প্লাটুন হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ১৭ই নভেম্বর পিছু হটে এবং পালাবার সময় অনেকে গণপিটুনিতে নিহত হয়। রায়গঞ্জের যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদের কোম্পানি শত্রুসৈন্যের মেশিনগানের সামনে পড়ে। উ ক্য চিং দেখতে পান লেফটেন্যান্ট সামাদ নিজেই মাঝারি মেশিনগান নিয়ে কাভারিং ফায়ার করছেন যাতে সতীর্থ মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে পারেন। এক পর্যায়ে তাঁর মাথায় গুলি লাগে। এ-যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট সামাদ-সহ তিনজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। সারারাত যুদ্ধের পর রায়গঞ্জ মুক্ত হয়।
১৪ই ডিসেম্বর তিস্তা-ব্রিজ এলাকায় উ ক্য চিং তাঁর প্লাটুনসহ পাকিস্তানি বাহিনীর মুখােমুখি হন। ১৫ই ডিসেম্বর গােলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী কুড়িগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে উ ক্য চিং তাঁর প্লাটুন নিয়ে রংপুরে যান। ১৭ই ডিসেম্বর রংপুর টাউন হলের পেছনে কচুরিপানার মধ্য থেকে ৭টি নারীর লাশ তুলে তিনি দাফনের ব্যবস্থা করেন। যৌথবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা, উ ক্য চিং-এর সাহসিকতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। বীর বিক্রম উ ক্য চিং ২০১৪ সালের ২৫শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। [মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড