বীর প্রতীক ইবনে ফজল বদিউজ্জামান
ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক (১৯৪৯ ১৯৭১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সুপ্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ ফজলুর রহমান এবং মাতার নাম হাজেরা বেগম। তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ২৪তম শর্ট কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৭০ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। তারপর তিনি রংপুর সেনানিবাসে সাঁজোয়া বাহিনীর (ট্যাংক বাহিনী) ২৯ ক্যাভালরিতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পোস্টিং পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বদিউজ্জামান রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র পাক হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে বদিউজ্জামান বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাকসেনারা তাঁকেসহ অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের নজরবন্দি করে রাখে। জুন মাসে তিনি এবং আরো দুজন বাঙালি অফিসার পাকিস্তানি বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে রংপুর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ব্রিগেড আকারে নিয়মিত বাহিনী ‘এস’ ফোর্সের অধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাকে এই রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। ‘এস’ ফোর্সের অধীনে তিনি অনেকগুলো সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ৩রা ডিসেম্বরের আখাউড়া সীমান্তবর্তী রামনগর যুদ্ধ। আখাউড়া অঞ্চলটি ১৯৭১ সালে ভৌগোলিক কারণে সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি এর অদূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্ত ঘেঁষে তাঁদের অনেকগুলো প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেন। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি ভোররাতে সেনারা হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধের আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থার ইবনে ফজল বদিউজ্জামান সৃষ্টি হয়, কেউ-কেউ পিছু হটতে থাকেন। এমতাবস্থায় বদিউজ্জামান জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত দক্ষতা ও বীরত্বের সঙ্গে অগ্রভাগে থেকে লড়াই করে সহযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনেন। আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা বাড়তে থাকে। দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুসেনাদের ছোড়া আর্টিলারি শেলের আঘাতে বদিউজ্জামান শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানকে বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৭০, খেতাবের সনদ নং ২০)। এছাড়াও এ বীর মুক্তিযােদ্ধার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ঢাকা সেনানিবাসের একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ বদিউজ্জামান সড়ক’ এবং বগুড়া সেনানিবাসের একটি প্যারেড গ্রাউন্ডের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ বদিউজ্জামান প্যারেড গ্রাউন্ড’। বদিউজ্জামান ছিলেন অবিবাহিত। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড