You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইসলাম কোম্পানি

ইসলাম কোম্পানি (চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রতিষ্ঠাতা আবু মাে. ইসলাম। তিনি চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়নের কানাইমাদারি এলাকায় ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হামিদ হােসেন, মাতা ফিরােজা খাতুন। ১৯৬১ সালের ১৮ই অক্টোবর তিনি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহি পদে যােগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ল্যান্স নায়েক, নায়েক ও হাবিলদার পদে উন্নীত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যশাের ক্যান্টনমেন্টে তিনি হাবিলদার পদে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দুমাসের ছুটিতে নিজ গ্রামে আসেন। ছুটিতে থাকা অবস্থায় মার্চ মাসের ২৫ তারিখ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বরমা ইউনিয়নে শাহজাহান ইসলামাবাদীর দেউরি ঘরটি বরিশালের অধিবাসী ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। চন্দনাইশ, পটিয়া, আনােয়ারা ও বাঁশখালী থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন পদের সেনাসদস্য এবং এলাকায় পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক ও ল্যান্স নায়েকরা এ ঘাঁটি থেকে মহিউল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করতে শুরু করেন। হাবিলদার আবু মাে. ইসলামও এ ঘাঁটি থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন এবং মহিউল আলমের অপারেশন কমান্ডার নিযুক্ত হন। এ ঘাঁটি থেকে বিভিন্ন অপারেশনে বীরত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ‘আবু কমান্ডার’ হিসেবে তাঁর নাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে এ ঘাঁটি থেকে মহিউল আলমকে প্রধান করে বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ সংগঠিত হলে তাঁর মধ্যে একটি ছিল হাবিলদার আবু মাে. ইসলাম গ্রুপ। তার গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আবুল বশর (পিতা মাওলানা মাে. ইসহাক, ভাইখলিফাপাড়া, হাশিমপুর ইউনিয়ন)। গ্রুপটির উল্লেখযােগ্য যােদ্ধারা হলেন- নুরুল ইসলাম (পিতা হামিদ হােসেন, বরকল, চন্দনাইশ; সেনাসদস্য), আইয়ুব আলী (পিতা হামিদ হােসেন, বরকল), দুদু মিয়া (পিতা আবদুর রশিদ, বরকল), এস এম গফুর (পিতা ছৈয়দুল হাকিম, বরকল), আবদুল গফুর (পিতা রহিম বখসু, দক্ষিণ কাঞ্চননগর, চন্দনাইশ), মাে. আবুল কাশেম (পিতা এনু মিয়া, পশ্চিম পাঠানদণ্ডি, বরকল), আবুবকর চৌধুরী (পিতা কবির আহমদ চৌধুরী, বরকল), মাে. ইছহাক মিয়া (পিতা মাে. এনু মিয়া, পাঠানদণ্ডি, বরকল), মাে. ইছহাক (পিতা আলতাপ মিয়া, উত্তর হাশিমপুর), মাে. আবদুল জব্বার (পিতা দুলা মিয়া চৌধুরী, বরকল), আনােয়ারুল হক চৌধুরী (বরকল), হিম্মৎ শরীফ (কুনিরবিল, আনােয়ারা), মনছফ আলী (পিতা আবদুর রশিদ, বরকল), আশরাফুল আলম (পিতা এজাহার মিয়া, উত্তর হাশিমপুর), নুরুল আবছার চৌধুরী (পিতা ওবাইদুর রহমান চৌধুরী, বরকল), নুরুল আমিন (পিতা ওবাইদুর রহমান, বরকল), শামসুল ইসলাম (পিতা মােখলেসুর রহমান, বরকল), নুরুজ্জামান (পিতা সিরাজ আহমদ, বরকল), আবদুর রশিদ (পিতা রৌশন আলী, বরকল) প্রমুখ।
আবু মাে. ইসলাম এ ঘাঁটি থেকে যেসব অপারেশনে নেতৃত্ব দেন, সেগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য- সাতকানিয়া কলেজ অপারেশন, আনােয়ারাস্থ ওসখাইন রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিম বিরােধী অপারেশন, চন্দনাইশস্থ হারলা শান্তি কমিটির নেতা ফোরক ভেন্ডার বিরােধী অপারেশন, পটিয়া থানা শান্তি কমিটির হেডকোয়ার্টার্স অপারেশন, রাঙ্গুনিয়া ফরেস্ট অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, বৈলতলীর মাওলানা শফি বিরােধী অপারেশন, শান্তি কমিটির নেতা মৌলভি আহমদ ছগির শাহজাদা (১৯৭০ সালের নির্বাচনে নেজামে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে বাঁশখালি থেকে নির্বাচিত এমপিএ)-র বাড়ি ও তার নেতৃত্বাধীন চূড়ামণি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন প্রভৃতি। মহিউল আলমের ঘাঁটি থেকে আবু মাে. ইসলাম সর্বশেষ যে-অপারেশনে অংশ নেন, সেটি হলাে আনােয়ারা থানা অপারেশন। ২৩শে সেপ্টেম্বর পরিচালিত এ অপারেশনে মহিউল আলম নেতৃত্ব দেন। আবু মাে. ইসলাম অপারেশন কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে অসম বীরত্ব প্রদর্শন করেন এবং আহত হন। এতে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে আবু মাে. ইসলাম গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার আবুল বশরসহ ওপরে উল্লিখিত যােদ্ধারাও ছিলেন। এ অপারেশনে ১৫ জন রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয়। ৪ জন মিলিশিয়া এবং ৫৮ জন পুলিশ ও রাজাকারকে বন্দি করা হয়। এছাড়া ৩ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। এবং ৬টি স্টেনগান ও ৬৬টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।
অক্টোবর মাসে আবু মাে. ইসলাম তার গ্রুপ নিয়ে চন্দনাইশ উপজেলার ধােপাছড়ি গমন করেন। তখন সেখানে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ অবস্থান করছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রুপ বিলুপ্ত করে এ গ্রুপের যােদ্ধাদের সঙ্গে ধােপাছড়ির হাবিলদার আছহাব মিয়া গ্রুপ ও নায়েক সুজায়েত আলী গ্রুপের যােদ্ধাদের যুক্ত করে ‘বি’-কোম্পানি গঠন করেন এবং আবু মাে. ইসলামকে এর কমান্ডার নিযুক্ত করেন। কোম্পানিটি গঠিত হওয়ার পর আবু মাে. ইসলাম কোম্পানির যােদ্ধাদের নিয়ে সাতকানিয়াস্থ বাজালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, চন্দনাইশস্থ উত্তর হাশিমপুর ডােমার বাড়ির রাজাকার লেদু বিরােধী অপারেশন প্রভৃতি পরিচালনা করেন। ১১ই নভেম্বর এ কোম্পানি ধােপাছড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেদিন দোহাজারী ও বান্দরবান থেকে প্রায় ৪০০ জন পাকিস্তানি সেনা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ধােপাছড়িতে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা, জ্বালাও-পােড়াও, নারীনির্যাতন ও লুটপাট করা। কোম্পানিটি প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং অর্ধশত পাকিস্তানি সেনা ও কতিপয় রাজাকার আহত হয়। অন্যদিকে, ৩ জন মুক্তিযােদ্ধা ও ৫ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
এ-যুদ্ধের পর আবু মাে. ইসলাম তাঁর ‘বি’-কোম্পানির অনেক সদস্য ও সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ-সহ ভারতের দেমাগ্রীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। অস্ত্রশস্ত্র ফুরিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের এ যাত্রায় ভারত গমনের প্রধান কারণ। তাঁদের সঙ্গে যােগ দেন সুবেদার মেজর শামসুর রহমান ও তাঁর ‘এ’কোম্পানির কতিপয় যােদ্ধা। পথিমধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় সুবেদার মেজর টি এম আলীর সঙ্গে সকলের সাক্ষাৎ হয়। ১৫ই নভেম্বর বান্দরবানের রােয়াংছড়ি উপজেলার নােয়াপতং ইউনিয়নের ক্যানাইজু পাড়া এবং এলাকার একটি পাহাড়ি গৃহে তারা আশ্রয় নেন। তাঁদের পরপরই সুবেদার মেজর টি এম আলী ও তার বাহিনীর যােদ্ধারাও এখানে এসে আশ্রয় নেন। ১৬ই নভেম্বর ভােররাত ৪টার দিকে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ, সুবেদার মেজর টি এম আলী, হাবিলদার আবু মাে. ইসলাম ও সুবেদার মেজর শামসুর রহমান-সহ প্যাগােডা এলাকায় আশ্রয় নেয়া সকল মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোদের ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হন। মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করে প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়েও পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। এযুদ্ধে সুবেদার মেজর টি এম আলী, ক্যানাইজু পাড়া এলাকার অং সাচিং মারমা (পিতা ক্যজাইং মারমা) ও সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা নিবাসী নায়েক ফয়েজ আহমদ-সহ অর্ধশতাধিক মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। হাবিলদার আবু মাে. ইসলামও সামান্য আহত হন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোরা ক্যানাইজু পাড়া এলাকায় ব্যাপক লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায় এবং উপজাতীয়দের প্রায় ৪০টি ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোদের সঙ্গে না পেরে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তবে হাবিলদার আবু মাে. ইসলাম কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাকে সংগঠিত করে সুবেদার মেজর শামসুর রহমান-সহ তাদের নিয়ে আবার দেমাগ্রীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে কুমিল্লার আলী আকবর পাটোয়ারী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন যােদ্ধাদল তাঁদের সঙ্গে যােগদান করেন। এক পর্যায়ে তারা সুলতান আহমদ কুসুমপুরী-সহ কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাকে খুঁজে পান এবং সকলে মিলে দেমাগ্রীতে পৌছান। সেখানে জেনারেল সুজান সিং উবানের নির্দেশে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ও হাবিলদার আবু মাে. ইসলামের সঙ্গে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে আরাে কতিপয় মুক্তিযােদ্ধা যুক্ত হয়ে একটি কোম্পানি গঠিত হয়। আবু মাে. ইসলাম তার কমান্ডার নিযুক্ত হন। নবগঠিত এ কোম্পানি ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এসএফএফ)-এর অন্তর্ভুক্ত। কোম্পানিটি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন মাউন্টেইন ঈগল’-এ অংশগ্রহণ করে। এ অপারেশনের আওতায় কোম্পানিটি জ্বালিয়ান পাড়া, যক্ষ্মা বাজার ও বরকল যুদ্ধে অংশ নেয়। [শািমসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!